Robbar

বিজ্ঞাপন কিংবা হোর্ডিং মুক্ত হলে আকাশ দেখার চোখটাও ফিরে পাব তো আমরা?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 5, 2024 9:11 pm
  • Updated:May 5, 2024 9:21 pm  

কলকাতা পৌরসভা সম্প্রতি একটি নীতি প্রণয়ন করতে তৎপর। শহর বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং মুক্ত হোক— তারা এমনটাই চায়। যেন আকাশ ফিরিয়ে দিতে চাইছে এতদিন পরে। খোলা একটা আকাশ দেখতে পাব আমরা। আকাশ আছে বলেই মাটির দিকে তাকাতে হয় আমাদের। মাটিও যেভাবে অধিকার করেছি, আকাশের অধিকার পেতে বিজ্ঞাপনে ঢেকেছি গোটা কলকাতা শহর। মনুষ্যপ্রবৃত্তি কি না! ভয় হয়। বিজ্ঞাপন কিংবা হোর্ডিং মুক্ত হলেই সে আকাশ দেখব আমরা? মাথা উঁচিয়ে? নাকি যে সঙ্কীর্ণতার ভেতর প্রবেশ করেছি, সেখানেই বাস করব আজীবন?

রোদ্দুর মিত্র

একটা আধখাওয়া আকাশ কলকাতার মাথায়। প্রকাণ্ডকায় যত বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং! সেইসবে অনর্গল গোঁত্তা খাচ্ছে বাতাস। গোঁত্তা খেল দৃষ্টি। দৃশ্যের জন্ম– এই শহরে তাই হচ্ছে না আর। যা হচ্ছে, কেবলই দূষণ। এক পা হেঁটে পানমশলার বিজ্ঞাপন। দু’-কদম হাঁটলে আলিয়া ভাটের মসৃণ পিঠ। তিন পা ফেলার পরে, মুখ তুলতে সাধ হবে না। কারণ আপনি ভুলেই গেছেন শেষ কবে একটা নিরবচ্ছিন্ন আকাশ দেখেছিলেন! অর্থাৎ, শুধুই আকাশ। বিপুল। নিখাদ। এবং অ্যাবসোলিউট!

বিজ্ঞাপন যে শহরের মুখ ঢেকেছে– এ আমরা জেনেছি অনেক দিনই হল। আমরা বুঝেছি একবিংশ শতাব্দীতে, বেঁচে থাকার জন্যেও বিজ্ঞাপন দেওয়া আবশ্যিক। নইলে প্রতিযোগিতায় হেরে যেতে হয়। সে থিয়েটারই হোক কিংবা কোল্ডক্রিম– আসলে বেচতে হবে। সাধারণের নজর কেড়ে, সেঁধিয়ে যেতে হবে হৃদয়ের প্রতিটি প্রকোষ্ঠে। কিন্তু কতদিন? সে বিজ্ঞাপনের মায়ার স্থায়িত্ব ঠিক কতখানি? চিরস্থায়ী নয় নিশ্চয়ই! হামেশাই দেখি, চার, পাঁচ এমনকী, দশ বছরের পুরনো টেলিভিশন কোম্পানির ছেঁড়াফাটা বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং হাওয়ায় উড়ছে। কোম্পানির হালহকিকতও তেমন! যেদিন দুম করে ভেঙে পড়ে, সেদিন খেয়াল হয়– দৃশ্যদূষণ! মাঝআকাশে জুতোর দামড়া হোর্ডিং। সারি সারি ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ঝুলছে একজন ভদ্রলোক। সকলকে জিজ্ঞেস করছেন, টুথপেস্টে নুন আছে?

Hoardings | Illigal Hoardings are still a big problem in Kolkata city - Anandabazar
বিজ্ঞাপনে ঢাকা একটুকরো কলকাতা। ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আকাশ বেয়ে সামান্য উঠেই, তখন মহাকাশ। চারিদিকে অন্ধকার। আশ্চর্য শূন্যতা! দূরে হয়তো গেয়ে উঠতেন অঞ্জন দত্ত। দেখো ডাকছে তোমায় বন্ধুরা আকাশ থেকে/ টিভি দেখো না… নিজস্ব দর্শনকে টিভি, বর্তমানে স্মার্টফোনের চৌখুপিতে সংকুচিত না করে, মুক্ত করে দেওয়া! আকাশ তো সে কথাতেই মেঘ ভাসিয়েছে এতদিন। হে পাঠক, শহর থেকে কুৎসিত বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং সরে যাবে দ্রুতই। নিজের দৃষ্টিকে আকাশমুখী করে দেখুন একবার!

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

কলকাতা পৌরসভা সম্প্রতি একটি নীতি প্রণয়ন করতে তৎপর। শহর বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং মুক্ত হোক– তারা এমনটাই চায়। যেন আকাশ ফিরিয়ে দিতে চাইছে এতদিন পরে। বোধ করি আমাদের সকলেরই দেখার মতো একটা আকাশ ছিল। বিস্ময় ছিল। যে আকাশে টর্চের আলো ফেলে ‘কালপুরুষ’ চিনিয়েছিল বি.এসসি মাস্টারমশাই। মনে পড়ছে শঙ্খ ঘোষের ছোট্ট একটা স্কুল:

–‘এই যে আলোটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওই তারাটা সেটা পাঠিয়েছে চার বছর আগে? জিজ্ঞেস করি আমরা।

–চার বছর তো কম। বলেন আমাদের বি.এসসি মাস্টারমশাই: আরও বহু বহু বছর আগে আলো পাঠিয়েছে আরও কত তারা!’

আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকা ছিল। একলা কোনও ছাদে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন হারিয়ে যেত কেউ, টের পেত সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় কত ক্ষুদ্র, নিতান্তই একটি পরমাণুসুলভ এ মানবশরীর। অস্তিত্বও আসলে কত ঠুনকো!

কলকাতার জলছবি / Photos Of Old Kolkata & The Stories

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: রাজনৈতিক ইস্তাহারে পরিবেশ কেন ব্রাত্য?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আকাশ বেয়ে সামান্য উঠেই, তখন মহাকাশ। চারিদিকে অন্ধকার। আশ্চর্য শূন্যতা! দূরে হয়তো গেয়ে উঠতেন অঞ্জন দত্ত। দেখো ডাকছে তোমায় বন্ধুরা আকাশ থেকে/ টিভি দেখো না… নিজস্ব দর্শনকে টিভি, বর্তমানে স্মার্টফোনের চৌখুপিতে সংকুচিত না করে, মুক্ত করে দেওয়া! আকাশ তো সে কথাতেই মেঘ ভাসিয়েছে এতদিন। হে পাঠক, শহর থেকে কুৎসিত বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং সরে যাবে দ্রুতই। নিজের দৃষ্টিকে আকাশমুখী করে দেখুন একবার! মনেই থাকবে না অন্যের ফ্রিজে উঁকি দিয়ে গোমাংস খোঁজার কথা।

শৈশবে আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঘুমনো ছিল অভ্যেস। আমাদের সে আনন্দ ঢেকে দেয়নি কখনও কোনও হোর্ডিং। বড় হয়ে বরং কিঞ্চিৎ বিষাদ মিশিয়ে দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসের নায়ক, হেম ও তাঁর মায়ের সংলাপ মনে পড়ছে:

–‘কিন্তু তবুও আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে!’

–‘কার? তোমার? কেন?’

–‘…আউটরাম ঘাটে বেড়াতে গিয়ে সন্ধ্যার সোনালি মেঘের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করে; মনে হয় আর যেন পৃথিবীতে ফিরে না আসি।’

আকাশের ধারণা হঠাৎই কেমন বদলে গেল। আকাশের মতোই, এরপর সে ধারণা হতে শুরু করল অসীম। বহুমুখী। এরপরই নবারুণ ভট্টাচার্য ‘লুব্ধক’ উপন্যাসে লিখছেন, কলকাতা শহরের ওপর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্ববৃহৎ কুকুরটিকে। সে নেমে আসবে আকাশ থেকে।

Shyambazar - Wikipedia

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আরও পড়ুন: নতুন প্রেম আসে যখন, তখনও লোডশেডিংই পরিত্রাতা

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

আনন্দ। বিষাদ। নৈরাজ্য। বিপ্লব। প্রত্যেকটির সঙ্গে অমোঘভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের আকাশ। আমাদের মন যে সময়ে মুক্ত ছিল, ক্লেদ ছিল না বোধে; আকাশও হয়তো সে সময় আস্তই ছিল। ছিল না দৃশ্যদূষণ। কলকাতা পৌরসভা বলছে, শহরকে ভাগ করা হয়েছে তিনটি ভাগে। প্রথমটি ‘নো-অ্যাডভারটাইজ জোন’। দ্বিতীয়টি ‘প্রাইভেট হোর্ডিং ফ্রি জোন’। অর্থাৎ, যেখানে থাকবে শুধুমাত্র সরকারি বিজ্ঞাপন বা হোর্ডিং। আর সর্বশেষ, ‘গ্রিন জোন’। পৌরসভার অনুমতি ছাড়া যে অঞ্চলে বিজ্ঞাপন বা হোর্ডিং নিষিদ্ধ।

ভাড়ায় বসবাসের জন্য কলকাতার সবচেয়ে সস্তা এলাকা | কলকাতায় সাশ্রয়ী মূল্যের এলাকা

খোলা একটা আকাশ দেখতে পাব আমরা। আকাশ আছে বলেই মাটির দিকে তাকাতে হয় আমাদের। মাটিও যেভাবে অধিকার করেছি, আকাশের অধিকার পেতে বিজ্ঞাপনে ঢেকেছি গোটা কলকাতা শহর। মনুষ্যপ্রবৃত্তি কি না! ভয় হয়। বিজ্ঞাপন কিংবা হোর্ডিং মুক্ত হলেই সে আকাশ দেখব আমরা? মাথা উঁচিয়ে? নাকি যে সংকীর্ণতার ভেতর প্রবেশ করেছি, সেখানেই বাস করব আজীবন? অকারণেই সহনাগরিকের গায়ে উগড়ে দেব ঘেন্না? নাকি মহাকাশ অধিকারের লক্ষ্যে পাড়ি জমাব আর জিভ দিয়ে লালা ঝরবে অবিরাম?

হয়তো আকাশের দিকে তাকাব না। আমাদের মনোযোগের স্থিতিকাল তিরিশ সেকেন্ড পেরবে না। যদি পেরতে পারি, তবে নিশ্চিত দেখতে পাব অগাধ গমক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। অদ্ভুত সমস্ত রেখায় রেখায় আসলে এঁকে চলেছেন একটিমাত্র আকাশ। রাতের মায়া-আকাশ। যা ঢেকে দেওয়ার সাধ্যি নেই কোনও বিজ্ঞাপনের। হোর্ডিং-এর।