Robbar

কলাভবনের ‘নন্দন মেলা’ কিন্তু নন্দলাল বসুর নাম অনুসারে নয়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 27, 2023 9:09 pm
  • Updated:December 1, 2023 11:59 am  

দিনকর কৌশিকের নেতৃত্বে পরিকল্পনা হল কলাভবনে একটা আর্ট-ফেয়ার বা শিল্প-মেলা আয়োজনের। সেখান থেকে উঠে আসা টাকায় গড়ে তোলা হবে একটা ফান্ড। শিক্ষক ও ছাত্ররা এই প্রস্তাবে এককথায় রাজি। কিন্তু কী নাম হবে সেই মেলার? সর্বসম্মতিতে তার নাম হল ‘নন্দন মেলা’। সেই মতো ১৯৭৩ সালে সূচনা হল কলাভবন শিল্পমেলার। অনেকেই একে নন্দলাল বসুর নাম অনুসারে ‘নন্দমেলা’ বলে জানে। তা ঠিক নয়, এ হচ্ছে ‘নন্দন’ মেলা, ইংরেজিতে যাকে আমরা ‘aesthetics’ বলে থাকি। যদিও মেলার নামে শব্দের সাদৃশ্যে জড়িয়ে রইলেন নন্দলাল। মেলার আয়োজন হল তাঁরই জন্মদিনের পূর্ব মুহূর্তে।

সুশোভন অধিকারী

সাতের দশকের একেবারে শুরু। বছর পাঁচেক আগে কলাভবন অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন দিনকর কৌশিক। দিল্লি থেকে লখনউ আর্ট কলেজ, সেখান থেকে তিনি এসেছেন শান্তিনিকেতনে, ফিরেছেন তাঁর নিজের শিক্ষালয়ে। দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা বিশ্বভারতীর আচার্য ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে এসেছেন তিনি।

দিনকর কৌশিক। ছবি: সংগৃহীত

কলাভবনের সার্বিক জৌলুস তখন একটু যেন ম্লান। কিছুকাল আগে প্রয়াত হয়েছেন ‘মাস্টারমশাই’ নন্দলাল বসু। সর্বঅর্থেই সেই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। বিনোদবিহারী বা রামকিঙ্করের মতো দিকপাল শিল্পী সেখানে আছেন, তবে তাঁদের পক্ষে কলাভবনের ভার নেওয়া সম্ভব ছিল না। থাকার কথাও নয়। দিল্লিতে চোখে অস্ত্রোপচারের পর বিনোদবিহারী তখন দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছেন। আর উদাসী-বাউল রামকিঙ্করের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এমন নড়বড়ে সময়ে বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রীর অনুরোধে আরেক প্রাক্তনীর কলাভবনে যোগদান। কৌশিক এসে দেখলেন তাঁর দুই শিক্ষক– দেশের দুই বরেণ্য শিল্পী বিনোদবিহারী এবং রামকিঙ্কর আজীবন লেকচারার হয়ে রয়েছেন। অথচ অধ্যক্ষ হিসেবে কৌশিকের পদ ‘প্রফেসর’। মন তাতে সায় দিল না। তৎকালীন উপাচার্য কালিদাস ভট্টাচার্যকে জানালেন, দুই কিংবদন্তি শিল্পী তথা শিক্ষক বিনোদদা এবং কিঙ্করদা ‘প্রফেসর’ পদে উন্নীত না হলে তাঁর পক্ষে অধ্যক্ষের আসন গ্রহণ অসম্ভব। অতঃপর চিঠি লেখালিখি, দিল্লিতে দৌড়াদৌড়ি করে অবস্থা সামাল দেওয়া গেল বটে, তবে নানা দিক থেকে কলাভবনকে নতুন ভাবে নির্মাণ করতে কৌশিকের নিজের ছবি আঁকায় বাধা পড়ল। তবু হাল ছাড়লেন না তিনি। কলাভবনের বিভিন্ন বিভাগ সাজিয়ে তুলতে লাগলেন। গ্রাফিক বিভাগে নিয়ে এলেন সোমনাথ হোরকে, পরে সনৎ কর, চিত্রকলায় সুহাস রায়, ভাস্কর্য বিভাগে শর্বরী রায়চৌধুরী, এলেন অজিত চক্রবর্তী, শিল্প ইতিহাসে জয়ন্ত চক্রবর্তী প্রমুখ অধ্যাপক ক্রমে যোগ দিলেন। এমন মহাযজ্ঞের নেপথ্য কারিগর দিনকর কৌশিকের ভাবনায় কলাভবন পেল এক নতুন মাত্রা। পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যে নন্দলালের দুই কন্যা গৌরী ভঞ্জ, যমুনা সেন ও পুত্র বিশ্বরূপ বসু ছাড়াও রয়েছেন নন্দলালের ছায়াসঙ্গী অরুনাচল পেরুমাল, সুখময় মিত্র, ননীগপাল ঘোষ, প্রণব রায় প্রমুখ শিক্ষকবৃন্দ। অর্থাৎ নবীন আর প্রবীণে মিলিয়ে কলাভবন তখন জমজমাট, নিত্য নতুন কাজের প্রবাহে ঝলমল করছে! 

