মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা যায় মঞ্চের জ্যামিতি ভাঙতে। তিনি যখন সেই সরণি ধরে হেঁটে মানুষের মাঝে এগিয়ে গেলেন তখন এক ধরনের বয়ানই নির্মিত হয়, তবে শব্দে নয়, দৃশ্যে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই কৌশল থিয়েটারেই কাজে লাগানো হয়। অভিনেতা মঞ্চের দূরত্ব থেকে সোজা নেমে আসেন দর্শকের মধ্যে। অথবা দর্শকের মধ্য দিয়ে হেঁটেই মঞ্চে ওঠেন। দুই ক্ষেত্রেই এর নির্দিষ্ট অর্থ আছে। সিনেমা এই কাজটা করে থাকে ক্যামেরার মাধ্যমে। তবে জনসভা যেহেতু একটা থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্সের মতোই, তাই এখানে যেন নাট্যের ভাষার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক বয়ান নির্মিত হল।
জনতার মুখরিত সখ্যে মিশে যাচ্ছেন তিনি– মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার রাজনীতিতে গত কয়েক দশক ধরেই যিনি অবিসংবাদিত ‘স্টার’। নাগালসম্ভব দূরত্বে তাঁকে পেয়ে উদ্বেল জনতা। বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাতে আকুলতার আলপনা। বঙ্গ রাজনীতি সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা বলবেন, এ ছবি আর নতুন কী! বিরোধী নেত্রী থাকালীনই তিনি এহেন দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। তবে সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তিতে এবার নতুন শুধু একটা কৃত্রিম জনতা-সরণি। যে-পথ ধরে তিনি হেঁটে যেতেই ব্রিগেড পেয়ে গেল তার নবতম সংস্করণ।
ব্রিগেড আদতে বাংলা রাজনীতির আকরগ্রন্থ। তার পাতায় পাতায় পালাবদলের ইতিহাস। রাজনীতি সচেতন বাঙালির সম্মেলক স্মৃতিতে সেসবই বেশ স্পষ্ট। নতুবা একটু নথিপত্র ঘেঁটে নিলেই বোঝা যাবে, বাংলার রাজনীতির মানচিত্র বদলে দিয়েছে এই ব্রিগেড। ‘জনসভা’, ‘মিটিং’ ইত্যাদি শব্দ দিয়ে তাই বাঙালির ব্রিগেডকে ব্যাখ্যা করা যায় না, যেমন নেহাত একটা ম্যাচ বললে কলকাতা ডার্বির কিছুই বলা হয় না, সেরকমই। তবে কিনা সেখানে বরাবর রাজনৈতিক বিষয়বস্তুই মুখ্য হয়ে থেকেছে। সত্যি বলতে, মঞ্চসজ্জা বিষয়টি থিয়েটারের সঙ্গেই ওতোপ্রোত। রাজনৈতিক জনসভা ‘থিয়েটার’ নয়। ফলত সেখানে মঞ্চে রাজনীতির সাতকাহন এত প্রকট যে, অন্যান্য নন্দনতত্ত্ব প্রায় আমলই পায় না। তবু একটা মঞ্চ, বক্তা এবং অগণন দর্শক যখন থাকেন, তখন মঞ্চের ব্যাকরণও নিশ্চিত থাকে। তার ভাঙা-গড়া, নির্মাণ-বিনির্মাণ, বিবর্তন-পরিবর্তন চলতে থাকে। আর সেই নিরিখেই ১০ মার্চের ব্রিগেড নিঃসন্দেহে নতুন একটি অনুচ্ছেদ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তিনি যখন সেই সরণি ধরে হেঁটে মানুষের মাঝে এগিয়ে গেলেন তখন এক ধরনের বয়ানই নির্মিত হয়, তবে শব্দে নয়, দৃশ্যে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই কৌশল থিয়েটারেই কাজে লাগানো হয়। অভিনেতা মঞ্চের দূরত্ব থেকে সোজা নেমে আসেন দর্শকের মধ্যে।