রবীন্দ্রনাথের নোবেল খুঁজতে কলকাতার এই দোকানে এসেছিলেন তদন্তকারীরা। সেদিনের ঘটনার কথা বলতে বলতে মৃদু হাসলেন আরশাদ। প্রশ্ন ছিল, ‘ভয় করেনি?’ একটুও না-ভেবে উত্তর, ‘না!’ কারণ, তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যে জিনিসের খোঁজ করতে পুলিশ তাঁর দোকানে এসেছে, তা আর ভারতে নেই। কেন এমন মনে হওয়া, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। ধরে নেওয়া যেতে পারে, এই ব্যবসায় চুল পাকিয়ে আরও অনেক কিছু সম্পর্কেই পোক্ত ধারণা জন্মেছে তাঁর। দামী জিনিস চুরি গেলে তাঁর ঠিকানা কোথায় হতে পারে, তা মোটের উপর আন্দাজ করতে পারে আরশাদের মতো মানুষজন! সে প্রসঙ্গ অবশ্য আলাদা, নিজের মুখেই জানালেন অভিজ্ঞতার দাম কত, সেই কুড়ি হাজার একশো বিয়াল্লিশ টাকা!
২০০৪, এপ্রিল
খুব বেশি বেলা হয়নি তখনও। পার্ক স্ট্রিটের একটা দোকানের সামনে থামল একজোড়া কালো গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমেই গটগট করে ভিতরে ঢুকলেন কয়েকজন। পোশাক বা চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই– এঁরা কারা? কিছুক্ষণের মধ্যে একই জায়গায় এসে থামল একটা পুলিশের জিপ। সেখান থেকেও কয়েকজন উর্দিধারী নামলেন, কয়েকজন ঢুকলেন দোকানের ভিতরে, কয়েকজন বাইরে। ভিতরে কী হচ্ছে, জানতে উৎসুক জনতা, ততক্ষণে ভিড় জমাতে শুরু করেছে দোকানের বাইরে। ভিড় থেকে কেউ পুলিশকেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘ভিতরে কী হচ্ছে স্যর?’ সপাট উত্তর, ‘সিবিআই এসেছে!’
২০১১, সেপ্টেম্বর
দুর্গাপুজোর সপ্তাখানেক বাকি। পার্ক স্ট্রিটের এক দোকানের সামনে থামল একজোড়া হাওয়াই চটি। গায়ে মলিন জামা, হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন রমেশবাবু। সোজা হাজির হলেন মালিকের সামনে। হাত পেতে বললেন, ‘টাকাটা পাওয়া যাবে?’ খুট করে চাবি খোলার শব্দ, খুলে গেল সিন্দুক, ভিতর থেকে বেশ কয়েকটা একশো টাকার নোট বের করে রমেশবাবুর হাতে রাখলেন দোকানের মালিক। চমকে উঠে টাকা গুনলেন রমেশ, কুড়ি হাজার একশো বিয়াল্লিশ। মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল ঘরের চেহারা। পিছন ঘুরে দৌড় লাগালেন রমেশবাবু, তার পিছনে দোকানের মালিক, ‘আরে, মশাই ছুটছেন কেন… দাঁড়ান!’
২০২৪, নভেম্বর
আইপিলের নিলাম হয়েছে সদ্য। পার্ক স্ট্রিটের একটা দোকানের সামনে থামল একজোড়া উৎসুক চোখ। দোকানের সামনে থাকা সেকেলে সাইনবোর্ডে লেখা, ‘অকশন হাউস’। মনে প্রশ্ন, ‘এখানেও নিলাম হয়? আইপিএলের মতোই?’ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে ভিতরে ঢোকা। লোকজন নেই বললেই চলে, কয়েকজন নিজের মতো কাজ করছেন। প্রশ্ন করে জানা গেল, এঁরা কেউ আইপিএলের খোঁজ রাখেন না, তবে নিলাম সম্পর্কে এঁদের বিস্তর জ্ঞান! যতই হোক, প্রায় ৮৪ বছরের অভিজ্ঞতা বলে কথা!
