‘দহাড়’ ছবিতে একটা হদ্দ বোকা দাদা তার বোনের হারিয়ে যাওয়া-কে খুঁজে দেখতে চেয়েছিল। আর সেখান থেকেই, একজনের হারিয়ে যাওয়ার গল্পে ঢুকে পড়েছিল উনত্রিশ জন নিখোঁজ মেয়ে। ‘দহাড়’-এর গল্পটা শুরু হয়েছিল, আর শুরু হয়েছিল বলেই সে গল্প দিয়েই এ লেখা শুরু করা যায়। অবশ্য গল্প না বলে নিছক কয়েকটা সংখ্যা দিয়েও এ লেখা শুরু হয়ে যেতে পারত। এই যেমন, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল এই পাঁচ বছরে নিরুদ্দেশের তালিকায় যোগ হয়েছে এমন ৭০ হাজার ৫৪৯ জন মেয়ের নাম, যাদের কোনও খোঁজ মেলেনি আর।
বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে মেয়েটা। বয়সের ঘড়িতে একটু একটু করে বালি জমতে জমতে সে জেনে গিয়েছিল, এই বাড়িতে কোনও দিন তার জন্য ঘোড়ায় চড়ে কোনও রাজপুত্তুর এসে দাঁড়াবে না। এ যুগে কেবল রাজপুত্তুর কেন, কোটালপুত্তুরদেরও টাকা লাগে, মোটরবাইক লাগে, সোনার চেন লাগে। আর যে রাজকন্যারা সেইসব দাবি মিটিয়ে উঠতে পারে না, তাদের সারাজীবন বন্ধ দুর্গেই পড়ে থাকতে হয়। কিংবা তাদের মধ্যে যারা কোনও না কোনও ভাবে রাজবাড়িতে পা রাখতে পারে, তাদেরও মরে যেতে হয়। পণের দাবি মেটাতে না পেরে বধূমৃত্যু, একদিনের জন্য খবরের কাগজে ওই একটা জ্বলজ্বলে শিরোনাম বরাদ্দ হয় তাদের জন্য। এই মেয়েটা অমন কোনও ভাবেই হারিয়ে যেতে চায়নি। তাই যে ছেলেটা নিজেই বলেছিল তার সঙ্গে একলা ঘর বাঁধবে, সেই ঠিকানা খুঁজতেই সে বেরিয়ে পড়েছিল। আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল গল্পটা।
যদিও গল্পটা কিন্তু শুরু হওয়ার কথা ছিল না আদৌ। মেয়েমানুষই তো, একটা মস্ত বোঝা ছাড়া তো কিছু নয়। সে বোঝা যদি আপনাআপনিই ঘাড় থেকে নামে, তাহলে খুশি হওয়াই তো উচিত। কিন্তু ‘দহাড়’ ছবিতে একটা হদ্দ বোকা দাদা তার বোনের হারিয়ে যাওয়া-কে খুঁজে দেখতে চেয়েছিল। আর সেখান থেকেই, একজনের হারিয়ে যাওয়ার গল্পে ঢুকে পড়েছিল উনত্রিশ জন নিখোঁজ মেয়ে। ‘দহাড়’-এর গল্পটা শুরু হয়েছিল, আর শুরু হয়েছিল বলেই সে গল্প দিয়েই এ লেখা শুরু করা যায়। অবশ্য গল্প না বলে নিছক কয়েকটা সংখ্যা দিয়েও এ লেখা শুরু হয়ে যেতে পারত। এই যেমন, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল এই পাঁচ বছরে নিরুদ্দেশের তালিকায় যোগ হয়েছে এমন ৭০ হাজার ৫৪৯ জন মেয়ের নাম, যাদের কোনও খোঁজ মেলেনি আর। তাদের মধ্যে নাবালিকা ৩০৭৩ জন, আর পূর্ণবয়স্কা নারী ৬৭ হাজার ৪৭৬ জন। অর্থাৎ, প্রত্যেক দিন, ক্যালেন্ডারের প্রত্যেকটা তারিখে এ দেশ থেকে স্রেফ উবে গিয়েছে ৩৯ জন মেয়ে।
