বঙ্গ হুজুগপঞ্জিকা বলছে, চব্বিশের বিকাল ৪ ঘটিকা হইতে পঁচিশের সন্ধ্যা ৯ ঘটিকা পর্যন্ত এভাবেই বয়ে চলে বাঙালির রবীন্দ্রলগ্ন। পুজো বললে পুজো, প্রেম বললে প্রেম, ট্রেন্ড বললে ট্রেন্ড! আর ২৬ বৈশাখ? সে তো শুকনো মালা সরানোর দিন। হারমোনিয়াম কাঠের ডালায় পুরে রাখার দিন। ‘সঞ্চয়িতা’ তুলে রাখার দিন। রবীন্দ্রনাথকে ভুলে থাকার দিন। এমনকী, বিষণ্ণতার সম্বলও নেই তার। দশমী, তবু বিজয়াসম্মিলনীর আন্তরিকতা নেই। নেহাতই উৎসবহীন রবীন্দ্রনাথের তাই উঠে যেওয়া দেওয়ালের শূন্যস্থানে, একদিনের জন্য যেখান থেকে তিনি নেমে আসেন বঙ্গজীবনে।
আশি বছরে কবি চলে গেলেন। একাশিতম জন্মদিন যখন এল, শহরে-নগরে-গ্রামে পালিত হল রবীন্দ্রজয়ন্তী। দেখে প্রমথ চৌধুরী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলেছিলেন, এ হল ‘রবীন্দ্রনাথের বৈজয়ন্তী’। কবি তো চিরকাল থাকেন না। মানুষ মরণশীল। তবে কোনও কোনও কবির সৃষ্টি অমরত্ব পেয়ে যায়, যেমন রবীন্দ্রনাথের। অতএব তাঁর চলে যাওয়ার পরে যে উৎসব ‘তা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বই-জয়ন্তী’। কবি সশরীরে নেই, এই অবস্থায় তারপর আরও আশি বছরের বেশি কেটে গেল। অমরত্ব প্রসারিত হতে হতে ইদানীং যা পালিত হয়, তা যেন রবীন্দ্রনাথ কই-জয়ন্তী। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ যে কোথায়, বোশেখের পঁচিশ এলে হাঁকুপাকু করে তারই খোঁজখবর শুরু হয়ে যায়।
এমনিতে বাঙালির ঠিকুজি-কুষ্ঠিতে রবীন্দ্রযোগ আসে সেই খোকা-খুকু কথা কওয়া শেখার আগে। ছকে রবির অবস্থান এমন পাকা যে, পাকা জ্যোতিষী মাত্রই জানেন, মুক্ত-গোমেদ নীল-পলা যাই-ই দেওয়া হোক না কেন, বাঙালির আসলে দরকার রবীন্দ্র-রত্ন। নইলে কনফিডেন্সই আসে না। ঝাঁ-চকচকে অর্থবান স্ট্রিট-স্মার্ট ভিনরাজ্যের কোনও বাসিন্দা যদি তার দিকে তাকিয়ে বলে– মেরে পাস মানি হ্যায়, পাওয়ার হ্যায়, অমুক হ্যায়, তমুখ হ্যায়, ক্যায়া হ্যায় তুমহারা পাস? বাঙালি কী জবাব দেবে! না আছে তার পাওয়ার না আইফেল টাওয়ার, না আছে ইউনিটি, না স্ট্যাচু অফ ইউনিটি! সে শুধু মৃদু স্বরে হলেও বলতে পারে, মেরে পাস রবীন্দ্রনাথ হ্যায়!
এই একটা নামের গুরুত্ব সকলেই জানেন। বিশেষত নেতা-মন্ত্রীরা। আজকাল যাঁরা বঙ্গবিজয়ে আসেন, তাঁদের নাকি হাতে ‘গীতাঞ্জলি’ ধরিয়ে কবিতা মুখস্থ করতে দেওয়া হয়। সমীক্ষকরা কাঁচুমাচু মুখ করে বলেন, স্যার, হাতিই মারুন আর ঘোড়াই মারুন, রসগোল্লাই বলুন আর মিষ্টি দই বলুন, বাঙালির সেন্টিমেন্টে আপনার ইনক্রিমেন্ট শুধু রবীন্দ্রনাথেই। বেচারা অন্য ভাষায় অভ্যস্ত জিহ্বা আড় ভেঙে বহুকষ্টে যা আয়ত্ত করে, তা আবার বলতে গিয়ে ছড়িয়ে একশা! কোথাকার চন্দ্রবিন্দু যে কোথায় বসে যায় নেতাপ্রবর তা বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারেন না। সহজ পাঠ হয় ওঠে বিস্তর কঠিন। এদিকে তা নিয়ে হাসাহাসির হুল্লোড়। তার থেকে সহজ বরং রবীন্দ্র-বহুরূপী সাজা। ছবি দেখে দেখে মেক-আপ আর্টিস্ট কনে সাজানোর মতো নেতাদের রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। তাঁরা এসে ঘুরে বেড়ান, বসে লেখার ভাণ করেন ঠিক যেভাবে যেমন খুশি সাজো-তে করে বেড়ায় ইশকুল বালক-বালিকারা। তবে বাঙালি তো সেই কবে থেকেই জানে, যে, জল আর জলপাই, চাল আর চালকুমড়ো, নেতা আর নেতাজি এক নয়; অতএব এসব বিরিঞ্চিবাবা কীর্তিকলাপ ধরে ফেলতে সময় লাগে না। সে সামান্য যেটুকু কলার আছে তোলার চেষ্টা করে বলে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মশকরা! এত সহজ নাকি আমাদের বশ করা! বাঙালি ভদ্রলোকের ক্ষয়ে যাওয়া কবজিতে এখনও উনিশ শতকের উজ্জ্বল উদ্ধার– ঘড়ি আর রবীন্দ্রনাথ।
………………………………………………………………………………………………………………………….
