যে ঘরে থাকে, সে কখনও সখনও ঘরের বাইরেও থাকে। যে বাইরে থাকে, সে কখনও সখনও থাকে ঘরের ভিতর। সংসারে সন্নাসী, এমন কত মানুষই যে রয়েছেন! বৈরাগ্যর চকমকি পাথরে মাঝে মাঝেই রোদ পড়ে ঝকমক করে বারান্দার পোষা টবগাছে। পাথর কোথা থেকে এল, কোন পথ থেকে, নদীর পার থেকে, খুঁজতে শুরু করলেই ঘরোয়ার বৈরাগ্যের শুরু।
নৈরঞ্জনা নদীতীরে এসে দাঁড়ালেন এক অশ্বারোহী রাজপুরুষ। রাত্রি গভীর। চরাচরে কেউ নেই। স্তব্ধতার রিনরিনে নৈঃশব্দ্য নদীজলে যেন ডুবসাঁতার কাটছে। এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ। মাটিতে নামলেন সেই পুরুষ। প্রিয় অশ্ব ছন্দকের পিঠে পরম আদর ছড়িয়ে দিয়ে রাজকীয় পোশাক থেকে তিনি মুক্ত করলেন নিজেকে। মস্তক মুণ্ডন করে দেহে জড়িয়ে নিলেন মেটে চিবর। তারপর? আর পিছনের দিকে তাকালেন না তিনি। নদীধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলেন কার্তিকের জোৎস্নার প্রান্তরে।
ঘরে আর ফিরে এলেন না তিনি। চন্দ্রাহত রাত্রির বুকে আশ্রয় নিলেন। যদি দেখা পান নতুন কোনও সকালের।
কেন সে দেখিল ভূত?
২.
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার পথ নয়। বলেছিলেন রবিঠাকুর। সেই তিনিই কিন্তু লিখেছিলেন, ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। বৈরাগ্যের কোনও বাড়ি নেই। ঘর নেই। স্থান নেই, কাল নেই। বৈরাগী রাগের যদিও বা সরগম থাকে, বৈরাগ্যের কোনও স্বরলিপি থাকার কথা নয়।
সারাজীবন নানাভাবে লালন সাঁই বলে গিয়েছেন, ‘কী ঘর বান্ধিনু আমি শূন্যের মাঝার’। আবার রবি ঠাকুর যেন একই সুরে বলেছেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে?’
আসল কথাটা মনে হয়, মন চলো নিজ নিকেতনে।
কেউ পারে কেউ পারে না। এটাই ট্র্যাজেডি। মনুষ্য জীবনের।
রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরোয়া’ ছিলেন না– এ কথা বলা যাবে না, অথচ বলেছেন, ‘খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে বনের পাখি ছিল বনে’। কে বেশি সুখী তাহলে?
রবিঠাকুরের মতো বৈরাগী আর কে ছিলেন? তিনি একাধারে ঘরোয়া ও বৈরাগী। তিনি ঘরোয়া হলে কি তাকে সম্পূর্ণ করে পাওয়া যেত? উত্তর জানা নেই।
৩.
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট নাকি একটি দীর্ঘতম বৃক্ষের নিচেই বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়েছেন। ভাবনা প্র্যাকটিস করেছেন। তাঁর আবাসস্থল থেকে মাত্র ১৪ মাইলের বাইরে বের হননি তিনি কোনও দিনই। স্বয়ং সম্রাট এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে নেওয়া যায়নি রাজপ্রাসাদে। যে বিরাট বৃক্ষ তাঁর চিন্তার সাক্ষী, সেটাই তার বাহির। অথবা ঘর। কোনটা ঘর আর কোনটা বাহির– তা কে নির্দিষ্ট করবে? আবার সেই একঘেয়ে তর্ক! ঘরকে যদি কেউ বাহির করতে পারে, বা বাহিরকে ঘর– তবেই সে প্রকৃত বৈরাগী।
৪.
গ্রিসের স্টোইক দার্শনিকদের বলা যেতে পারে, সিনিক বৈরাগী। তাঁদের কাছে সমস্ত পৃথিবীর সব কিছু খারাপ। ঘর, বাহির, মানুষ, আইন-নীতির প্রতিবাদে তাঁরা আর কিছু করতে না পেরে সারাদিন জলে গলা ডুবিয়ে বসে থাকতেন। প্রকৃত বৈরাগী তো তাঁরাই। কিন্তু তাঁরা উচ্চ চিন্তাশীল এবং গৃহত্যাগী। পৃথিবীর সব কিছুই খারাপ– এই ভাবনা তাঁরা প্র্যাকটিস করেছিলেন নিজেদের জীবনধারা দিয়ে। তা নাহলে কী আর তাঁদের দর্শন দার্শনিক চিন্তায় স্থান পায়? সক্রেটিস আবার উল্টোপথের পন্থী। তাঁর ঘরের খবর আমরা একটু-আধটু জানি। কিন্তু বাইরে তিনি পাগল। পথেঘাটে মানুষজনকে ডেকে ডেকে বলতেন, ‘এসো আমরা কথা বলি। আমাকে প্রশ্ন করো। অনেক কথা আমার বলার আছে। তোমরা শোনো। এসো তোমাদের কথাও আমি শুনব।’ এত কথা বলার জন্যই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল রাজরোষে।
৫.
