অভিভাবক হওয়া, একটি সন্তানের দায়িত্ব, মানুষের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়– এর চেয়ে বেশি ‘বিশ্বজনীন’ কথা বোধহয় আর হয় না। আমি প্রথম মা হই পঁচিশ বছর আগে; আমেরিকা প্রবাসী, আত্মীয় পরিজনবিহীন জীবনে, গুগল তখনও মানুষের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর নিয়ে উপস্থিত হয়নি। মনে আছে, তখন ‘হোয়াট টু এক্সপেক্ট হোয়েন ইউ আর এক্সপেক্টিং’ নামের বইটি ছিল হাতের কাছে। গর্ভাবস্থায় কত দিন কাজ করা যায়, সামুদ্রিক মাছ খাওয়া ঠিক কি না, সাইকেল চালানো যায় কি না, কতবার আল্ট্রা সাউন্ড পরীক্ষা বাচ্চার জন্য নিরাপদ– সম্ভাব্য, অসম্ভাব্য কত যে প্রশ্নের উত্তর ছিল তাতে, কত আশঙ্কা কমাত, প্রত্যেকটি স্টেজের জন্য আগাম প্রস্তুতি তৈরী করে দিতো সে বই। এই বই ভাবী মা-বাবাদের কাছে ছিল প্রাণদায়ী, সঠিক অর্থেই একে বলা বলা হত ‘প্রেগন্যান্সি বাইবেল’। এরপরে এল মা এবং তার সঙ্গে সন্তানের জন্মের সময় যিনি পাশে থাকবেন, তাঁদেরকে জন্মদানের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রস্তুত করার ক্লাস। সেটা কলকাতায় আমাদের দুই পরিবারের কাছে ছিল এক বিরাট চর্চার বিষয়! বাচ্চা হওয়ার প্রস্তুতি ক্লাস? কিন্তু সন্তান হওয়ার পরেও দেখলাম হাসপাতালে ভিডিও দেখিয়ে, হাতে-কলমে ট্রেনিং দিয়ে অনেকখানি তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়; মা-বাবা বাড়ি ফিরে নিজেদের সন্তানকে দেখাশোনার ভার যাতে নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন। এটা ব্যক্তিগতভাবে আমি পরবর্তীকালে বুঝেছি, এই শিক্ষাটা থাকলে, একটা পথ নির্দেশ থাকলে, নতুন অভিভাবকদের বেশ খানিক সুবিধাই হয়। কারণ সন্তানরা কোনও ম্যানুয়াল নিয়ে আসে না। বহু মানুষের নানা ধরনের অভিজ্ঞতা, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞদের অভিমত জানা থাকলে, সেই সূত্রগুলো বই বা ইন্টারনেট যে কোনও বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমে পাওয়া যাক, তা কিন্তু অভিভাবকদের অনেকখানি সাহায্য করে।
এটা তো শুধু জন্মের কথা। তার পর তো সন্তানরা বড় হয়। আর তারা বড় হচ্ছে এমন একটা পৃথিবীতে, যেটা আমরা ২০ বছর আগে কল্পনাও করতে পারতাম না। গত ১০-১৫ বছরে ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়ার বিস্ফোরক উন্নতির ফলে মানুষের কাছে পৃথিবীর সংজ্ঞাই পাল্টে গিয়েছে।এখন যে বাচ্চারা বড় হচ্ছে, বিশেষত শহরে, টেকনোলজি তারা জন্ম থেকে দেখে, টেকনোলজি তারা শেখে এবং প্রয়োগ করে আমাদের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি। এক স্ক্রিন থেকে আর এক স্ক্রিন– ভার্চুয়াল পৃথিবীই তাদের বেশিরভাগ পৃথিবী। একটা বয়স পর্যন্ত সন্তানদের অনেক কিছু আমাদের আয়ত্তাধীন থাকলেও যখন তারা বড় হয়, নিজেদের স্কুলের চাপ, দায়িত্ব নিজেরা নিতে শুরু করে কিন্তু নিজেদের সমস্যা প্রকাশ করতে পারে না– কারণ তারা ভাবে আমরা তাদের সমস্যা বুঝবো না, তাদের ওপর রাগ করব অথবা শাসন করব। আর আমরাও অনেক সময়ই আমাদের সন্তানদের নিয়ে কোনও আশঙ্কা হলে, দুশ্চিন্তা হলে, অভিযোগ জমা হলে, তাদেরকে বুঝতে না পারলে, অন্য কারও সঙ্গে সেটা ভাগ করে নিতে পারি না। কখনও আমাদের মনে হয় আমাদের সন্তানদের, আমাদের চেয়ে বেশি কে চিনবে? তাদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে না পারাটা আমাদের কাছে অবমাননাকর। অন্যদিকে চারপাশে এত ভালো রেজাল্ট, গান, নাচ, খেলাধুলা– সব কিছুতে এত সাফল্যের মধ্যে আমার সন্তানের শিক্ষাগত বা মানসিক কোনও সমস্যা হলে তা বলাটা আমাদের নিজেদের কাছে হার মনে হয়। এরকম সংকটে আমরা পথ খুঁজে পাই না। নিজেদেরকে অসম্ভব অসহায় মনে হয়।
বাচ্চা যখন বড় হতে থাকে,তখন যে কোনও পরিস্থিতি বা সমস্যায় আমরা যদি স্কুলের কাছ থেকে সাহায্য পাই, তার চেয়ে ভালো কিন্তু কিছু হতে পারে না। কারণ বাচ্চারা দিনের বেশিরভাগ সময় কাটায় স্কুলে।