অথবা দর্শকের মধ্য দিয়ে হেঁটেই মঞ্চে ওঠেন। দুই ক্ষেত্রেই এর নির্দিষ্ট অর্থ আছে। সিনেমা এই কাজটা করে থাকে ক্যামেরার মাধ্যমে। তবে জনসভা যেহেতু একটা থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্সের মতোই, তাই এখানে যেন নাট্যের ভাষার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক বয়ান নির্মিত হল। মমতার প্রধান পরিচয় তিনি মানুষের নেত্রী। তাঁর দলের কর্মীরা বলে থাকেন জননেত্রী। ইতিমধ্যে এক দশকের শাসনকালে তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের অভাব অভিযোগও কিছু কম নয়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মঞ্চ থেকে কর্মীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার মূল প্রক্রিয়াটি ঘটে শব্দে। যাঁরা চমৎকার বক্তা, তাঁরা শব্দচয়নেই এই জায়গায় বাজিমাত করে দেন। রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করার আগেই এমন একটা ঘরোয়া পরিবেশ তৈরি করে নেন, যাতে প্রতিটি দর্শক মঞ্চের বক্তার সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করেন। এর পরের ধাপে থাকে স্বরক্ষেপণের কৌশল। স্বরগ্রামের ওঠানামায় ঝাঁজালো বক্তব্যকে প্রায় তারসপ্তকে তুলে নিয়ে গিয়ে দর্শককে সম্মোহিত কিরে ফেলেন বক্তা। মুহূর্তে অভিনন্দন ছুটে আসে হাততালি হয়ে। এরও পরে থাকে মঞ্চ ব্যবহারের নৈপুণ্য। একেবারে গোড়া থেকেই এ ব্যাপারে বেশ ব্যতিক্রমী মমতা। বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই চমৎকার বক্তৃতা দেন, তবে মঞ্চের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাতে তাঁর বক্তব্যের আকর্ষণ বা রাজনৈতিক গুরুত্ব নিশ্চয়ই কমে না। বাকি মঞ্চ সেখানে যেন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে থাকে। মমতাকে দেখা যায় মঞ্চের জ্যামিতি ভাঙতে। তিনি ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করেন। আর যেহেতু তিনিই মুখ্য আকর্ষণ ও তাঁর স্থান বদলাচ্ছে, দর্শক-দৃষ্টিও তাই চুম্বক হয়ে আটকে থাকে তাঁর দিকেই। সেই ঘরানা যেন আর একটু প্রসারিত হল। এবার তাঁর হাত ধরেই ব্রিগেডের মঞ্চ সম্প্রসারিত হল জনতার মধ্যে। তিনি যখন সেই সরণি ধরে হেঁটে মানুষের মাঝে এগিয়ে গেলেন তখন এক ধরনের বয়ানই নির্মিত হয়, তবে শব্দে নয়, দৃশ্যে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই কৌশল থিয়েটারেই কাজে লাগানো হয়। অভিনেতা মঞ্চের দূরত্ব থেকে সোজা নেমে আসেন দর্শকের মধ্যে।অথবা দর্শকের মধ্য দিয়ে হেঁটেই মঞ্চে ওঠেন। দুই ক্ষেত্রেই এর নির্দিষ্ট অর্থ আছে। সিনেমা এই কাজটা করে থাকে ক্যামেরার মাধ্যমে। তবে জনসভা যেহেতু একটা থিয়েট্রিক্যাল পারফরম্যান্সের মতোই, তাই এখানে যেন নাট্যের ভাষার মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক বয়ান নির্মিত হল। মমতার প্রধান পরিচয় তিনি মানুষের নেত্রী। তাঁর দলের কর্মীরা বলে থাকেন জননেত্রী। ইতিমধ্যে এক দশকের শাসনকালে তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের অভাব-অভিযোগও কিছু কম নয়। এর একমাত্র প্রতিষেধক হল মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। গত বিধানসভায় যে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি। এবার আক্ষরিক অর্থেই তাঁর আর মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাস্তব করে তুলল এই সরণি। যেন নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীত্বের দূরত্ব মুছে তিনি বুঝিয়ে দিলেন ‘আমি তোমাদেরই লোক’। এই বার্তা মমতা বরাবরই দিয়ে থাকেন, তবে তার এমন ব্রিগেডীয় উপস্থাপনা নিশ্চিতই চমকপ্রদ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: এবার কি রোবটদের জন্যও আলাদা আইন আনতে হবে?