শিল্পীর নাম: নিকলাস এলমেহেদ। যদিও লাজুক গলায়, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি জানিয়েছেন, কত আগে বিজয়ীদের নাম জানতে পারেন, সেই গোপন তথ্যটি সকলের সামনে দরাজ করে উন্মুক্ত করা এক্তিয়ার-বহির্ভূত কাজ। গোপনীয়তা এমনই যে, তাঁর স্ত্রী-ও সরকারিভাবে ঘোষণার আগে ঘুণাক্ষরেও টের পান না কারা নোবেল জিতলেন। ২০১৮ থেকে গোল্ড ফয়েল ব্যবহার করে যে প্রতিকৃতিগুলো এলমেহেদ আঁকেন, লক্ষ করলে দেখবেন, সেই সব প্রতিকৃতিতে মুখের ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলগুলিতে তিনি ব্যবহার করেন চকচকে সোনালি রং। সাধারণ আলোয় মুখের যেসব অংশে পড়বে কালো অথবা কালচে ধূসর ছায়া, সেখানে তিনি রাখেন সোনালি।
প্রতি বছর অক্টোবরে নোবেল-বিজেতাদের নাম ঘোষণা হওয়ার পর, নোবেলের সরকারি সাইট-সহ পৃথিবীর তাবড় চ্যানেলগুলিতে দেখা যায়, নোবেলজয়ীদের প্রতিকৃতি কালো-সাদা-সোনালি মিশিয়ে আঁকা সে-বছরের বিজয়ীদের অবয়ব। এ বছরও সাহিত্যে নোবেল জেতা ইয়ান ফসে হোন, পদার্থবিজ্ঞানে পিয়ের অগাস্তিনি অথবা রসায়নে অ্যালেক্সেই একিমভ— তিনটি রঙে আঁকা বিজয়ীদের পোর্ট্রেট জ্বলজ্বল করছে বিভিন্ন সাইটে। কে আঁকেন ছবিগুলো? পোর্ট্রেটগুলোর ঠিক নিচেই আছে শিল্পীর নাম: নিকলাস এলমেহেদ। সুইডিশ এই শিল্পী বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে এঁকে চলেছেন নোবেলজয়ীদের প্রতিকৃতি, তৈরি করেছেন নিজস্ব অঙ্কনপন্থা, যে ধরনে আঁকা ছবি এই এক দশকে হয়ে উঠেছে নোবেল পুরস্কারের নীলকণ্ঠ পাখি— আবিশ্ব মানুষের কাছে দূত হয়ে পৌঁছে দেয় খবর: কারা জিতল এই বছরের পুরস্কার। প্রতিকৃতিগুলোর মতোই খোদ আঁকিয়ে এবং তাঁর আঁকার পন্থাটিও বিস্ময়কর!
সোনালি রং, অন্তত নোবেলজয়ীদের ছবির ক্ষেত্রে, এলমেহেদ নেহাতই একটি ‘রং’ হিসেবে ব্যবহার করেন না; বরং, সোনালি রংটি প্রযুক্ত হয় ছবিতে টেক্সচার যোগ করতে। সাদা কাগজে কালো আউটলাইনের ওপর পাতলা ধাতব গোল্ড ফয়েল ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকেন। জীবন্ত হয়ে ওঠে সদ্য নোবেল পাওয়া মানুষগুলোর মুখ। ২০১৪-’১৭— এই সময়কালটুকুতে যে ছবিগুলো এঁকেছিলেন, তাতে এই তিন রঙের সঙ্গে ছিল নীলের ছোঁয়াও; মনে আছে সাহিত্যে বব ডিলান নোবেল পাওয়ার পর প্রায় অমরত্ব পাওয়া সেই প্রতিকৃতির কথা? ডিলানের মুখের বাঁ-দিকে ছিল কোবাল্ট নীলের প্রলেপ। ২০১৮ থেকে আবার সচেতনভাবে এই ধারা ভাঙেন এলমেহেদ— নীল বাদ দিয়ে শুধু সাদা-কালো-সোনালি ব্যবহার করে ছবি আঁকতে শুরু করেন। ঠিক কবে থেকে শুরু হল নোবেল কমিটির সঙ্গে তাঁর এই পথচলা? সেই ইতিহাস খানিক মজার, আবার বিস্ময়েরও।
২০১২ সালে এলমেহেদকে নোবেল কমিটি নোবেল মিডিয়ার শিল্প-নির্দেশক হিসেবে নিয়োগ করে। সে বছর পুরস্কার ঘোষণার সময়ে সবরকম ভিজ্যুয়াল এলিমেন্ট নির্মাণ এবং দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তেছিল এলমেহেদের ওপর। তখনই গোলমালটা হল। পুরস্কার ঘোষণার সময়ে সব বিজেতার ছবি যাওয়ার কথা, ওদিকে বেশ কয়েকজনের ভালো ছবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উপায়ান্তর নেই দেখে, বাধ্য হয়ে এলমেহেদ নিজেই দ্রুত এঁকে দেন কয়েকটি স্কেচ। তখন কি তিনি জানতেন, ওই ঝটিতি আঁকাগুলোই তাঁকে সরকারিভাবে নোবেল পুরস্কার-প্রাপকদের প্রতিকৃতি আঁকার ছাড়পত্র দেবে? সেই আঁকাগুলি বড় বড় কয়েকটি মিডিয়া হাউজ ব্যবহার করে, তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ২০১৪ থেকেই এলমেহেদের যাত্রা শুরু, সেই থেকে তিনিই এঁকে চলেছেন নোবেল প্রাপকদের প্রতিকৃতি।