পার্ক স্ট্রিটের ওই দোকানের নাম ‘দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ’। উপরিউক্ত তিনটি ঘটনা আমার ব্যক্তিগত সময়সফরের অভিজ্ঞতা। সময়ের হিসাবে একটু গরমিল থাকতে পারে, তবে কাহিনিতে এতটুকু খাদ নেই। সত্যি সত্যিই রাসেল এক্সচেঞ্জে পুলিশ এবং সিবিআই হানা হয়েছিল। এখান থেকে টাকা নিয়ে দৌড়েছিলেন রমেশবাবুর মতো আরও অনেকে। ঘটনার বৈচিত্রে কলকাতার এই প্রাচীনতম নিদর্শন অনেকটা অভিধানের মতো, একটা করে পাতা ওল্টালে নতুন কিছু সামনে আসবে। দোকানে অবশ্য নতুন জিনিস সংখ্যায় কম। পুরনো গন্ধ মাখা আভিজাত্যের ছড়াছড়ি চারদিকে। খাট, টেবিল আলমারি, সিন্দুক… কী নেই! এমন অনেক কিছু রয়েছে, যার দাম শুনলে মরা হাতিও লজ্জা পাবে! যদিও সেসব কেনার লোক সংখ্যায় কমেছে। এই নিয়ে আক্ষেপ না থাকলেও চাপা হতাশা রয়েছে দোকানের বর্তমান মালিক আরশাদ সেলিমের। যদিও এই ব্যবসা পারিবারিক, তাই আলাদা করে দাদা আনোয়ার সেলিম এবং সরফরাজ বেগমের নাম উল্লেখ করেছেন আরশাদ। এই নিয়ে দ্বিতীয় প্রজন্ম ব্যবসা সামলাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে দোকানের কর্মচারীরাও বংশানুক্রমে এই দোকানের কাজে যুক্ত। প্রথমে এমন কথা শুনে বইয়ে পড়া জমিদারদের কথা মনে পড়ছিল, সেই সময়ই চোখ গেল দূরে রাখা একটা আরামকেদারার দিকে, পাশ থেকে এক বয়স্ক কর্মী ফিসফিস করে বললেন, ‘কাটোয়ার এক জমিদার ওই চেয়ারে বসেই রোদ পোহাতেন… এর বয়স আন্দাজ ১০০ বছর!’
আদৌ এই কথা সত্যি কি না, জানা নেই। তবে এই নিলামঘর যে ইতিহাসের বহু ঘটনার জীবন্ত দলিল, তা বলাই যায়। প্রথম ঘটনার প্রসঙ্গে ফিরি– ২০০৪ সাল, ভারতবাসীর কাছে একটা মনে রাখার মতো বছর। নাহ্ না, এই বছরে কোনও ভারতীয় নোবেল পাননি, বরং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি গিয়েছিল। তা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ, চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব! সেই সময়েই রাসেল এক্সচেঞ্জে সিবিআই হানা! ঠিক ধরেছেন, রবীন্দ্রনাথের নোবেল খুঁজতেই কলকাতার এই দোকানে এসেছিলেন তদন্তকারীরা। সেদিনের ঘটনার কথা বলতে বলতে মৃদু হাসলেন আরশাদ। প্রশ্ন ছিল, ‘ভয় করেনি?’ একটুও না ভেবে উত্তর, ‘না!’ কারণ, তিনি নিশ্চিত ছিলেন, যে জিনিসের খোঁজ করতে পুলিশ তাঁর দোকানে এসেছে, তা আর ভারতে নেই। কেন এমন মনে হওয়া, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। ধরে নেওয়া যেতে পারে, এই ব্যবসায় চুল পাকিয়ে আরও অনেক কিছু সম্পর্কেই পোক্ত ধারণা জন্মেছে তাঁর। দামি জিনিস চুরি গেলে তাঁর ঠিকানা কোথায় হতে পারে, তা মোটের উপর আন্দাজ করতে পারে আরশাদের মতো মানুষজন! সে প্রসঙ্গ অবশ্য আলাদা, নিজের মুখেই জানালেন অভিজ্ঞতার দাম কত, সেই ২০,১৪২ টাকা!
