১৯৪৭ সালের ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রস্তাব পাশ হয়। তাই এই দিনটি ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসাবে চিহ্নিত করার কথা উঠেছে। কিন্তু এই দিনটির সঙ্গে যে জড়িয়ে রয়েছে দুই বাংলার আবেগও। বাংলা ভাগ এ রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছেও শোকের। যে শোক আত্মীয় বিয়োগের, পরিবার ভেঙে যাওয়ার। এমন যন্ত্রণা জড়িয়ে থাকা একটা দিন কি সত্যিই হতে পারে উৎসবের?
আগে বাঙালি, পরে ভারতীয়– এমন বললে অনেকেরই দেশপ্রেমে ধাক্কা লাগতেই পারে। কিন্তু নিজের রাজ্যকে বাড়তি গুরুত্ব দিলে ক্ষতিটা কী? আর এক-একটা রাজ্যের নিজস্ব পরিচয়, জীবনধারণ, শিক্ষা-সংস্কৃতি সব মিলিয়েই তো এই দেশ। প্রতিটি রাজ্য আলাদা, আবার কোথাও গিয়ে সবাই এক। এত কথা বলতে হল এইজন্যই যে, নিজের রাজ্যকে এগিয়ে রেখে, এখানকার নিজস্ব বাসিন্দাদের কথা বলতে গেলেই কেউ কেউ এমন প্রাদেশিকতার ছাপ মেরে বিভ্রান্ত করতে উঠে-পড়ে লাগে, যেন মহান ঐতিহ্যে আমিই টোল ফেলে দিলাম!
তাই আর বিলম্ব নয়। এখনও আছে সময়।
এই যে পশ্চিমবঙ্গের একটি নিজস্ব দিন হওয়া নিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, ইতিউতি আলোচনা চলছে, নিজস্ব সংগীত বেছে নেওয়া নিয়েও কথা চলছে, তা তো অন্য সব রাজ্য কবেই করে ফেলেছে। আমরাই বরং দেরি করে ফেললাম বলে মনে হচ্ছে। যদিও বেটার লেট দ্যান নেভার। অবশেষে রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব এসেছে শাসকদলের পক্ষ থেকে। তাদের মত, শুধু একটি নির্দিষ্ট তারিখই নয়, বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে একটি গানও নির্বাচন করতে হবে। কীভাবে কী করা যায়, তার জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস নির্বাচন কমিটি’। সেই কমিটি প্রস্তাব পেশ করেছে। পয়লা বৈশাখে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ করার বিষয়ে এগোনো হচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত কিছুই হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে সর্বদল বৈঠক করে সকলের মতামতও নিয়েছেন। আরও মতামত কাঙ্ক্ষিত। তার জন্যও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তার পরই বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করে আনুষ্ঠানিক দিন ও সংগীত নির্ধারিত হবে।
কিন্তু এতদিন হয়নি কেন? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আসলে এমনটা করতে হবে, এটাই হয়তো আগে কেউ ভাবতে পারেননি। বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাপারটা রাজনৈতিকভাবে এমন পাকিয়ে উঠছে যে, এবার তারই সলতে পাকানোর কাজ শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার একটি বিশেষ দিন, ২০ জুনকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি বলেই খবর। সেই হিসাবে রাজ্য সরকারিভাবে না হোক, রাজ্যপাল রাজভবনে দিনটিকে পালন করেছেন। কিন্তু হঠাৎ ২০ জুনই কেন? কেনই বা তা চাপিয়ে দেওয়া হবে রাজ্যের ঘাড়ে? প্রশ্ন উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী চিঠি দিয়ে তা জানতেও চেয়েছেন রাজভবনের কাছে। কিন্তু অবাক কাণ্ড! নীরবতা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি।