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আর একজনের কথা না বললেই নয়। এই জনসংযোগের সরণির রূপকার যদি হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাহলে তিনি সেই ভাবনার অন্যতম সূত্রধর। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যে কুশলী দক্ষতায় ব্রিগেড সমাবেশ উপস্থাপন করলেন দলের সেনাপতি, তা যেমন চমকপ্রদ, তেমনই আধুনিকতার মিশেলে অভিনব। মঞ্চ ভাবনা থেকে উপস্থাপনা– সবদিক থেকেই রবিবাসরীয় ব্রিগেডে নতুনত্বে ভরা। ব্রিগেডের এই নব্য ‘অভিষেক’ যে আগামী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতেও অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠবে। বক্তব্য বয়নে তাঁর বাগ্মিতা আগেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। রবিবার ব্রিগেডে সক্রিয় উপস্থিতিতে কেবল নয়, পাশাপাশি বিস্তৃত রাম্পে পদচারণা থেকে আভূমিনত প্রণাম জানিয়ে জনতার হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিলেন। এবং অবশ্যই ঐতিহাসিক মঞ্চ থেকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণায় চমক। সেটাও যে দলের সেনাপতির মস্তিষ্কপ্রসূত, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। ব্যক্তি নয়, দল। দলের প্রাণ জনতা-জনার্দন। মুখরিত ব্রিগেডে সেই সারসত্য অনুভব করে একবারই থামতে দেখা গেল অভিষেককে। সেটাও ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণায়। স্বীয় নাম উচ্চারণের ভারটা দলের পোড়খাওয়া মুখ অরূপ বিশ্বাস এবং উপস্থিত কর্মী-সমর্থকদের হাতে ন্যস্ত করে অভিষেক যেন বুঝিয়ে দিলেন, দলের নেতা নয়, তিনি আক্ষরিক অর্থেই জননেতা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: প্রোডাক্ট এখন বিক্রেতারাই, পাঞ্চলাইনে ধুন্ধুমার!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তা ছাড়া সময়টা ওয়ান-টু-ওয়ান কমিউনিকেশনের। কর্পোরেট দুনিয়া বিষয়টিকে বেজায় গুরুত্ব দেয়। যেখানে সার্ভিস সেক্টরে লক্ষ্মীর বসবাস, সেখানে প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাদের সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখা খুব দামি কথা। ব্যাঙ্কের মতো জায়গাতেও তাই আজকাল আর প্রাচীন ঘেরাটোপ থাকে না। এপারে ওপারে যোগাযোগ যত মজবুত, ততই সন্তুষ্টি। আর তাতে ব্র্যান্ডের গায়ে কোনও দাগ পড়ে না। বরং তার গ্রাফ বাড়ে চড়চড়িয়ে। অনতিঅতীতে রাজনীতিতে এই ব্র্যান্ড নির্মাণ খুব সচেতন একটা প্রক্রিয়া। তার নানা রূপবদলের সাক্ষী থেকেছে দেশ। তবে কর্পোরেট মন্ত্র আর রাজনীতির ভাষ্য এভাবে মিলিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব শেষমেশ বাংলারই থাকল। সেই অর্থে তৃণমূলের এই ব্রিগেড রাজনৈতিক জনসভার উপস্থাপনার আঙ্গিকে নতুন ভাবনার রসদ জুড়ে দিল।
আর তাই র্যাম্প বললে বোধহয় এই স্পেক্ট্যাকলের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বলা যায় ব্রিগেডের এই নবতম সংস্করণে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে থাকল এই জনতা-সরণি। যে-পথ ধরে নেতা মিলিয়ে যেতে পারেন জনতার মুখরিত সখ্যে, আক্ষরিক অর্থেই।
সে-পথ আজ ব্রিগেডের বাংলা চেনাল, বাকি দেশ হয়তো ভাববে আগামিকাল।