ঘটনা প্রায় বছর ১২ আগেকার। যদিও ঠিকমতো সময়ের হিসাব দিতে পারেননি আরশাদ। স্মৃতি থেকে ভাসা ভাসা তথ্য নিয়ে কাহিনি পেশ করেছিলেন মাত্র। তাতে না ছিল চরিত্রের নাম, না ছিল সঠিকভাবে সময়ের বিবরণ। তবে যেভাবে ঘটনার কেন্দ্রে থাকা চরিত্রকে দেখিয়েছেন তিনি, তাতে ধরে নেওয়া যেতেই পারে, ইনি একজন মধ্যবিত্ত বাঙালি। নাম রমেশচন্দ্র হালদার, নিবাস মধ্য কলকাতা। আর পাঁচটা বাঙালির মতো রমেশবাবুরও দুর্গাপুজোর আগে টাকার দরকার পড়েছিল। এমন সময় বাড়ির পুরনো কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেশ কয়েকটা বই জড়ো করেন তিনি। পাতা উল্টে বুঝে যান, এসব তার কাজের জিনিস নয়, সুতরাং বেচে দাও! অন্য কোথাও বিক্রি করলে হয়তো তেমন দাম পাওয়া যাবে না, তাই ব্যাগে ভরে সেই বই নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের নিলামঘরে হাজির হন রমেশ। শর্ত একটাই, নিলামে বিক্রি হওয়া জিনিসে কিছু পরিমাণ কমিশন রেখে বাকি টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। তারও সময়সীমা রয়েছে, বড়জোর ২ সপ্তাহ। এর মধ্যে বিক্রি না হলে জিনিস ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে বিক্রেতাকে। সব শর্ত মেনে রাজি হন রমেশ, আশা ছিল মোটের উপর দু’-তিনশো টাকা রোজগার হবে! কিন্তু আসলে হয়েছিল একেবারে অন্যরকম এক কাণ্ড! তাঁর দেওয়া বইগুলোর মধ্যে থেকে আরশাদের জহুরির চোখ খুঁজে নিয়েছিল বিশেষ এক বই। তিনি জানতেন এই বই বিক্রি হবে মোটা টাকায়। বাস্তবে হয়েওছিল তাই! বাকি সব বই মেরেকেটে ১৪০-১৫০ এর মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল। স্রেফ ওই একটা বইয়ের দাম উঠল ২০ হাজার টাকা। সপ্তাহ ঘুরতে রমেশবাবু এলে তিনি যখন টাকাটা দিলেন, বেজায় চমকে ওঠেন তিনি। এত টাকা তাঁর বই বিক্রি করে হতেই পারে না! হয়তো ভুল করে এই টাকা তাঁর হাতে দিয়ে দিয়েছেন আরশাদ, তাই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দৌড় লাগান রমেশ। কিন্তু আসল সত্যিটা তাঁকে জানাতেই হত, তাই পিছন পিছন ধাওয়া করতে বাধ্য হন আরশাদ। সবটা খোলসা করে বললে বেজায় অবাক হন রমেশ নিজেও। এমন ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে, কারও আবার এই ধরনের অভিজ্ঞতার পর নিলামঘরের যাতায়াত নিয়মিত হয়েছে। তাতে লাভ হয়েছে দু’পক্ষেরই, একদিকে দোকানে এসেছে পুরনো জিনিস, অন্যদিকে দুর্দান্ত নিলামের সাক্ষী থেকেছে রাসেল এক্সচেঞ্জ।
