আপনার পৈত্রিক বাড়িতে আপনার লেখা পাণ্ডুলিপি আনতে গিয়েছিলাম আমি। বাড়ির দেওয়ালে ছিল আপনার শিকার করার বন্দুক, বাঘের চামড়া, হরিণের শিং আরও কত কী! আপনাকে যখন বললাম, আপনার জঙ্গল নিয়ে লেখাগুলো একত্র করে ‘জঙ্গল সম্ভার’ করতে চাই, আপনার প্রথম উক্তি ছিল, ‘আমার সব লেখার মধ্যেই তো জঙ্গল, আলাদা করব কী করে!’
–আপনার লেখার আমি খুব ভক্ত। আপনাকে সামনে এইভাবে দেখতে পাব ভাবিনি।
বইমেলায় তাঁর প্রিয় পাঠিকা এগিয়ে দেয় ‘জঙ্গল সম্ভার’। একটা সই দেবেন।
–ভাগ্যিস দেখোনি। গন্ডারের মতো এই চেহারা দেখলে আর পড়তে ইচ্ছে করত না। কী নাম? আমি আবার চোখে এখন ভাল দেখতে পাই না। চুমুর দূরত্বে এলে দেখতে পাই।
পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলোয় সুন্দরী পাঠিকার ঠোঁটজোড়ায় হাসি মিশে যায়।
গ্রাম থেকে আসা, হাফপ্যান্ট পরা সতেরো বছরের সেই যুবকের সঙ্গে ’৬৯ সালে আপনার পরিচয়। যত দিন যায়, সেই পরিচয় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে পরিণত হয়। ’৭৩ সালে সেই খুদে প্রকাশকের বিয়েতে লেখেন–
‘এতদিন শুধু প্রকাশকই ছিলে; এতদিনে প্রকাশিত হলে। অনেক সংস্করণের শুভকামনা জানাই।’ কবে থেকে যে এই প্রকাশককে ভাইয়ের স্নেহে দেখলেন, তা বাবা মনে করতে পারে না। এই দুঃসময়ের মাঝে আপনাকে যখন জানালাম দে’জ পাবলিশিং-এর ৫০ বছর, একটা কিছু করব জেঠু। আপনি খুব উৎসাহ দেখালেন। এই প্রকাশনার সঙ্গে আপনার দীর্ঘ সম্পর্কের কথা লিখে পাঠালেন।
বাবাকে আপনি অনেক চিঠি লিখেছেন। সব চিঠিতেই যে বইয়ের কথা, তা নয়। অবাক হয়ে যাই যখন ব্যক্তিগত চিঠিগুলো পড়ি। আপনি ’৯৭ সালে আন্দামান বেড়াতে গিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারে বে আইল্যান্ড হোটেলের প্যাডে বাবাকে একটা চিঠি লেখেন,
১৬.১২.৯৭
সুধাংশু
কল্যাণীয়েষু,
দীঘার সমুদ্রপারের মানুষ তুমি, তাই একবার এখানে ঘুরে যাওয়া খুব দরকার। পোর্ট ব্লেয়ারের চারপাশেই শুধু সুনীল সমুদ্র– চারদিকেই হাজার মাইলের আগে কোনো ভূখণ্ড নেই। নিকোবরও এই দ্বীপপুঞ্জেরই অন্তর্গত। একদিকে মাদ্রাজ (চেন্নাই) শ্রীলংকা আর উপরে কলকাতা। উত্তর-পুবে বার্মা (মায়নমার) এবং থাইল্যান্ড। ভারতের মূল ভূখণ্ডের কাছে আন্দামানের Strategic Importance তাই অসীম। অনেক দেশেরই চোখ আছে এই দ্বীপপুঞ্জের উপরে।
তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। শহরটা পাহাড়ী। গভীর জঙ্গল তখনও নানা জায়গাতে আছে। দেখেও ভাল লাগে। আর কত যে দ্বীপ তা বলার নয়। মটোর বোটে করে যাওয়া যায়। একবার সকলকে নিয়ে এখানে ঘুরে যেও। থাকার অনেকই ভাল ভাল জায়গা আছে। এলে, এই হোটেলে একদিন লাঞ্চ বা ডিনার খেয়ে যেও। ডাইনিং হল থেকে সমুদ্রের দৃশ্য অনবদ্য।
Guild-এর Meeting-এ কী হল? বাদলবাবু আশা করি আমার Fax-এর কথা সকলকে জানিয়েছিলেন। তুমি Fax কবে বসাচ্ছ? ভাল থেকো। ঋভু পয়লা বৈশাখেই বের করো। তাড়াহুড়ো করলে হয়ে যাবে।
দাদা
