গ্রহদের প্যারেড। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। প্যারেড। নবগ্রহের, ও না! , অষ্টগ্রহের (প্লুটো তো ত্যাজ্যপুত্র!) ছ’টি গ্রহ একসঙ্গে এক সারিতে হাজির হবে। এই হাফ ডজন গ্রহ-মহোৎসবে উপস্থিত থাকবে বুধ, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস আর নেপচুন। এ দৃশ্য দেখা যাবে ৩ জুন, ২০২৪। রাতের কিনারে। বলা ভালো, খুব ভোরে। রবিঠাকুর যাকে বলতে পারতেন ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে…’।
শঙ্খ ঘোষের ‘ছোট্ট একটা স্কুল’-এর ‘রাত্রিবেলার ক্লাস’ মনে পড়ে? ‘হেডমাস্টার মশাই বলে দিয়েছেন, গ্রহনক্ষত্র অধ্যায়ের ক্লাস করতে হবে আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, ক্লাসঘরের মধ্যে থেকে নয়।… একদিন যখন জানিয়ে দিতেন মাস্টারমশাই, আজ তোমাদের নাইটক্লাস, ঝাঁপ দিয়ে উঠত মন, খুশিতে। তারায় তারায় দীপ্ত শিখার আগুন জ্বলে আছে। আর মাস্টারমশাই তাঁর মস্ত সেই টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আকাশের দিকে মুখ করে, তাঁকে ঘিরে আমরাও ঊর্ধ্বমুখী।… ওই হল ক্রতু, ওই পুলহ, তারপর পুলস্ত্য অত্রি অঙ্গিরা বশিষ্ঠ মরীচি। আকাশের সব তারারই জায়গা পালটে পালটে যায়, কেবল ওটাই থেকে যায় স্থির, অনড়। তাই ওর নাম ধ্রুব।… তারায় ভরা মস্ত ওই খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবতাম তখন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝখানে আমরা তাহলে কতটুকু? নিজেদের এই অণুত্বের বোধ নিয়ে ফিরে আসতাম নিজের নিজের ঘরে, সারা গায়ে নাইটক্লাসের মহিমা মেখে নিয়ে।’
রাতের আকাশ তো কল্পলোকের তেপান্তর। তারায় তারায় ঘুরে বেড়ায়নি এমন শৈশব খুঁজে পাওয়া ভার। একটু বড় হতেই কল্পলোকের কোটরে বিজ্ঞান এসে ঘাপটি মেরে বসে। মহাকাশের বাসিন্দা অচেনা জ্যোতিষ্করা আমাদের চেনা পড়শি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। তাদের গতিবিধি, হাবভাব হিসেব কষে বলে দেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাতেও কি আর অপুর চোখে বিস্ময়ের ঘোর কাটে! মহাবিশ্বের টান যে অমোঘ। তার পরতে পরতে চমক। এই যেমন ধরুন না, সামনেই আছে গ্রহদের প্যারেড। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। প্যারেড। নবগ্রহের, ও না! , অষ্টগ্রহের (প্লুটো তো ত্যাজ্যপুত্র!) ছ’টি গ্রহ একসঙ্গে এক সারিতে হাজির হবে। এই হাফ ডজন গ্রহ-মহোৎসবে উপস্থিত থাকবে বুধ, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস আর নেপচুন।
এ দৃশ্য দেখা যাবে ৩ জুন, ২০২৪। রাতের কিনারে। বলা ভালো, খুব ভোরে। রবিঠাকুর যাকে বলতে পারতেন ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে…’। উত্তর গোলার্ধের মানুষ নানা জায়গা থেকেই এ দৃশ্য চাক্ষুষ করতে পারবেন। সময়ের রকমফের হতে পারে। আমেরিকায় ৩ জুন দেখা গেলেও ব্রাজিলে দেখা যাবে ২৭ মে থেকেই, মেক্সিকোতে ২৯ মে, এবং এথেন্স-এ ২ জুন।
………………………………………………………………………………………….
গ্রহদের এই এক সারিতে প্যারেড কিন্তু নতুন কোনও বিষয় নয়। সৌরজগতে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। ১৯৭০ সালের শেষদিকে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস আর নেপচুনকে এক সারিতে দেখা গিয়েছিল। সে বার মহাকাশযান ভয়েজার এই গ্রহ-মিছিলের অসাধারণ সব ছবি পাঠিয়েছিল। বিগত ১৭৬ বছরের মধ্যে গ্রহদের এত সুন্দর সমাপতন নাকি চোখে পড়েনি। এবার হয়তো দৃশ্যটা অতটা মনলোভা হবে না। সত্যি বলতে কী, গ্রহদের প্যারেড ব্যাপারটা একটা অপটিক্যাল ইলিউশনের মতো।
………………………………………………………………………………………….
