ঋতুর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নির্দিষ্ট স্মৃতি, ফিরে আসে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই। সেরকমই এক শীতে বদলে গিয়েছিল ভারতের সম্প্রীতির নকশী-কাঁথা। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২। বাবরি মসজিদ ভাঙা ও তারপর কী জানি, কোথা থেকে সন্ধে হলেই বাড়িতে ঢিল পড়ার বিভীষিকাময় স্মৃতি, শীতের প্রতিটি রাতে হাড়ের ভিতরে কান্নার রোল তোলে। শীতের একাকী বিষণ্ণ রাতগুলো ফিরে নিয়ে আসে সেই স্মৃতি।
কুয়াশার সকাল। গুনগুন সুরে কী যেন গাইছে সকাল। বাঁশগাছের কানে হাওয়া বলছে নতুন দিনের গল্প। আর ঘন বাঁশবাগানে এক-অপরকে ছুঁয়ে থাকা পাতাগুলো হারমোনিয়ামের তারের মতো, একে অপরকে ছুঁয়ে পৌঁছে দিচ্ছে সুর, বিরান চড়ে। এক কৃষক, তিস্তা নদীর পাড়ে মন দিয়ে গই টানছে মাঠে। আলু থেকে সদ্য বেরনো পাতাগুলোয় সাদা শিশির, রাতের অবশিষ্ট চিহ্ন হয়ে তখনও বিরাজমান। ইউরোপের শীতের মতো।
শীত, ধূসর মৃত্যু হয়ে আমাদের ছোঁয় না। বরং নানা রঙের ফুলে ভরিয়ে দেয় প্রকৃতির কোল। এই ক’মাস কৃষক থাকবে তিস্তার চড়ে, খড়ের ছই দেওয়া ঘরে। সব সবজি তুলে বর্ষা নামার আগে ফিরবে বাঁধের ও-পারে স্থায়ী বাসায়।
তিস্তার চড় যেন রামধনু এসময়। সবুজ লিকলিকে ঝাউপাতার মতো চেরা পাতার নিচে মাটির তলায় গাজর। হাঁসের মতো এক জায়গায় থম মেরে বসে, শুধু ওপরের দুটো ডানা একটু মেলে বসে বাঁধাকপি। ডেইজি থেকে গাঁদা, সবই ঝুলে থাকে বারান্দায়। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে কালা নুনিয়া চালের গন্ধ। বাতাসে যেন নতুন পায়েসের ওম।
যে কোনও ঋতুর মতো শীতও নিয়ে আসে শ্রেণি দ্বন্দ্ব। শীতে, শ্রেণি-বৈষম্য আরও প্রকট। দরিদ্র আর ধনী-ব্যক্তির ফারাক বেশি বোঝে শীতকাল। আজও পাতলা ফিনফিনে শুধুই মাদ্রাসার পোশাক পরে আসে সপ্তম শ্রেণির নাম না জানা ছাত্র। তার নাম হয়তো শীতকাল। তাই তার বুকে কফ জমে জ্বর নামে না মাঝ-রাতে। নাকি তারও জ্বর হয়, আমি জানতে চাই না কোনও দিন। কেন গরম পোশাক পরিসনি? জানতে চাইলে যে বলে, স্কুলে পরে আসার মতো গরম পোশাক নেই, তার কাছে বেশি জানতে চাওয়ার হিম্মত আর হয় না। আমার দামি জ্যাকেটের ভেতরেও একফালি শীত ঢুকে, এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় শিরদাঁড়া। শীতের বুকে হারিয়ে যায় কত নাম, অজানা হয়ে কাঁপতে কাঁপতে। প্ল্যাটফর্মে, পার্কের বেঞ্চে, ফুটপাতে… নামহীন অস্তিত্বের কাফনে হারিয়ে যায়, আমলকি গাছের ঝরাপাতার মতো বা রোদের কাছে শিশিরের হারিয়ে যাওয়ার মতো, নিঃশব্দে।
শীতের সাদা সোনা আলুতে, লাভের লোভে ফটকা-খেলা কৃষক লোন নেয় চড়া সুদে। বাড়ি বাড়ি, পাড়ায় পাড়ায় ভিড় করে নতুন বাইকে চেপে লোন-মাস্টার আর সার-এজেন্সির লোক। সারের কালোবাজারি আর মুনাফাখোর মিডলম্যানরা তৈরি হিমঘরের দখল নিতে। কম দামে কিনে স্টোর করে রাখবে কৃষকের শ্রম, তারপর সেই শ্রম থেকে মুনাফা লুঠবে এই লুটেরা শ্রেণি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
শীতকালেই লাঠি নিয়ে ঠুকতে ঠুকতে পৌষালু-র গান গাইতে গাইতে পাশের পাড়ার ছেলেরা আলু, চাল, পয়সা নিতে আসে বাড়ি বাড়ি। তারা এ-বছরেও এল ইংরেজি বছরের শেষদিন রাতে। কৃষক তাদের ব্যাগে ভরে দেয় চাল। সেই চাল বিক্রি করে, তারা খাবে পৌষালু (পিকনিক)। ধর্ম নির্বিশেষে তারা সবার বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করে তাদের পৌষালু-র আনাজপাতি। জলপাইগুড়ি জেলার এ এক বিরল প্রথা কিন্তু চলছেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যেমন বেঁচে আছে বুড়াবুড়ির মেলা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তবুও শীতের গহ্বরে আছে উষ্ণতা। একে অপরকে ছুঁয়ে, যে উষ্ণতা আমাদের পার করিয়ে দেয় কঠিন সময়। শীতকালেই লাঠি নিয়ে ঠুকতে ঠুকতে পৌষালু-র গান গাইতে গাইতে পাশের পাড়ার ছেলেরা আলু, চাল, পয়সা নিতে আসে বাড়ি বাড়ি। তারা এ-বছরেও এল ইংরেজি বছরের শেষদিন রাতে। কৃষক তাদের ব্যাগে ভরে দেয় চাল। সেই চাল বিক্রি করে, তারা খাবে পৌষালু (পিকনিক)। ধর্ম নির্বিশেষে তারা সবার বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করে তাদের পৌষালু-র আনাজপাতি। জলপাইগুড়ি জেলার এ এক বিরল প্রথা, কিন্তু চলছেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম। যেমন বেঁচে আছে বুড়াবুড়ির মেলা।