যেহেতু তাঁকে প্রাপকদের ছবি আঁকতে হয়, তাই বাকি বিশ্বের মানুষদের থেকে বেশ খানিকটা আগেই তিনি বিজয়ীদের নাম জানতে পারেন। কত আগে চলতি বছরের নোবেল-বিজেতাদের নাম জানতে পারেন এলমেহেদ? শিল্পীকে সব থেকে বেশিবার এই প্রশ্নটিরই সম্মুখীন হতে হয়েছে। লাজুক গলায় ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি জানিয়েছেন, কত আগে বিজয়ীদের নাম জানতে পারেন, সেই গোপন তথ্যটি সকলের সামনে দরাজ করে উন্মুক্ত করা এক্তিয়ার-বহির্ভূত কাজ। গোপনীয়তা এমনই যে, তাঁর স্ত্রী-ও সরকারিভাবে ঘোষণার আগে ঘুণাক্ষরেও টের পান না কারা নোবেল জিতলেন। এলমেহেদকে খুব দ্রুত কয়েকটি পোর্ট্রেট আঁকতে হয়, বেশি সময় তিনি নেন না। কিন্তু কত আগে তাঁর কাছে প্রতিকৃতির মালিকের নাম পৌঁছয়— সে তথ্য এখনও রহস্য। এলমেহেদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ভবিষ্যতে নোবেল-প্রাপক হিসেবে কোন কোন মানুষের মুখ তিনি আঁকতে চান। এলমেহেদ তারও উত্তর দিতে পারেননি। স্বাভাবিক, সরকারিভাবে তিনি যেখানে গোটা প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, তাঁর যে কোনও ব্যক্তিগত পছন্দ পক্ষপাত-তত্ত্ব উত্থানের পথ প্রশস্ত করতে পারে। প্রতিটা মন্তব্য নিয়ে তাঁর সচেতনতা প্রমাণ করে, বিষয়টায় ঠিক কতখানি গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়।
প্রায় এক দশক ধরে এঁকে চলেছেন নিকলাস এলমেহেদ। সাদা কাগজের ওপর কালো কয়েকটা আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন অবয়ব-কাঠামো, তার ভেতরে মাপমতো ঢেলে দেন সোনালি রং। এই প্রতিকৃতি সমার্থক হয়ে গেছে নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে, এই ধাঁচ হয়ে উঠেছে নোবেল পুরস্কারের প্রতিনিধিস্থানীয় চিত্ররীতি। ২০১৮ থেকে গোল্ড ফয়েল ব্যবহার করে যে প্রতিকৃতিগুলো এলমেহেদ আঁকেন, লক্ষ করলে দেখবেন, সেই সব প্রতিকৃতিতে মুখের ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলগুলিতে তিনি ব্যবহার করেন চকচকে সোনালি রং। সাধারণ আলোয় মুখের যেসব অংশে পড়বে কালো অথবা কালচে ধূসর ছায়া, সেখানে তিনি রাখেন সোনালি। ছায়া তো আদপে মানুষের অস্তিত্বের প্রতীক। মানুষ অতীত হয়ে ভূত হলে তার ছায়া পড়ে না, কারওর ছায়া পড়ছে মানে তিনি আছেন। আর সেই ছায়ার রং যদি গড়পড়তা কালো না হয়ে ধারণ করে উজ্জ্বল সোনালি বর্ণ? তা থেকে কি এ-ই প্রমাণিত হয় না, এই মানুষের নশ্বর শরীর একদিন পঞ্চভূতে বিলীন হলেও, তাঁর ছেড়ে যাওয়া সমস্ত কাজ রয়ে গেল মানুষের জন্য, রয়ে গেল মানুষের কাছে? একবারের জন্যও কি মনে হবে না, তিনি চলে গেলেও রয়ে গেল তাঁর ছায়া, আশ্বাসদায়ী, পথ-প্রদর্শক উজ্জ্বল আলো হয়ে? নোবেল পুরস্কার-মারফত সারা বিশ্বের স্বীকৃতি পাওয়া মাত্র তাঁর নামটি রচিত হল স্বর্ণাক্ষরে, তাঁর সত্তাটি থেকে যাবে পৃথিবীর শেষতম মানুষটি শ্বাস নেওয়াতক। মানুষের মুখের সেই ছায়াকে নশ্বর কালো থেকে বের করে, এলমেহেদ মুড়ে দেন সোনালি মোড়কে; একটি চরিত্রকে উত্তীর্ণ করেন অমরত্বে।
মানবজাতির সোনার সন্তানদের সাদা-কালো মুখের ছায়ায় সোনালি রং ঢেলে, তাঁদের অমরত্ব দেন নিকলাস এলমেহেদ— যাঁর আঁকা প্রতিকৃতিতে জানা যায় কে জিতলেন নোবেল, কে হলেন অমর।
সন্দীপদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘How was the experience?’ পরিষ্কার উত্তর দিলেন, ‘I loved the chaos of the city.’ আসলেই ক্যাওসের মধ্য থেকেই তো বিভিন্ন দৃশ্যের জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্নবীকরণ ঘটে– আমরা হয়তো বা অনেক সময় তা দেখেও দেখি না। সেখানেই তো সত্যজিৎ বা উইমের মতো দৃশ্যনির্মাণকারীর দক্ষতা, অনন্যতা ও বিভিন্নতা। তাঁদের চোখ খুঁজে পায় এমন জিনিস যা আমাদের নতুন দৃশ্য ও দৃশ্যমানতা সম্বন্ধে ভাবায়।