তবে এখন সময় বদলেছে। নিলাম বোধহয় আইপিএলেই মানায়। মুখ ফুটে না বললেও আরশাদের আক্ষেপ সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল। প্রশ্ন ছিল, এই সময় কারা আসেন নিলামঘরে? আরশাদ জানালেন, ‘সমাজের সর্বস্তরের মানুষ’। বিক্রি হতে পারে যা খুশি! আরশাদের কথায়– ছেঁড়া চটি থেকে রাজার চেয়ার, সবই বিক্রি হতে পারে এই নিলামঘরে। দোকানের কর্মীদের কাছে শুনলাম এই যা খুশি বিক্রির বিবরণ! মোটের উপর যা বুঝলাম, ফি রোববার এখানকার পরিস্থিতি অনেকটা মাছের বাজারের মতোই হয়ে ওঠে। ২০০ টাকা দামের একটা ছবি নিয়ে রীতিমতো বাকযুদ্ধ চলে অনেকের। তাঁদের গলা ছাপিয়ে যায় টেবিলে হাতুড়ির শব্দ, যা কানে এল মানেই বুঝে নিতে হবে, এ জিনিস এবার অন্য কারও। রাসেল এক্সচেঞ্জে মূলত পিরিয়ড পিস রাখা হয়। অর্থাৎ, এমন জিনিস, যার বয়স অন্তত ১০০ বছর। সবসময় তা হবেই তার মানে নেই, তবে এইসব অ্যান্টিকের আলাদা গুরুত্ব।
তা এত পুরনো জিনিসের মাঝে কি অভিশপ্ত কিছু থাকতে পারে না? আরশাদ একপ্রকার হেসেই ওড়ালেন এই প্রশ্ন। বললেন, ‘ওসব শুধু সিনেমায় হয়!’ উল্টে ইঙ্গিত করে দেখালেন একটা পুরনো খাট– এখানেই নাকি একসময় আয়েশ করে ঘুমোতেন বাগবাজারের মিত্তির মশাই! তিনি আর নেই, তবে তাঁর সাধের খাট রয়ে গিয়েছে। ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকালেও মিত্তির মশাই জাতীয় কারও আত্মাকে দেখতে পাইনি। একইভাবে ঘুরে ঘুরে পুরনো ছবি দেখার সময়ও মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সেখানে থাকা ছোট্ট মেয়েটা কিছু বলে উঠবে!
তবে এরকম কিছু হয়নি, দোকানের মধ্যেও না, বাড়ি ফিরে ঘুমের ঘোরেও না।
শুধু আরশাদ নন, এইসব ভূত-প্রেত, অভিশাপের কথা হেসে উড়িয়েছেন দোকানের কর্মচারীরাও। তাঁরাও প্রায় একই সুরে বললেন, ‘ওসব শুধু সিনেমা আর গল্পে হয়!’ কিন্তু এসবের দাম কেমন হতে পারে? প্রশ্ন ছিল, দোকানঘরে সবথেকে দামি জিনিস কী? ইশারা গেল, একটা ঝাড়বাতির দিকে, এর দাম পাঁচ লক্ষ টাকা! খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই, কেন এত দাম, তার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতার চশমা! দামি জিনিসের তালিকায় একে একে এল নানা আসবাব। কাঠের চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল, খাট, আরাম কেদারা আরও কত কী! সবই অরিজিনাল বার্মাটিক উড, লাখের নিচে নয় একটারও দাম।
সব আসবাব যে নিলামের জন্য, তা নয়। কিছু কিছু এমনিই কেনা যায়, দোকানের ঠিক করা দামেই কিনতে হবে সেসব। তার জন্য কোনও নির্দিষ্ট দিনে আসতে হবে এমন নিয়ম নেই। তবে নিলাম হয় প্রতি রোববার। অনেক সময় হয়ও না আবার! কখনও জিনিসের অভাব, কখনও ক্রেতার। সেই প্রসঙ্গ ধরেই আরশাদ আক্ষেপের সুরে জানালেন, এখন আর তেমন কাস্টমার কোথায়! অন্যান্য ব্যবসার মতো এখানেও থাবা বসিয়েছে ই-কমার্স সাইট। অনলাইনে পুরনো জিনিস মিলছে, মানুষ আর নিলামঘরে আসবে কেন! দোকানের পুরনো কর্মচারীরাও সে কথায় সায় দিলেন। একইসঙ্গে কয়েকটা বড় বাক্স দেখিয়ে তাঁরা বললেন, ‘এসব কিনলে কোথায় রাখবে বলুন?’
……………………………………………..