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে আর বাঙালি গোটা দশেক গান গেয়ে চলে। সেই ক’টা গানেই নাচে। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে চন্দনফোঁটা-মালা। কখনও আবার সামনে ধূপ! বাড়িতে, ইশকুলে, ক্লাবে ইদানীং পার্টি অফিসে অবিরাম বয়ে চলে রবীন্দ্র-সুবাতাস। সে রেওয়াজও বহুদিনের ব্যবহারে ক্লিশে। সত্যি বলতে, এই জোড়াসাঁকো-টু-রবীন্দ্রসদন ঘিষাপিটা রুটে বাঙালি খানিক বোরও বটে। মুক্তধারা তার সোশাল মিডিয়া।
……………………………………………………………………………………………………………………………
তো সেই রবীন্দ্রনাথকে খুঁজেপেতে মেজেঘষে পরিষ্কার করে না রাখলেই নয়! অতএব পঁচিশে বৈশাখ। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে আর বাঙালি গোটা দশেক গান গেয়ে চলে। সেই ক’টা গানেই নাচে। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে চন্দনফোঁটা-মালা। কখনও আবার সামনে ধূপ! বাড়িতে, ইশকুলে, ক্লাবে ইদানীং পার্টি অফিসে অবিরাম বয়ে চলে রবীন্দ্র-সুবাতাস। সে রেওয়াজও বহুদিনের ব্যবহারে ক্লিশে। সত্যি বলতে, এই জোড়াসাঁকো-টু-রবীন্দ্রসদন ঘিষাপিটা রুটে বাঙালি খানিক বোরও বটে। মুক্তধারা তার সোশাল মিডিয়া। এখন তাই ছবিতে মালা দিয়ে আর ক্ষান্ত থাকলে চলে না। কন্টেন্ট ভাবতে হয়। রবীন্দ্র-কন্টেন্ট। বাড়িতে খুদে থাকলে তার নাচ কিংবা আবৃত্তি মাস্ট পোস্ট। যদি পোষ্য থাকে আর সে যদি মনুষ্যলোকের এই বিচিত্র কর্মকাণ্ডের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে তবে তো সোনায় সোহাগা, উপরে ক্যাপশন ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগে একা’ ইত্যাদি। আবার ‘আমি বাবা ওসবে নেই’ বৃত্তে যাঁরা, তাঁরা পাঞ্জাবিতে রবীন্দ্রস্বাক্ষর আর শাড়িতে সহজ পাঠ ছাপিয়ে রাবীন্দ্রিক চেতনার ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট রেখে যান। আর-একটু ডুবসাঁতারে কেউ খুঁজে পেতে আনেন শান্তিদেব ঘোষ। রচনাবলির সূচি না উলটেও যে উন্নত রুচির প্রমাণ দেওয়া যায়, এমন সুযোগ হাতছাড়া করা পাপ।
এদিকে জনাকয়েক ঠিক থাকবেন, যাঁরা খিল্লি করবেনই। ধরা যাক, কোনও বইয়ের প্রচ্ছদে রবীন্দ্রপ্রতিকৃতি খানিক বিকৃত হয়েছে। সেই নিয়ে শুরু হবে মশকরা। আর তা যে কত কুৎসিত, তা ক্রমাগত বলে বলে রবীন্দ্রভক্তির স্মাজপ্রুফ মায়াকাজল বাকিদের চোখে পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাবেন আরও কয়েকজন। উদ্দেশ্য সেই একই, বুঝিয়ে দেওয়া, আমি যতদূর রবীন্দ্র-সমীপে, তুমি কি তা পারো মেপে উঠতে! কেউ কেউ আবার রবীন্দ্রঝড়ে নিজেকে মার্কড শেফ দাগিয়ে প্রমাণ করে দেবেন, যে তিনি ঝড়ের কাছেই রেখে দিয়েছেন তাঁর রবীন্দ্র-ঠিকানা। এই যে সোশালের চাল ভাতে বাড়ছে লেখায়, কারণ, অন্তত গত এক দশকে আমাদের পঁচিশের পাক এই চক্রেই আটকে। তবে স্থান-কাল-পাত্র যাই-ই হোক, বাঙালির একটু দ্বন্দ্ব অহর্নিশ না হলেই চলে না কি না! বনাম না থাকলে সকলই পানসে। যেমন মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল; উত্তম বনাম সৌমিত্র; অতএব স্পষ্টই একটা দ্বন্দ্বমূলক রবীন্দ্রবাদের খোঁজ মেলে। একদল বলবেন, এ আবার কী! ‘বছরে তিরিশ বার শ্যামা চিত্রাঙ্গদা আর শাপমোচনের অশ্রুমোচন’ করতে করতে পঁচিশের মহালগ্নে যা হয় তা নেহাত পুজো। কবি কি পুজোর জিনিস! তোমার পুজোর ছলে তোমায় সকলে ভুলে থাকে হে কবি!