চৈতন্যদেব গৃহত্যাগ না করলে দেশে ভক্তি আন্দোলনই হত না। তিনি যে লাখো লাখো চাড়াল, চণ্ডাল, ম্লেচ্ছ, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে নাচিয়ে নীলাচলে নিয়ে গেলেন, সেটাই তো বিপ্লব । চৈতন্যদেব তো ঈশ্বর বা জাদুকর নন, তাহলে কী করে এত মানুষকে এক ছাতার তলায় জড়ো করলেন? আসলে মানুষ তখন চাইছিল বাহিরে বেরতে। প্রতিদিনকার জীবনে ক্লেদমুক্ত হতে চাওয়ার বাসনায় তারা নেতা খুঁজছিল। এটা মানসিক আন্দোলন। রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কেন? বাইরে যাওয়ার প্রগাঢ় ইচ্ছেয়। বাইরে বলতে এখানে বিপ্লব। একমাত্র বিপ্লবই মানুষকে প্রকৃত বাহির দেখাতে পারে।
৬.
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমাটিক স্টাইলে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আমি… আমি কনফিউজড।’ সত্যিই তাই। বেশ কয়েক বছর আগে খবরের কাগজে দেখেছিলাম একজন প্রবল বৈরাগী বউয়ের ওপর রাগ করে গ্রামের শেষ মাথায় গাছের ওপর থাকতেন। সেটাই তার ঘর আবার বাহিরও। আরে বাবা বৈরাগ্যেরও তো টাইম অ্যান্ড স্পেস আছে নাকি? যদি সময়কে মানতে হয়, তাহলে বলতে হবে ওই মানুষটির স্পেস একটি গাছের মগডাল। সেটা ঘর হতেও পারে, যদি মানুষটি ওই স্পেসটুকুকে ঘর বলে মেনে নেয়। আমরা যারা দর্শক, তারা বলব গাছের মগডাল কখনও ঘর হতে পারে না। ওটা বাহির।
৭.
বৌদ্ধদের একটি শাখা জেন। তারা আবার কনফুসিয়াসেরও অন্য শাখা বা পল্লব। তাদের কোনও ধর্মপুস্তক নেই। আছে শুধু কিছু কবিতা আর গল্প। একটি গল্প এখানে উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না।
জাপানের একটি খরস্রোতা নদীর পারে এসে থমকে দাঁড়াল একটি মেয়ে। নদীর দিকে তাকিয়ে বুঝল এ নদী পার হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল, কেউ আছে কী না! দেখল একজন সাধু নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি সাহায্যের জন্য চিৎকার করে বলল, প্রভু আমি ওপারে কী করে যাব? সাধু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, তুমি তো ওপারেই আছ!
এই গল্পটি সম্ভবত হাজার বছরের পুরনো। আইনস্টাইন তো গত শতাব্দীতে রিলেটিভিটির তত্ত্ব আওড়েছেন। কিন্তু সাধু যতই ত্যাঁদড় হোক, যে উত্তরটা তিনি দিয়েছেন সেটাই সত্য। আসলে ‘এপার’ ‘ওপার’ বলে কিছু নেই। ঠিক তেমনই ঘর আর বাহির বলেও কিছু নেই। আবার বলতে হয়– মন চলো নিজ নিকেতনে।
৮.
আবার একটা গল্প মাথায় এসে গেল। কী আর করি? বলেই ফেলি।
পাহাড়ের মাথায় এক গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী একা থাকেন। তাঁর নিজস্ব বলতে কিচ্ছু নেই। একটা চিবর মাত্র তাঁর পরনে। আর একটা লতা গুল্মের কুটির। একদিন ভরা জোৎস্নার রাতে যখন মাথার ওপর এত্ত বড় চাঁদ দেখা যাচ্ছে, সন্ন্যাসী একটু দূরে বসে আছেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, তাঁর পর্ণ কুটিরে কেউ একজন প্রবেশ করল। নিশ্চয়ই চোর। সন্ন্যাসী খুব হাসলেন। মনে মনে। ভাবলেন চোরটা কী বোকা! তাঁর কুটিরে চোর? আশ্চর্য! তার আছেটা কী? চোর চলে যাওয়ার পর সন্ন্যাসী তাঁর জীর্ণ কুটিরে ফিরে এলেন।
দেখলেন তাঁর একটা চিবর নিয়ে গেছে চোরটা। তিনি আবার হাসলেন। ভাবলেন চোরটা কী বোকা! আমার চিবর নিয়ে গেল! আরে আকাশের ওই গোল চাঁদটাও তো আমার। চাইলেই আমি দিয়ে দিতে পারতাম।
এই সন্ন্যাসী কি গৃহত্যাগী? আপাতভাবে তো তাই। কিন্তু, যে চাঁদকে নিজের বলে ভাবতে পারে, সেই তো আসলে বৈরাগী। তার ঘর, পরিবার নভোমণ্ডলের প্রতিটি অণু ও পরমাণুতে। যার এত বড় সংসার, সে কেন বৈরাগী হবে? এত বড় ‘ঘরোয়া’র কি ঘর লাগে?