এত পুরনো জিনিসের মাঝে কি অভিশপ্ত কিছু থাকতে পারে না? আরশাদ একপ্রকার হেসেই ওড়ালেন এই প্রশ্ন। বললেন, ‘ওসব শুধু সিনেমায় হয়!’ উল্টে ইঙ্গিত করে দেখালেন একটা পুরনো খাট– এখানেই নাকি একসময় আয়েশ করে ঘুমোতেন বাগবাজারের মিত্তির মশাই! তিনি আর নেই, তবে তাঁর সাধের খাট রয়ে গিয়েছে। ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকালেও মিত্তির মশাই জাতীয় কারও আত্মাকে দেখতে পাইনি। একইভাবে ঘুরে ঘুরে পুরনো ছবি দেখার সময়ও মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সেখানে থাকা ছোট্ট মেয়েটা কিছু বলে উঠবে!
……………………………………………..
চোখ গেল আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য জিনিসের দিকে। একটা রং চটে যাওয়া গ্রামোফোন, পুরনো দিনের ল্যান্ডলাইন টেলিফোন সেট, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা সুবিশাল পালঙ্ক, কয়েক জায়গার সুতো ছিঁড়ে যাওয়া আরামকেদারা, লতাপাতার কাজ করা দেরাজ-আলমারি, বিরাট মাপের আয়না বসানো ড্রেসিং টেবিল, ঝাড়লণ্ঠন, শ্বেতাঙ্গ নারীমূর্তি, পাশাপাশি বসে থাকা দুটো বিড়ালছানা, সার দিয়ে রাখা পোর্সেনিল প্লেট, পুজোর ঘণ্টা, ছোট্ট পিতলের সিংহাসন– সবকিছু বড্ড চুপচাপ। প্রাণহীন, নিস্তব্ধ। আসলে এইসব জিনিস দেখভালের খরচ অনেক। এককালে বাড়িতে অনেক চাকর-বাকর থাকত, তারাই সব কিছু গুছিয়ে রাখত। তাঁরা আর বাড়িতে নেই, তাই এইসব জিনিসের ঠিকানা নিলামঘর। দোকানের এইসব জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে কাশীধামের কয়েকটা বাড়ির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। গঙ্গার ধারে সেইসব বাড়িতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেন জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ। সমাজে তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, মৃত্যু যতই দেরিতে আসুক, তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসবে না কেউ। এইসব আসবাবেও একসময় প্রাণ ছিল। আজ সেসব বিক্রির অপেক্ষায় দিন গুনছে।
বাইরে তখন সন্ধে হব হব। যে দোকানে পাঁচ লাখি ঝাড়বাতি রয়েছে, সেখানে আলো তেমন জোরালো নয়। একটু ভিতরে ঢুকলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে ভালোমতো। দোকানির কথায়, এর আলো জ্বেলে লাভ নেই, আশপাশের অন্যান্য নিলামঘরের মতো এখানেও কবে চিরতরে আলো নিভে যায়, তা জানা নেই! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অনেকটা বদলেছে ‘দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ’। আজকাল নতুন জিনিসও বিক্রি হয় এখানে, সেসবও সাধারণ নয় মোটেই। হাল আমলের ডবল ডোর ফ্রিজ থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের জিনিসও রয়েছে। বিক্রির সময় বলে দেওয়া হয় কোনটা নতুন কোনটা পুরনো। সপ্তাহের অন্যান্য দিন সেইভাবে ক্রেতার ভিড় চোখে পড়ে না, তবে রবিবারের ব্যাপারটা আলাদা। নিলামের সময় অভ্যাসের টানেই অনেকে হাজির হন দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জে, এখনও। ছুটির দিনে একের পর এক ঝাঁ চকচকে পানশালা পেরিয়ে স্যাঁতসেতে এই দোকানে ঢোকা কম ব্যাপার নয়। তাও আসেন কেউ কেউ, আর তাঁরা আসেন বলেই টিকে রয়েছে ১৯৪০-র এই দোকান। অবশ্য যদি কেউ নাও আসে, পুরনো এক সময়, অপেক্ষা করে চলবে। চলবেই।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..