আমি তখন স্কুলের গণ্ডি পেরইনি। ক্লাস সেভেন। ‘আনন্দ’ থেকে প্রকাশিত বেঁটে সাইজের বইগুলো তখন লুকিয়ে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে জামা চাপা দিয়ে নিয়ে আসতাম, লম্বা খাতার মধ্যে ঢুকিয়ে পড়তে গিয়ে ধরা পড়ে পিটুনিও খেতাম। বয়ঃসন্ধির সেই রাত জেগে শিহরন ভাগ করে নেওয়ার জন্য স্কুল ব্যাগে আপনার বই নিয়ে গিয়ে বন্ধুকে বলতাম, ‘এটা নিয়ে যা, পড়ে দেখ’। স্বপ্নে ভালবেসেছি আপনার নায়িকাদের। আপনার লেখায় সুন্দরী মেয়েগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই সুন্দরীদের দেখব বলেই বইমেলার সময় আপনার বইগুলোর সামনে বসতাম।
একটি ছোট্ট গল্পের বই ‘প্রথমাদের জন্যে’, সেই কিশোর প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং-এ বুদ্ধদেব গুহর প্রথম বই প্রকাশ করেন। ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় চাকরি করতেন শিল্পী সুধীর মৈত্র। বুদ্ধদেব গুহর সবচেয়ে পছন্দের শিল্পী। ‘জঙ্গলের জার্নাল’-এর পাণ্ডুলিপি তুলে দিয়েছিলেন প্রকাশকের হাতে। বলেছিলেন সুধীর মৈত্র বইটির অলংকরণ ও প্রচ্ছদ তৈরি করবেন। অসাধারণ ছিল সেই বইয়ের অলংকরণ।
আমি তখন ক্লাস টু তে পড়ি। আপনার ‘কোজাগর’ প্রকাশিত হল। আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন অঞ্জলিদি। শিক্ষক দিবসে আপনার এই বইটি আমার প্রিয় শিক্ষককে উপহার দিয়েছিলাম। এই অল্প সময়ের মধ্যে দে’জ পাবলিশিং-এ আপনার তখন অনেক বই। কিশোর প্রকাশক তখন আপনার ভাই, আপনার সব চিঠিতেই তখন– ‘ইতি দাদা’।
আপনার পৈত্রিক বাড়িতে আপনার লেখা পাণ্ডুলিপি আনতে যান সেই কিশোর প্রকাশক। বাড়ির দেওয়ালে ছিল আপনার শিকার করার বন্দুক, বাঘের চামড়া, হরিণের শিং আরও কত কী! আপনাকে যখন বললাম আপনার জঙ্গল নিয়ে লেখাগুলো একত্র করে ‘জঙ্গল সম্ভার’ করতে চাই, আপনার প্রথম উক্তি ছিল ‘আমার সব লেখার মধ্যেই তো জঙ্গল, আলাদা করব কী করে!’
এক দুর্গাপুজোর সময় বাবাকে ফোন, আপনার বাড়িতে জরুরি তলব। তখন আপনি সানি টাওয়ারে থাকেন। পুজো শুরু হতে তখনও প্রায় মাসখানেক বাকি। আনন্দবাজারের কোনও একটি পুজোসংখ্যায় আপনার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার কথা। কোনও কারণে পুজো সংখ্যায় না ছাপিয়ে পরবর্তী কোনও সময় ছাপানোর কথা জানায়। আপনি তৎক্ষণাৎ ফেরত চেয়ে পাঠান। আর সরাসরি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার দায়িত্ব দেন বাবাকে। আর বলেন, ‘বইটা পুজোর আগেই প্রকাশ করতে হবে’। সুধীর মৈত্র এই বইয়ের প্রচ্ছদ করবেন। সুধীর মৈত্র তখন শিল্পচর্চা থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আপনার বইয়ের কাজে তিনি না করতে পারেননি। আমাদের বঙ্কিমদা ও বাবুদা (বিদ্যুৎবাবু) এক সেট রং ও তুলি কিনে নিয়ে যান, আর সুধীরবাবু অসাধারণ প্রচ্ছদ করেন ‘অভিলাষ’ বইটির। বাবা কাগজে বিজ্ঞাপন দেন, “এই বছর পুজোয় কোনো পত্রপত্রিকায় বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে না। পুজোয় এই বছর তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অভিলাষ’।” পুজো শুরুর আগেই নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার কপি।
–অপু কালিকার তেলেভাজার দোকানটা আছে?