আমি আমেরিকার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে একদিকে বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে এবং অন্যদিকে অভিভাবকদের জায়গায় থেকে দেখে এসেছি যে, আমার রাজ্য ম্যাসাচুসেটসের পাবলিক স্কুলে এবং আমেরিকার বেশিরভাগ জায়গাতে স্কুলে অভিভাবকদের প্রাধান্য যথেষ্ট। যেহেতু বেশি শিক্ষার্থীরা নিজেদের শহরের পাবলিক স্কুলে যায়, সেই স্কুলের ভালো-মন্দের ব্যাপারে শহরের অভিভাবকদের একটা দায়িত্ববোধ থাকে। সেই কারণে ছোটবেলায় বিশেষতঃ এলিমেন্টারি এবং মিডল স্কুলে একটি বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর পর তার অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের যথেষ্ট নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। যে কোনো বিষয়ে অথবা সমস্যায়, শিক্ষক, অভিভাবক এবং অনেক ক্ষেত্রে এডমিনিস্ট্রেটর এরা একত্রিত হয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। ধরা যাক, এমন কোনও পারিবারিক ঘটনা বা সমস্যা হয়েছে যা বাচ্চার ওপর প্রভাব ফেলছে, সেটা অনেকসময়ই বাড়ি থেকে স্কুলে জানানো হয় যাতে স্কুলে বাচ্চাটি সাপোর্ট পায়। অবশ্যই সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে। ক্লাসের সিলেবাস থেকে শুরু করে, ফিল্ড ট্রিপ, প্রজেক্ট, কোনও বিশেষ ব্যক্তিত্ব স্কুল পরিদর্শন করতে এলে– এরকম অজস্র খুঁটিনাটি বিষয় অভিভাবকদের আগাম জানানো হয়। কোনও বিষয়ে তাদের ব্যক্তিগত আপত্তি থাকলে সেটা শোনা হয়। অবশ্য হাই স্কুলে যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশি, এ সমস্ত কিছু করা সম্ভব হয় না। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য গাইডেন্স কাউন্সিলর, সাইকোলজিস্ট যেমন থাকেন তেমন পড়াশোনায় সমস্যা হলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলের নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে থেকে সাহায্য করেন। আর বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা তো অনেকখানি আসে স্কুল থেকেই। যে কোনও বয়সেই। তাদের ছোট-বড় সমস্ত সমস্যায় সাহায্য করার জন্য একজন, দু’জন নয়– থাকে একটি টিম।
তবে হ্যাঁ, এই সমস্ত চেষ্টা, মনোযোগ এর মধ্যেও অনেকখানি ব্যবধান থাকে, তাই একটি আপাতদৃষ্টিতে শান্ত, ভালো ছাত্র হাতে বন্দুক তুলে নেয় এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার চেষ্টা করে জেনে, যে সেখানে তার জীবনটাও শেষ হবে। অনেক সময়ই বয়ঃসন্ধিতে ছেলেমেয়েরা কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা অভিভাবকরা বুঝতে পারি না। মনে হয় যদি কোনও সাহায্য থাকত।
ঠিক এই সমস্ত বিষয় মাথায় রেখে কেরল সরকার একটি মৌলিক আর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তারা ভারতে সর্বপ্রথম প্রকাশ করছেন একটি ‘পেরেন্টিং হ্যান্ডবুক’, যা পৌঁছে যাবে রাজ্যের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর পরিবারে। স্টেট কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ডক্টর জয়প্রকাশের মতে, শিক্ষাপদ্ধতিকে একটি ত্রিভুজের সাথে তুলনা করলে ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষক এবং অভিভাবকরা যদি তার তিনটি বিন্দুতে থেকে পরস্পরকে সাহায্য করে, তাদের মধ্যে সম্প্রীতি থাকে, বোঝাপড়া থাকে তাহলে শিক্ষাপদ্ধতি একটা অন্য মাত্রা পায়। অভিভাবকরা যাতে এই নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তাদের জন্য এই চারটি হ্যান্ডবুক যা প্রাইমারি স্তর থেকে স্কুলের শেষ বছর পর্যন্ত সমস্ত স্তরের ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকদের জন্য করা হচ্ছে, একটি রোড ম্যাপের মতো, যাতে তারা তাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠার প্রতিটি স্তরে তাদেরকে বুঝতে পারেন, তাদের সাহায্য করতে পারেন। তবে শুধুমাত্র পড়াশোনা নয়, মানসিক স্বাস্থ্য, তাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস এবং জীবনযাত্রা– এই সমস্ত কিছুর দিশা পাওয়া যাবে এই বইগুলোতে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের বাচ্চাদের সমস্যাও বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ড্রাগ যেমন সমস্যা, তেমনই অনলাইন অ্যাডিকশন। সাইবার ক্রাইম, সাইবার বুলিং এবং বিশেষভাবে মানসিক অবসাদ এখন সারা পৃথিবীতে। কীভাবে বুঝবেন মা-বাবারা এই সমস্যাগুলো? কীভাবে লড়বেন এদের বিরুদ্ধে, যাতে তাদের সঙ্গে বাচ্চাদের সম্পর্ক নষ্ট না হয়ে যায়? তাই মা-বাবাদের হাতে যদি এমন মূল্যবান তথ্য আসে যা গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সহজ ভাষায়, তাদের সন্তানদেরকে বুঝতে সাহায্য করে, তাদের সার্বিক বিকাশের দিকে নজর রাখতে পারে, তাদের সমস্যা বুঝতে পারে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে এবং এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অভিভাবকরা যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষা ত্রিভুজের একটি সবল দিক হয়ে উঠতে পারেন,তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?