– বলতে বলতে এই দলের আক্ষেপদীর্ণ মুহূর্তরা বাঙালির কিস্সু হবে না জেনে ঢুকে পড়বে ওটিটিতে, ওয়েব সিরিজের ঘণ্টাপাঁচেক বিনোদনে। অন্যদল তখন বলতে আসবে যে, আরে বাপু ডিজে-য় না ভিজে রবীন্দ্রনাথ নিয়েই তো বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তাতে আপত্তি কীসের! যত মাহাত্ম্য শুকনো পাণ্ডিত্যের! আর যারা সৃষ্টিতে ভিজেছিল, তাদের বুঝি কোনও দামই নেই রে, উঁ?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: অনিশ্চয়তার কারণেই কি রবীন্দ্রনাথের গানে ও পাণ্ডুলিপিতে এত পাঠান্তর?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বঙ্গ হুজুগপঞ্জিকা বলছে, চব্বিশের বিকাল ৪ ঘটিকা হইতে পঁচিশের সন্ধ্যা ৯ ঘটিকা পর্যন্ত এভাবেই বয়ে চলে বাঙালির রবীন্দ্রলগ্ন। পুজো বললে পুজো, প্রেম বললে প্রেম, ট্রেন্ড বললে ট্রেন্ড! আর ২৬ বৈশাখ? সে তো শুকনো মালা সরানোর দিন। হারমোনিয়াম কাঠের ডালায় পুরে রাখার দিন। ‘সঞ্চয়িতা’ তুলে রাখার দিন। রবীন্দ্রনাথকে ভুলে থাকার দিন। এমনকী, বিষণ্ণতার সম্বলও নেই তার। দশমী, তবু বিজয়াসম্মিলনীর আন্তরিকতা নেই। নেহাতই উৎসবহীন রবীন্দ্রনাথের তাই উঠে যেওয়া দেওয়ালের শূন্যস্থানে, একদিনের জন্য যেখান থেকে তিনি নেমে আসেন বঙ্গজীবনে। ফটোফ্রেম আর উদ্ধৃতির ঘেরাটোপ ছাড়া বাকি বছর আর তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই!
প্রিয় পাঠক, এই অসার লেখার ভিতরেও আসলে রবীন্দ্রনাথ কোথাও নাই। পঁচিশের কই-জয়ন্তী পেরিয়ে যদি ছাব্বিশ থেকে বই-জয়ন্তী শুরু হয়, তবে হয়তো তাঁর দিকে খানিক এগোনো যাবে। এদিকে আজ পঁচিশের পাঁচকাহন তো কাল মৃগয়া; রুটি-রুজির ধান্দায় জড়িয়ে পড়ে নাছোড়বান্দা হয়ে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে থাকা যাবে এমন সুযোগ-সৌভাগ্য কোনওটাই এখন বাঙালির নেই। ব্যাপারটা এমনও নয় যে, প্রতিদিন তাঁকে গদগদ আবৃত্তি করলেই রবীন্দ্রপরীক্ষায় লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করা যাবে। তবে তাঁকে শুধু ব্যাজ করে সংস্কৃতির উত্তরীয়তে ঝুলিয়ে রাখলে বাঙালি নিজেকেই বিসর্জন দেব আত্মবিস্মৃতির জলে। অথচ বিসর্জন যে রাজর্ষি আর বিজয়া ওকোম্পো হয়ে উঠতে পারে, বাঙালিই তা জানে; জানে তার রবীন্দ্রনাথ আছে বলেই।
তবে, সকলেই সেই কাল্পনিক ঘাটে এসে দাঁড়ান না, যেখানে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঠাকুরকে। কারণ, এই ঠাকুরপুজোয় বলি রদ হয়নি– রচনাবলি। কেউ কেউ সেসব নিয়ে দিব্যি মেতে রয়েছেন নিশ্চয়ই। তাঁদের জন্য বিজয়া দশমী নেই, তবে আমার তরফ থেকে কোলাকুলি রইল।
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।