–আছে জেঠু।
–এখনও কি ওই লম্বা লম্বা বেগুনি বানায়?
–এখন আর চপ পাওয়া যায় না। সব কাটলেট হয়ে গেছে। ডিমের ডেভিল, ফিশ রোল, মোচার চপ আরও অনেক আইটেম আছে।
–একদিন খাওয়াবি তো!
নিয়ে গিয়েছিলাম। দিদি মনে হয় সেইদিন বাড়ি ছিলেন না। কমলেশ আপনার অনেকদিনের ড্রাইভার। আপনি তাঁকে বললেন প্লেটে করে দিতে। আর তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন।
একটা আশা পূর্ণ হল না, আপনি বলেছিলেন “দিঘা থেকে লঞ্চে করে সমুদ্রে নিয়ে যাবি। দু’দিন লঞ্চে থাকব আর মাছ ভাজা খাব।”
শীতকালে বইমেলায় আমাদের স্টলের সামনে অগণিত পাঠকের মাঝে আপনার রাজকীয়ভাবে বসা। সাজগোজে আপনি ভীষণ শৌখিন। বাহারি পাঞ্জাবির ওপর কারুকাজ করা কাশ্মীরি শাল, মাথায় কাশ্মীরি টুপি। হাতে ছড়ি আর পকেটে দামি ফাউন্টেন পেন। কত রকমের টুপি আর পেনের সংগ্রহ ছিল আপনার কাছে।
ঋতু জেঠিমার সঙ্গে আপনার যত প্রেম তত ঝগড়া। অনেকটা টম ও জেরির মতো। তখন কাকু (বাবু) যেতেন আপনার বাড়িতে। আপনাদের দু’জনের ঝগড়া করার গল্প শোনাতেন। গল্পগুলো ছিল বেশ মজার। একবার কাকুকে আপনার আফসোসের গল্প করছিলেন। একটু দূরেই বসেছিলেন জেঠিমা।
–জানো বাবু, আমার মা যখন ছিল তখন কচু শাক ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে রাঁধত। কী অপূর্ব স্বাদ ছিল!এখন কচুশাক খেতে হলে অপেক্ষা করতে হয়, যে মাসি কচু কাটতে জানে সেই মাসি যেদিন আসবে তখন রান্না হবে।
কাকু চুপটি করে শুনছে আর হাসছে।
–মা বলেছিল, তুই গান ভালবাসিস বলে কি গাইয়ে ঘরে আনতে হবে! ক্যাসেট কিনে শুনলেই তো হয়।
জেঠিমা বেশ জোরেই বলে ওঠেন, ‘তা একজন কচুকাটা মেয়েকে বিয়ে করলেই তো পারতে।’
এমন খুনসুটির গল্প অনেক আছে।
আপনাকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। ৫০ বছরের সম্পর্কে গল্পের ঝুড়ি যে উপচে পড়বে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। আপনি রোজ ফোন করতেন। কমলেশকে বলতেন ‘অপুবাবু কো ফোন লাগাও’। আমি সবসময় আপনার ফোন ধরতে পারতাম না। অনেক সময় আমার ফোনে পেতেনও না। একদিন তো খুব রেগে গিয়েছিলেন বলেছিলেন,
–তোকে কখনওই ফোনে পাওয়া যায় না।
–আসলে জেঠু, দোকানে থাকলে মোবাইল ফোন কাজ করে না।
–শোন, তোকে ফোনে পাওয়া যায় না। তুই আমায় রোজ ফোন করবি।
–হ্যাঁ। আপনাকে রোজ হয় সকালে নয় বিকেলে একবার করে ফোন করতাম।
এখন আপনার নম্বর থেকে ফোন এলে আপনার নাম আমার ফোনে ভেসে ওঠে, ওপারে বড়দির গলা পাই ‘অপু…’
আজ ভারতীয় সিনেমার শরীরে যখন বাসা বাঁধছে গোয়েবেলসীয় প্রোপাগান্ডা, তখন সেই ছয়-সাতের দশক থেকে কারণে-অকারণে, প্রেমে-বিরহে, স্কুলকলেজ বা অফিস কাটিয়ে বা পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে সিনেমা হলের আশ্রয় যারা নিয়েছে, তারা জানে অন্ধকারের মহিমা। শেষ হল জনতা সিনেমা হল।