সেই সময় একটি ছাত্র ভাস্কর্যের কাজ করতে পায়ে হঠাৎ বড় রকমের আঘাত পেল। বিশ্বভারতীর হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা সেকালে ছিল না, আজকেও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এদিকে ছেলেটিকে দ্রুত কলকাতায় নিয়ে যাওয়া জরুরি। বিশ্বভারতীর অর্থদপ্তরে সাহায্যের প্রার্থনা নিষ্ফল হলে ঘনিয়ে উঠল দুশ্চিন্তার মেঘ। অবশেষে কলাভবনের শিক্ষক-ছাত্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে সে যাত্রা রক্ষা হল ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতের বিপদ আশঙ্কায় ভাঁজ পড়ল সবার কপালে। এ অবস্থায় কৌশিকের নেতৃত্বে পরিকল্পনা হল কলাভবনে একটা আর্ট-ফেয়ার বা শিল্প-মেলা আয়োজনের। সেখান থেকে উঠে আসা টাকায় গড়ে তোলা হবে একটা ফান্ড। শিক্ষক ও ছাত্ররা এই প্রস্তাবে এককথায় রাজি। কিন্তু কী নাম হবে সেই মেলার? সর্বসম্মতিতে তার নাম হল ‘নন্দন মেলা’। সেই মতো ১৯৭৩ সালে সূচনা হল কলাভবন শিল্পমেলার। অনেকেই একে নন্দলাল বসুর নাম অনুসারে ‘নন্দমেলা’ বলে জানে। তা ঠিক নয়, এ হচ্ছে ‘নন্দন’ মেলা, ইংরেজিতে যাকে আমরা ‘aesthetics’ বলে থাকি। যদিও মেলার নামে শব্দের সাদৃশ্যে জড়িয়ে রইলেন নন্দলাল। মেলার আয়োজন হল তাঁরই জন্মদিনের পূর্ব মুহূর্তে। ১ ও ২ ডিসেম্বর এই দু’দিন সন্ধেবেলায় মেলা বসবে, আর ৩ তারিখ ‘মাস্টারমশাই’য়ের জন্মদিনে কোপাইয়ের ধারে কলাভবনের নতুন-পুরনো প্রত্যেকে মিলে চড়ুইভাতি। হিসেব করে দেখলে বিগত ৫০ বছর সেই ধারা আজও চলে আসছে। 

একবার পিছন ফিরে দেখা যাক, প্রথমবারের ‘নন্দন মেলা’ কীভাবে সেজে উঠেছিল। খাতাকলমের হিসেবে নন্দনমেলার প্রথম বৈঠকে শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ দিনকর কৌশিক, সুখেন গাঙ্গুলি, অজিত চক্রবর্তী এবং সোমনাথ হোর। অধ্যক্ষ ছাড়া বাকি সকলেই বিভাগীয় প্রধান হিসেবে, তা ছাড়া জনাসাতেক ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনায় গড়ে ওঠে প্রথম নন্দনমেলার রূপরেখা। পরে যুক্ত হয়েছেন শিল্পইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক কাঞ্চন চক্রবর্তী, চিত্রবিভাগের সুখময় মিত্র এবং ক্র্যাফট বিভাগের ননীগোপাল ঘোষ প্রমুখ। আসলে কেবলমাত্র চিত্রকলা, ছাপাই ছবি আর ভাস্কর্যই নয়– নন্দনমেলাকে সবদিক থেকে সম্পূর্ণ করে তুলতে শিল্প-ইতিহাসের প্রকাশনা এবং ক্র্যাফটের ভূমিকা কিছুমাত্র কম নয়। পাশাপাশি এই ধরনের মেলার অন্যতম আকর্ষণ চা-কফি আর মুচমুচে খাবার। খাবারের ছোটখাটো পসরা না থাকলে কোনও মেলাই জমে না। তাই বাদ দিলে রইল না তারাও।

নন্দন মেলার মিটিংয়ের খাতার ছবি। সৌজন্য: লেখক

সেবারের মেলায় নন্দলালের কন্যা যমুনা দায়িত্ব নিলেন খাবার-দাবারের ব্যাপারে। সোমনাথ হোর ছাপাই ছবির প্রিন্ট, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি, সুখেন গাঙ্গুলির দায়িত্বে রইল সরাচিত্র, টেক্সটাইল-ক্যালেন্ডার, ল্যাম্প-শেড ইত্যাদি কাজ। ননীগোপাল বাটিক, বাঁধনি ফেব্রিক ও আরও অন্যান্য দিকে, অজিত চক্রবর্তী নিলেন খেলনা ও ছোটখাটো ভাস্কর্যের দায়িত্ব। সুষেণ ঘোষ ক্যাম্পাসকে অস্থায়ী ভাস্কর্যে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন, পেরুমাল নিলেন ফিল্ম-শো আর মেলার সন্ধেকে সংগীতের মূর্ছনায় ভরিয়ে দিলেন শর্বরী রায়চৌধুরী। এভাবেই প্রথমবারের নন্দনমেলা শিল্পে-সংগীতে মুখর হয়ে উঠল। সুচিত হল কলাভবনের এক নবতর অধ্যায়ের, যেখানে স্বল্পমূল্যে সকলে বিশিষ্ট শিল্পী থেকে ছাত্রদের শিল্পকাজ সংগ্রহ করতে পারবে। প্রথমবারের মেলা থেকে কতটা অর্থ সংগ্রহ হয়েছিল জানা নেই, তবে সর্বক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, সেদিন থেকে কলাভবন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে।