Robbar

কেবল অযোধ্যায় কেন! মনের মন্দিরেও থাকুন রাম

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 15, 2024 7:04 pm
  • Updated:January 15, 2024 7:04 pm  

ভারতবর্ষ রামকে মানুষ হিসেবেই গ্রহণ করেছে, কেননা বাল্মীকি রামকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে দেখালেও গড়ে তুলেছেন সুখদুঃখের অধীন দোষেগুণে ভাস্বর একজন মানুষ করেই। সেই সব জেনে এবং বুঝেই দেশের মানুষ রামকে লোকোত্তর আদর্শ চরিত্র হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ফলে রামকে গ্রহণের মধ্য দিয়েও ভারতবাসীর মনস্তত্ত্বের হদিশ পাওয়া যায়, তার ঐতিহাসিক মূল্য কম কিছু নয়।

অরিঞ্জয় বোস

রঘুপতি রাঘব রাজা রামকে নিয়ে অনেকদিন পর আবার ভারতবর্ষের হৃদয়ে আন্দোলন তৈরি হয়েছে। এমন নয় যে, এ ভারতভূমি থেকে রাম উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মন্দির ছিল না কিংবা তাঁর পূজা বন্ধ ছিল– কোনওটাই সত্যি নয়। ভারত বলেই তা হওয়া সম্ভব ছিল না। কেননা এ-দেশের সম্মিলিত চেতনাপ্রবাহে আবহমান হয়ে আছেন নরচন্দ্রমা। বর্তমানে ভারতের একটি বিশেষ মন্দিরে রাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেন প্রমাণ করছেন যে, তিনি এতদিন কোথাও ছিলেন না। বাস্তবিক, এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে, বাহুল্য আছে। একরকমের একতরফা বয়ান আছে, যা তর্কযোগ্য এবং প্রশ্নের মুখেও পড়ে। কেননা ভারতবর্ষ কখনই রাম-বিমুখ ছিল না। তাহলে সাম্প্রতিক এই আন্দোলনের ভিত্তিটা ঠিক কী? সন্দেহাতীত ভাবেই, রাজনীতি তার একমাত্র ভিত্তি এবং রাজনীতিই তার ভবিষ্যৎ।

Construction of Ram Mandir begins in Ayodhya, says temple trust
রাম মন্দির

রাম মন্দির বনাম বাবরি-র বিতর্ক আদতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দীর্ঘদিনের একটি অ্যাজেন্ডা। এ-কথা তামাম ভারতবাসীই জানে। ইতিহাস সময়ের একমাত্রিক সৌধ মাত্র নয়। তার মাটি খুঁড়তে গেলে অতীতের এমন দু’-একটা নমুনা উঠে আসে, যা ধন্দের জন্ম দেয়। তবে সেই অতীতের সীমা ঠিক কতদূর প্রসারিত হবে, সন্দেহের নকশাটা কোন সময়কাল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হবে, তা রাজনীতির ওই অ্যাজেন্ডার উপরই নির্ভর করে। এবং সেই নিয়ন্ত্রণ থাকে ক্ষমতাসীনের হাতেই। অতএব এ-নিবন্ধ সেই রাজনৈতিক আকচাআকচিতে আর ঢুকতে চায় না, যেহেতু ঐতিহাসিক বিতর্কের ফয়সালার ভার ছিল শীর্ষ আদালতের উপর। তবে মনে করিয়ে দেওয়ার এটুকুই যে, ফয়সালার মুহূর্তে শীর্ষ আদালত এটুকুও দ্বিধাহীন জানিয়েছিল যে, ১৯৪৯ এবং ১৯৯২– দু’বারই যা হয়েছিল, অন্যায় হয়েছিল। ফলে একটা সঙ্গত প্রশ্ন উঠে আসে যে, অন্যায়ের ওপর রাম তথা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা কি আদৌ হতে পারে! ঠিক সেখানেই আর একটা দরজা খোলার প্রয়োজন অনুভব করি। যেখান থেকে রামকে আমরা দেখতে পারি, এই রাজনীতির বাইনারির বাইরে। সে দৃকপাতকে অরাজনৈতিক বলব না, যেহেতু আমাদের দেশে রাম আর অরাজনৈতিক শব্দ নয়; কিন্তু একটি নির্দিষ্ট দলের নির্ধারণ করে দেওয়া অ্যাজেন্ডার বাইরে গিয়ে রামকে দেখতে শেখা একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক চিন্তারই অংশ বলে মনে করি। যা আমাদের বুঝতে শেখায়, রাম সর্বজনীন, সর্বকালীন এবং গোটা ভারতেরই।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

রাম মন্দির বনাম বাবরি-র বিতর্ক আদতে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দীর্ঘদিনের একটি অ্যাজেন্ডা। এ-কথা তামাম ভারতবাসীই জানে। ইতিহাস সময়ের একমাত্রিক সৌধ মাত্র নয়। তার মাটি খুঁড়তে গেলে অতীতের এমন দু’-একটা নমুনা উঠে আসে যা ধন্দের জন্ম দেয়। তবে সেই অতীতের সীমা ঠিক কতদূর প্রসারিত হবে, সন্দেহের নকশাটা কোন সময়কাল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া হবে, তা রাজনীতির ওই অ্যাজেন্ডার উপরই নির্ভর করে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

বস্তুত, ভারতবর্ষ যে বৈচিত্র এবং বহুত্বকে অনুশীলন ও উদযাপন করেছে, তার রামের থেকে বড় উদাহরণ আর নেই। বাল্মীকি তাঁকে এমন একটা চরিত্র হিসেবে গড়তে চেয়েছেন, যা প্রায় সব ক্ষেত্রেই আদর্শের মাপকাঠির কাছাকাছি। অথচ জীবন এমনই বিচিত্র যে, সব আদর্শ একই সঙ্গে, একই ভাবে, একই সময়ে রক্ষা করা যায় না। কোথাও না কোথাও টানাটানি ঠিক পড়েই যায়। ফলে এই যে মানবাতীত গুণের সমন্বয়ে গড়া রাম-চরিত্র, তার মধ্যেও থেকে গেল বিরোধাভাস। এই কি একটা দেশের অন্তর্গঠন নয়! এই সংকট এবং মূল্যায়নের সম্ভাবনাগুলো থাকল বলেই, রামায়ণ আর্যপ্রতিষ্ঠার টেক্সট হলেও রাম-চরিত্র কিন্তু প্রদেশে প্রদেশে অবহেলিত হয়ে রইল না। বহুকালের বহু মানুষ রাম-চরিত্রকে গড়ে নিলেন নিজের মতো করে।

The 108 names of Sri Ramachandra - ISKCON Blog

অঞ্চলভেদে বদলে বদলে গেল রামায়ণের ভাষ্য। কিন্তু রাম থেকে গেলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় আদর্শ চরিত্র গড়ার কথা আর ভাবা হল না। কারণ রাম নিশ্ছিদ্র নিষ্কলঙ্ক নন। তিনি আবার একেবারে প্রশ্নাতীত অবতারও নন। ফলে তাঁকে প্রশ্ন করা যায়, অভিযুক্ত করা যায়, কাঠগড়ায় তোলা যায়। সময় যত গড়িয়েছে, আধুনিকতায় যত পালটে পালটে গিয়েছে মনন-বোধ, তত রামের প্রতি, রামের নানা কার্যকলাপের প্রতি, সেই সব প্রশ্ন শাণিত হয়েছে। আর তত গাঢ় ও গূঢ় হয়েছে রাম-অন্বেষণ। রামের প্রতিটি কাজের পিছনে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে যুক্তি। যুক্তি, প্রতিযুক্তিতে রাম ক্রমশ যেন হয়ে উঠেছেন এক ডিসকোর্স। এই সন্দর্ভ সম্ভাবনাই রামচরিত্রকে আবহমান জীবন্ত করে রেখেছে। রাম কী পেরেছেন আর কী পারেননি, রাম কী করেছেন আর করেননি, রাম কোথায় নিষ্ঠ আর কোথায় নীতিচ্যুত, রাম কেন আদর্শ অথবা কেন ততটাও আদর্শ নন– এই এতগুলো প্রশ্ন-উত্তর কিংবা এতখানি প্রসারিত আলোচনার পরিসর ঘনিয়ে উঠতে পারে তাঁকে কেন্দ্র করে।

মানুষ তাই রামকে মূর্তি গড়ে ফুল-বেল পাতা দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখেননি। বরং রামকে টেনে এনেছেন প্রাত্যহিক জীবনে, দৈনন্দিনের সংকট এবং সংকটমুক্তিতে। ভারতবর্ষ রামকে মানুষ হিসেবেই গ্রহণ করেছে, কেন-না বাল্মীকি রামকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে দেখালেও গড়ে তুলেছেন সুখদুঃখের অধীন দোষেগুণে ভাস্বর একজন মানুষ করেই। সেই সব জেনে এবং বুঝেই দেশের মানুষ রামকে লোকোত্তর আদর্শ চরিত্র হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ফলে রামকে গ্রহণের মধ্য দিয়েও ভারতবাসীর মনস্তত্ত্বের হদিশ পাওয়া যায়, তার ঐতিহাসিক মূল্য কম কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই কারণেই বলেছিলেন যে, ‘রামের চরিত্র উচ্চ কি নীচ, লক্ষ্মণের চরিত্র আমার ভাল লাগে কি মন্দ লাগে, এই আলোচনাই যথেষ্ট নয়। শুদ্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে সমস্ত ভারতবর্ষ সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কিরূপ ভাবে গ্রহণ করিয়াছে।’ অতএব, আজকের ভারতও কোন প্রেক্ষিতে, কোন রাজনীতিতে, মূর্তির আধারে নাকি মূর্তির অধিক লোকত্তর বিগ্রহকে গ্রহণ করবে, তা জরুরি বইকি। রাম চরিত্রের মধ্য দিয়ে যে বৈচিত্র, যে দার্শনিক মোকাবিলার মুখোমুখি হয়েছে ভারতবাসী, তা এক গিঁটে বেঁধে ফেলে নিত্য ধূপ-ধুনো দেওয়াই কেবলমাত্র কর্তব্য হবে কি না, সে বিবেচনার ভার ভারতবাসীরই।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: রামের চিত্রকথা যেভাবে ‘অমর’ হয়ে উঠল

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

তবে, রাম নিয়ে আন্দোলন যত আমাদের মথিত করবে, আমরা ন্যায়-অন্যায়ের বোধ এবং বিবেচনার তত কাছাকাছি পৌঁছতে পারব। অন্তত আধুনিক দিন-কালে, যখন আমরা ক্রমশ অতীতবিচ্ছিন্ন প্রযুক্তিমুখর প্রগলভ নির্বোধ মাংসপিণ্ডে পরিণত হচ্ছি, তখন রামের সূত্রে দর্শনের সহজপাঠে ফিরতে আপত্তি থাকার কথা নয়। যে আদর্শ এবং ন্যায়ের ধারণা রামের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে, এবং তার যে সমালোচনা উত্তরকালের ভারতবর্ষ করেছে, তা আদতে একটা প্রবহমান সভ্যতার চিন্তাধারারই হদিশ দেয়। রামকথা তাই কখনও স্থির বা বদ্ধ নয়। রাম নিজেও স্থবির কোনও চরিত্র নন। প্রথম শ্লোক রচনার লগ্নেই ব্রহ্মা, বাল্মীকি-কে বলেছিলেন– ‘ন তে বাগনৃতা কাব্যে কাচিদিত্র ভবিষ্যতি’– অর্থাৎ তোমার এই কাব্যে কোনও মিথ্যা থাকবে না, এবং যতকাল নদী-পাহাড় থাকবে, ততদিন ‘রামায়ণকথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি’, অর্থাৎ অনন্তকাল রামায়ণকথা প্রচারিত হবে। মিথ্যা নেই বলেই রাম-চরিত্রের নানা মূল্যায়ন সম্ভব হয়েছে। এবং রামকথা কোনও বদ্ধ প্রণালী নয় বলেই, তা অনন্তকাল প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখেই আলোচিত এবং প্রচারিত।

রামকে নিয়ে আন্দোলন যদি আমাদের এই ন্যায়-নীতি-সংকটের বিচারবুদ্ধি এবং যুক্তিগ্রাহ্যতার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না। ভারতে আজও ধর্ম আর রাম সমার্থক। তবে ধর্ম আর রাজনীতি যে এক নয়, ভারতবাসী যেন তা মনে রাখে।