এমন পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে বিভিন্ন কারণে। কোথাও যেন একটা কেন্দ্রীয় সরকারের চাপিয়ে দেওয়া, জোর করার রাজনীতি চলছে, সেটা বুঝতে বাকি নেই আর। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রস্তাব পাশ হয়। তাই এই দিনটি পালন করার কথা উঠেছে। ভাল কথা। কিন্তু শুধু প্রতিষ্ঠা দিবসই তো নয়, এই দিনটির সঙ্গে যে জড়িয়ে রয়েছে দুই বাংলার আবেগও। বাংলা ভাগ এ রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছেও শোকের। যে শোক আত্মীয় বিয়োগের, পরিবার ভেঙে যাওয়ার। এমন যন্ত্রণা জড়িয়ে থাকা একটা দিন কি সত্যিই হতে পারে উৎসবের? আলাদা হয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনও আনন্দ নেই, সেটা বোধহয় কেন্দ্রের গোচরে আসেনি। আসার কথাও নয়। ইতিহাস জানলেও তার প্রতি আবেগে গদগদ কেউ না-ই হতে পারে। কিন্তু কাঁটাতার লাগলে ক্ষত হতে বাধ্য। আর সেই ক্ষতটা কত গভীর, সেটা জানতে পুঁথির পাতা যথেষ্ট নয়।
সাধারণভাবে রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দিনটাকেই রাজ্যের দিবস বলে ঘোষণা করার একটা রীতি রয়েছে। অন্তত অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচল, বিহার, ছত্তিশগড়, গোয়ার মতো বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দিবস থাকলেও একাধিক রাজ্যের অবশ্য সে সবের বালাই নেই। অসম, মণিপুর, পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের তেমন কোনও নিজস্ব দিন নেই। জেনে রাখা ভাল, অসমই প্রথম রাজ্য, যারা ১৯২৭ সালে তাদের নিজস্ব গান গ্রহণ করেছিল। অহমিয়া ভাষায় লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার লেখা ‘ও মুর আপনার দেশ’ গানটি কম্পোজ করেছিলেন কমলাপ্রসাদ আগরওয়াল। তারপর এমনই নিজস্ব রাজ্য-সংগীত করে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার। স্বাধীনতার ন’বছর পরে ১৯৫৬ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার তেলুগু ভাষায় শঙ্করামবাদী সুন্দরাচারীর লেখা ‘মা তেলুগু থাল্লিকি’ বা ‘আমাদের মা তেলুগু’ গানটিকে রাজ্যের গান বলে গ্রহণ করে। বর্তমানে দেশের ১২টি রাজ্যে অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড়, গুজরাত, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, মণিপুর, ওড়িশা, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু এবং উত্তরাখণ্ডে নিজস্ব সংগীত রয়েছে। ২০০৪ সালে কর্নাটক, ২০০৭ সালে পুদুচেরি, ২০১০ সালে মধ্যপ্রদেশ, ২০১১ সালে গুজরাত, ২০১২ সালে বিহার, ২০১৬-তে উত্তরাখণ্ড, ২০১৯-এ ছত্তিশগড়, ২০২০-তে ওড়িশা, ২০২১-এ মণিপুর এবং তামিলনাড়ু নিজস্ব সংগীত চালু করে। এ বছরই মহারাষ্ট্র সরকারও তাদের নিজস্ব সংগীত ঘোষণা করেছে।
তাই এমন একটা দিন বেছে নেওয়া যাবে না, যে দিনে কোনও দুঃখের স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে। যেদিনে বিষণ্ণতার সুর উৎসবের তাল কেটে দেব। অন্য দিন হোক না বরং। যে দিন নিয়ে আসবে আনন্দের বার্তা। মাঠে নতুন ধান ওঠার মতো গন্ধ, বর্ষার জলে পাতা ধুয়ে সবুজ হয়ে ওঠার মতো রং, নীল আকাশে মেঘের ঘুরে বেড়ানোর মতো স্বাধীনতা থাকবে তার মধ্যে। এমন দিন যদি হয় ১ বৈশাখ? বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটির সঙ্গে বাঙালির, পশ্চিমবঙ্গের আবেগ-ভালবাসা জড়িয়ে রয়েছে। আপাতত দিনটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এবার যদি নির্দিষ্ট দিন বা নিজস্ব সংগীত বেছে নেওয়া না হয়, তাহলে বোধহয় চাপিয়ে দেওয়াই হবে!