নাসা অবশ্য আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছে, এই গ্রহ-প্যারেড খালি চোখে খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তার কারণ, উদীয়মান সূর্যের আলোয় ম্লান হয়ে যাবে গ্রহদের দৃশ্যমানতা। নাসার মতে, সূর্যোদয়ের ঠিক এক ঘণ্টা আগে আকাশে চোখ রাখলে হয়তো এই মহাজাগতিক ঘটনার কিছুটা হলেও আভাস পাওয়া যাবে। নাসা আরও জানিয়েছে, ৩ জুন ভোরে কেবলমাত্র উজ্জ্বল লাল মঙ্গল আর শনিকে খালি চোখে দেখা যাবে। তাদের মাঝে উঁকি দেবে একফালি চাঁদও। মানে শনি আর চাঁদের মধ্যিখানে থাকবে মঙ্গল। বুধ আর বৃহস্পতিকে খুব আবছা দেখা গেলেও যেতে পারে। তবে ইউরেনাস আর নেপচুনের জন্য অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপের সাহায্য নিতে হবে। যদিও হলফ করে বলা যায় না– তারা দেখা দেবেই। সূর্যচ্ছটায় হয়তো মুখ লুকোবে গ্রহেরা।
গ্রহদের এই এক সারিতে প্যারেড কিন্তু নতুন কোনও বিষয় নয়। সৌরজগতে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। ১৯৭০ সালের শেষদিকে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস আর নেপচুনকে এক সারিতে দেখা গিয়েছিল। সে বার মহাকাশযান ভয়েজার এই গ্রহ-মিছিলের অসাধারণ সব ছবি পাঠিয়েছিল। বিগত ১৭৬ বছরের মধ্যে গ্রহদের এত সুন্দর সমাপতন নাকি চোখে পড়েনি। এবার হয়তো দৃশ্যটা অতটা মনলোভা হবে না। সত্যি বলতে কী, গ্রহদের প্যারেড ব্যাপারটা একটা অপটিক্যাল ইলিউশনের মতো। গ্রহরা নিজেদের কক্ষপথে নিজের নিজের গতিতে আবর্তন করে। তাই তারা কাছাকাছি এসে পড়লেও আদপে তারা এক রেখায় অবস্থান করছে, বলা যায় না। হ্যাঁ, পৃথিবী থেকে হয়তো মনে হয় তারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। এ আমাদের চোখের ভুল। আসলে তারা নানা উচ্চতায় বা গভীরতায় এবং নানা দূরত্বে মহাকাশে ছড়িয়ে আছে। যেমন স্টেলারিয়াম বলছে, বৃহস্পতি আর বুধ পরস্পরের থেকে ৪৪৮ মিলিয়ন মাইল দূরে আছে। কিন্তু দিগন্তের শামিয়ানায় চোখ রাখলে মনে হবে, ওই তো, ওরা এক সারিতেই আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এবার ৭৩ ডিগ্রি অঞ্চলের মধ্যে ছ’টি গ্রহকে একসঙ্গে পাওয়া যাবে। খেলার মাঠের ছড়িয়ে থাকা ছ’জন ফুটবলার কে যেমন একঝলকে কাছাকাছি দেখা যেতে পারে, সেরকম আর কী। এখন আমরা যদি ভেবে বসি– ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ বলে ছয় গ্রহ সরলরেখায় এগিয়ে চলেছে, সে নেহাতই বালখিল্য হবে! এই গ্রহমিছিল খুব দুর্লভ ঘটনা নয়। এ বছরেই আগামী ২৮ আগস্ট আবার ছয় গ্রহের প্যারাডের সাক্ষী থাকবে পৃথিবী। ২০২৫ সালের আগস্টের মধ্যে আরও চার বার এই ঘটনার পুরনরাবৃত্তি ঘটবে; কখনও তিন, কখনও চার গ্রহের সমাবেশ হবে।
মহাকাশ তো বিস্ময়ের আঁতুড়। তবে সেসব বিস্ময়কর কাণ্ডকারখানার সাক্ষী হতে গেলে আপনাকে খুঁজে নিতে হবে অন্ধকার। তবেই না কালো আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করবে গ্রহতারাদের জাদু। হায় রে বসুধা! বিশ্বব্যাপী আলোকদূষণে হারিয়ে গিয়েছে তোমার অন্ধকার। এ পৃথিবী আর ঘুমোয় না। তাই জেগে ওঠার আনন্দ থেকে বঞ্চিত সে। আসুন, একটু আলো নেভাই। জেগে উঠি আঁধার মাখা আবছা ভোরে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অপার বিস্ময়। বিশ্বপ্রকৃতি সাজিয়ে রেখেছে আনন্দের পসরা। তবে তার নিজের শর্তে। আসুন, আকাশ ভরা গ্রহ-তারার নিচে দাঁড়িয়ে একবার রোমাঞ্চিত হই। একবার নিজেকে উপহার দিই অণুত্বের বোধ। ভোরের আলো ফোটার আগেই।