শীতকালে তেমন কোনও বড় মেলা না থাকলেও গ্রামের মাঝে আজও বসে বুড়াবুড়ির মেলা, পৌষ সংক্রান্তির দিনে। ওপার বাংলা থেকে এপারে আসা মানুষজনের বাস গ্রামের এই প্রান্তরে। শান্ত, সরল, আর সারাদিন খাটুনিতে অভ্যস্ত এই মানুষগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে বুড়াবুড়ির মেলা। আড়ম্বরে নয়, আন্তরিকতায়। ঢাকার ধামনাই-এর বিখ্যাত বুড়াবুড়ির মেলা থেকে এই বুড়াবুড়ির মেলা কি না, জানা নেই। তবে যতটুকু জানা যায়, এই মেলার সঙ্গে আছে বনবিবির যোগ। বনবিবি, যাকে সুন্দরবনের লোক ভক্তিভরে ডাকেন বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে। কেউ পুজো করেন বনবিবির আবার কেউ দোয়া চেয়ে নেন বনবিবির কাছ থেকে। বনজীবীদের কাছে বনবিবি রক্ষাকারী। বাঘের হাত থেকে বনবিবি বাঁচিয়ে রাখেন বনজীবীদের। এই বনবিবি কালের আবর্তে নাম পালটে হয়ে গিয়েছে বুড়াবুড়ি। আবার কারও মতে, বুড়াবুড়ি শিব-পার্বতীর রূপ।
আমার কাছে বুড়াবুড়ি মেলা মানেই ছোটবেলার সেই উষ্ণ স্মৃতি। পিঁয়াজি আর পাঁপড় কেনা আর খেতে খেতে বাড়ি ফিরে আসা। বাড়ি ফিরেই হিন্দু প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাওয়া গরম পুয়া -পুলিতে কামড়।
ঋতুর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নির্দিষ্ট স্মৃতি, ফিরে আসে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই। সেরকমই এক শীতে বদলে গিয়েছিল ভারতের সম্প্রীতির নকশী-কাঁথা। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২। বাবরি মসজিদ ভাঙা ও তারপর কী জানি, কোথা থেকে সন্ধে হলেই বাড়িতে ঢিল পড়ার বিভীষিকাময় স্মৃতি, শীতের প্রতিটি রাতে হাড়ের ভিতরে কান্নার রোল তোলে। শীতের একাকী বিষণ্ণ রাতগুলো ফিরে নিয়ে আসে সেই স্মৃতি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ২২ জানুয়ারির জন্য যখন দেশ অপেক্ষায়, তখন ৬ ডিসেম্বরের স্মৃতি অনেকটাই ফিকে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আবার প্রতিটি পৌষ সংক্রান্তিতে যোগেন কাকুর বাড়ির নরম পিঠের গন্ধ, গুড়ের মিঠে স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়ে ভরসা যোগায়।
সেরকমই আমাদের শীত সাক্ষী বাঙালির জয়ের। রুগ্ন, জীর্ণ, হাড় জিরজিরে বাঙালিও যে পারে জয় ছিনিয়ে আনতে শীতের পাঁজরে! এই শীতকালেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানকে হারিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল জয়। এক সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।
তেমনই এই শীতেও হয়তো বাঙালিরা রুখে দেবে সব অশুভ প্রচেষ্টা। মন্দির-মসজিদ ইস্যুতে প্রভাবিত না হয়ে বাঙালি হয়তো বুঝে নিতে চাইবে উন্নয়নের হিসেব। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ থেকে ২২ জানুয়ারি, ২০২৪– অনেকটা পথ। ২২ জানুয়ারি, ২০২৪– এবারেও শীতকাল। নকশিকাঁথার সুতোয় বিনুনি কেটে আবার বাঙালি কি আঁকবে এক সম্প্রীতির নকশিকাঁথা? বাঙালি কি ছিঁড়ে ফেলে দেবে ঘৃণার আখ্যান? বদলে কি গাইবে আবার গান, স্বাধীনতার, মুক্ত কণ্ঠে এই শীতকালে?
‘…বলো উলঙ্গতা কোনো স্বাধীনতা নয়
বলো দূঃখ কোনো স্বাধীনতা নয়,
বলো ক্ষুধা কোন স্বাধীনতা নয়,
বলো ঘৃণা কোন স্বাধীনতা নয়।’
(নির্মলেন্দু গুণ)