আসলে ভারত নামের দেশটায় যেমন ধর্মের প্রসঙ্গ এলে উঁচু-নিচুর ভাগ গুলিয়ে যায়, তেমনই এই বিভাজন ঘেঁটে যায় লিঙ্গের প্রশ্নেও। জাত, বর্ণ, শ্রেণি সবকিছুর বাইরে গিয়ে এদেশে যে একটাই বর্গ আছে মেয়েদের। আর সেটা সমাজের চোখে একরকমের পিছড়ে বর্গই। যে বর্গ আদতে প্রান্তিক, আদতে অপর। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র– সব জায়গাতেই তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, যারা নেহাতই একঘেয়ে আর গুরুত্বহীন। বেঁচে থাকতেই হোক কি মরে গিয়ে, ওরা একইরকম অচ্ছুত, একইরকম তাৎপর্যহীন একঘেয়ে। আর সেই একঘেয়ে বলেই ওদের খোঁজ পড়ে না কখনও। একজন হারালেও না, উনত্রিশ কি উনচল্লিশ জন হারালেও না। যেমন খোঁজ পড়েনি শ্রদ্ধা ওয়ালকরের। যে কিছুদিন আগেই প্রেমিকের হাতে টুকরো টুকরো হয়ে ফ্রিজে ঢুকে গিয়েছিল, শিক্ষিতা রোজগেরে মেয়ে হয়েও যে নিজেকে চিরদিনের মতো গরঠিকানা হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনি। অবশ্য না মরে গেলেও, ‘দহাড়’-এর সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের কারও কারও মতো তাকে মৃত বলেও দেগে দিতে পারত তার পরিবার। ঠিক যেমনটা ভেবেছিল মতি নন্দীর গল্পের সেই পরিবারটি। সতেরো বছরের ডাঁটো মেয়ে ইলা নিরুদ্দেশ হলে তার মা-বাবা ভয়ের চেয়েও বেশি লজ্জা পেয়েছিল। ছোট দুই ভাইও পড়ার বই খুলে মাথা নিচু করে বসে ছিল, কারণ বেরিয়ে যাওয়াটা যে বড্ড লজ্জার ব্যাপার, কেউ না বলতেও তা ওরা বুঝে গিয়েছিল। বাড়িওয়ালার কাছে মেয়ের মাসির বাড়ি যাওয়ার সাফাই দেওয়ার পর তার বাবা আরও খানিক ভেবেচিন্তে বলেছিল– “আর একটা কথা অবশ্য বলতে পারতে, ইলা মাসীর বাড়ি গিয়ে অ্যাকসিডেন্টে মরে গেছে।” গল্পের ‘শীত’ নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই, ঠান্ডা মাথায় বলতে পারা এই পরপর শব্দগুলো মেয়েদের এক হাড়-হিম শৈত্যের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে পড়তে পারে বাণী বসুর ‘বৃত্তের বাইরে’ উপন্যাসের ছুটকিকে, যে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে তার হলুদ শাড়িটি ছাদে মেলে রাখতে বলে গিয়েছিল। তাকে বাড়ি ফেরার পথ দেখাতে চাওয়া সেই শাড়িটিকে দাঁতে কেটে কুটিকুটি করে ফেলেন মা, আর গোটা পরিবারের মন থেকেই যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায় মেয়েটি। ‘অপর’ হওয়ার একাকিত্বকে বয়ে চলতে না চেয়ে এই যে মেয়েরা একরকম আত্মীয়তার ওম খুঁজতে চায়, আর খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যেতে থাকে একের পর এক, সেই চাওয়া যে তাদের নিজেদের পরিবারের কাছেই অপাঙ্ক্তেয়, তারই ইঙ্গিত রয়ে যায় এহেন বয়ানে। স্পষ্ট হয়ে যায়, উষ্ণতাপ্রত্যাশায় লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে গেলে মুছে দেওয়া হবে অতীতের যৎসামান্য উষ্ণতার স্মৃতিও। লক্ষ্মণরেখা টানার অন্তরালে কি বাইরের বিপদ থেকে সতর্ক করাই থাকে কেবল, ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার চেতাবনিও কি থাকে না?
‘দহাড়’-এর একেবারে শেষে, ধৃত সিরিয়াল কিলার বিন্দুমাত্র অনুতাপ না রেখে সেই হুঁশিয়ারিই ছুড়ে দিয়েছিল– ভালো মেয়েরা সীমা পেরোয় না। আচ্ছা, কেবল সীমা পেরোলেই কি মেয়েরা হারিয়ে যায়? আর যারা ‘ভালো মেয়ে’ এই গোত্রনামেই কেবল পরিচিত হতে থাকে, সেখানেও কি থাকে না আরেকরকম হারিয়ে যাওয়া? এ দেশে এমন অনেক হারিয়ে যাওয়ার গল্পই শুরু হতে গিয়েও কারও না কারও লাগাম টেনে ধরায় মুখ থুবড়ে পড়ে। সেই লাগামের গায়ে খোদাই করা থাকে ‘ভালো মেয়ে’ হয়ে ওঠার সহজ পাঠ। ‘লাপতা লেডিজ’-এ সেই অন্যরকম নিরুদ্দেশের ছক বুঝিয়ে দেয় মঞ্জু মাই– “ইয়ে দেশ মেঁ লড়কি লোগ কে সাথ হাজারো সালো সে ইক ফিরড্ চল রহা হ্যায়। উনকা নাম হ্যায়– ‘ভালে ঘর কি বহু বেটি’।” সে ছবিতেই ভালো মেয়েরা মুখ ঢেকে রাখে ঘোমটায়, তাই বউ বদলে যায় অনায়াসে। ভালো মেয়েরা হারিয়ে গেলেও স্বামীর নাম বলতে পারে না, জানে না নিজের ঠিকানাও। নন্দর মা কি দুলালী না প্রিয়বালা, সে কথাও তো ভুলে গিয়েছে সে! নিজের পরিচয় অবধি যাদের নিজেদের হাতে নেই, তারাও কি নিরুদ্দেশের তালিকায় নাম লেখায়নি? যারা নিজের প্রিয় খাবারের নাম বলতে জানে না, নিজের শখের কথা বলতে নেই বলেই ভাবে, তারাও কি নিজেদের অস্তিত্বকে মুছে ফেলেনি? ভালোবাসার নামে বিকিয়ে যাওয়া, তারপর হাতবদল কিংবা মরে যাওয়ার গল্প; কাজের নামে পাচার হয়ে যাওয়ার গল্প; এসব নাহয় ‘দহাড়’-এর দলিত মেয়েগুলোর জন্য বরাদ্দ। কিন্তু ‘ওরা’-ই খালি হারিয়ে যায়, আর ‘আমাদের’ ঘরের মেয়েরা হারায় না বুঝি? যে মেয়েদের বিয়ের পর উচ্চশিক্ষার পথ থেকে সরে আসতে হয় বা চাকরি ছাড়তে হয়, কেন-না ‘আমাদের’ ঘরের বউরা চাকরি করতে বেরোয় না; কিংবা ছেড়ে দিতে হয় নাচ কি নাটকের চর্চা, কেন-না ‘আমাদের’ (পড়ুন ভদ্র ঘরের) ঘরের মেয়ে-বউরা নেচে বেড়ায় না; সেও কি হারিয়ে যাওয়া নয়? আমরা ক’জন বন্ধুর মাকে, ক’জন প্রতিবেশিনীকে, সন্তানের ক’জন সহপাঠীর মাকে, ক’জন সহকর্মীর স্ত্রীকে অমুকের মা, তমুকের বউ, মিসেস অমুক না বলে তাঁদের নাম জানতে চেয়েছি? তাঁদের নিজের নামে মনে রেখেছি? সেও বুঝি হারানো নয়?
অপর পক্ষের বিস্মৃতিও যে আসলে মেয়েদের নানারকম ভাবে হারিয়ে যেতে দেয়, সে কথা হয়তো মেয়েদেরই জানা। যেমনটা জানেন সুধামাসি। কিংবা কে জানে, সে কথাও হয়তো ভুলেই গিয়েছেন তিনি, যেমনভাবে ‘প্রতিটি পুরোনো কথা/ ফের থেকে রোজ ভুলতে থাকেন/ ভুলে যান’। ভুলে যাওয়া তাঁর কাজ। যারা ফুল চেয়েছিল, তারা যে কবে কী চেয়েছে না ভেবেই চলে যায়, বলেও যায় না ‘আসি’, তাদের ভুলে না গেলে একা তিনি বাঁচবেন কেমন করে! অন্যের সেই বিস্মৃতির প্ররোচনায়, এক বিস্মৃতির মধ্যে ঢুকে পড়তে পড়তে তাই নিজের অনেকখানি অংশ হারিয়ে যেতে থাকে সুধাদের। একেবারে হারিয়ে যাওয়ার কোনও কোনও তথ্য কিংবা গল্প না হয় লেখা হয়, আরও কত নিরুদ্দেশ যে ঘোষণারও অপেক্ষা রাখে না, তার খতিয়ান কে রাখবে!
আসলে তো এদেশে ‘লাপতা’ হয়ে যাওয়াই মেয়েদের স্বভাব, কিংবা নিয়তি, যাই বলুন।