একটা কাগজের টুকরো, সরকারি নথি আজ আমাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের ‘চাবিকাঠি’। যা আমজনতার ‘বাঁচা-মরা’-কে সংজ্ঞায়িত করছে সব সময়। আধার কার্ড, প্যান কার্ডের চক্করে হাঁসফাঁস করছে গোটা দেশ। পরাধীনতার শৃঙ্খল-মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত যে সংবিধান তৈরি করেছিল, তার প্রস্তাবনায় ছিল রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকার কথা। জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিল ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’-কে। অথচ বাস্তবে জনগণের অধিকার ভূলুণ্ঠিত।
১৮৯২ সাল। প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’ অর্থাৎ, বেঁচে থাকার প্রমাণ দিতে কাদম্বরীকে সত্যিই মরতে হয়েছিল।
কাট টু ২০২৪। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। বাঁচা-মরার দোদুল্যমানতায় ‘খাবি’ খেতে হচ্ছে অনেককেই। ঘুরতে হচ্ছে প্রশাসনের দরজায়-দরজায়।
সাহিত্যে-সিনেমায় এমন অনেক ঘটনার কথাই আমাদের জানা। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘ম্যায় জিন্দা হুঁ’। অভিনয়ে ছিলেন পঙ্কজ কাপুর, দীপ্তি নাভাল, অলোক নাথরা। যেখানে এক ব্যক্তির বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। স্বামী মৃত ভেবে স্ত্রী যখন সহকর্মীর প্রেমে পড়েছেন, তখনই স্বামী ফিরে আসেন। সামাজিক ইস্যুতে সেরা চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল ছবিটি।
২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছিল সতীশ কৌশিকের পরিচালনায় ‘কাগজ’। আমিলো মোবারকপুরের ছোট গ্রামের কৃষক লাল বিহারীর জীবন ও সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল। যাঁকে সরকারি কাগজপত্রে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯ বছরের দীর্ঘ লড়াই ও আমলাতন্ত্রের সঙ্গে টানাপোড়েন শেষে তিনি নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বাস্তবের ছবিটা কিন্তু প্রায় একই রকম। দু’একটি ঘটনা ফিরে দেখা যেতে পারে। পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী-২ ব্লকের কুবাজপুর গ্রামের বেগম বিবি। দিব্যি বেঁচে আছেন। পেতেন বিধবা-ভাতাও। অথচ পঞ্চায়েত থেকে তাঁকে মৃত বলে ব্লক প্রশাসনকে রিপোর্ট পাঠায়। বিডিও-র হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি পাঠানোর পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সমস্যা মিটেছে কি না, জানা নেই। মালদা জেলার হরিশচন্দ্রপুর-১ ব্লকের মহেন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েতেও একই ঘটনা। বেঁচে থাকা বৃদ্ধা ‘মৃত’ বলে ঘোষিত রেশন তালিকায়। মিলছে না রেশন। স্থানীয় রেশন ডিলারের বিরুদ্ধে বিডিও-র কাছে অভিযোগ দায়ের করেন বৃদ্ধা জেলেখা বেওয়া। বিডিও বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন।
…………………………………………………………………
মিঠোরা গ্রামের বাসিন্দা বাবুরামের নামে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইস্যু হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ‘জীবিত’ বলে প্রমাণ করতে পারেননি। তাই ভিন্ন পথ ধরেন তিনি। ডজন খানেক ছোট-বড় অপরাধ ঘটিয়ে ফেলেন। শেষেরটি তো চরম। ছুরি, পেট্রোল বোমা নিয়ে স্থানীয় স্কুলে ঢুকে দুই শিক্ষককে আক্রমণ করেন। যারে জেরে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ব্যস, বাবুরাম এখন চিন্তামুক্ত। কারণ, আইনের চোখে তিনি ‘অপরাধী’ হলেও সরকারি নথিতে ‘জীবিত’।
…………………………………………………………………
একটু তাকানো যাক ভিনরাজ্যের দিকে। সেখানে ছবি কিন্তু আরও ভয়ংকর, অবর্ণনীয়। যে লাল বিহারীর জীবন নিয়ে ‘কাগজ’ তৈরি হয়েছিল, সেই গ্রামে তিনি একা নন। সরকারি নথিতে অনেককেই মৃত বলে দেখানো হয়েছিল। লাল বিহারী উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের ‘জীবিত’ প্রমাণ করার চেষ্টা করায় তাঁকে নিয়মিত প্রাণনাশের হুমকি পেতে হচ্ছে। বেশিদিন নয়, মাত্রই গত বছরের ঘটনা। বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার জন্য একে ৪৭ রাইফেল রাখতে আবেদন জানিয়ে তিনি চিঠি লেখেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যসচিবের কাছে। সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে তাঁর নিজের কাকা ঘুষ দিয়ে সরকারি নথিতে তাঁকে ‘মৃত’ বলে দেখিয়েছিলেন। এমনকী, দূরে দাঁড়িয়ে নিজের শ্রাদ্ধ করতেও দেখেন লাল বিহারী! এমন ঘটনা রয়েছে অজস্র।
রাজস্থানের বালোত্রার বাবুরাম ভিলের কাহিনি আরও মারাত্মক। মিঠোরা গ্রামের বাসিন্দা বাবুরামের নামে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইস্যু হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ‘জীবিত’ বলে প্রমাণ করতে পারেননি। তাই ভিন্ন পথ ধরেন তিনি। ডজন খানেক ছোট-বড় অপরাধ ঘটিয়ে ফেলেন। শেষেরটি তো চরম। ছুরি, পেট্রোল বোমা নিয়ে স্থানীয় স্কুলে ঢুকে দুই শিক্ষককে আক্রমণ করেন। যারে জেরে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ব্যস, বাবুরাম এখন চিন্তামুক্ত। কারণ, আইনের চোখে তিনি ‘অপরাধী’ হলেও সরকারি নথিতে ‘জীবিত’! যে বাবুরাম হয়তো কোনওদিন কাউকে উঁচু গলায় কথা বলেননি, সরকারি গাফিলতির জেরে আজ তাঁকেই জেলে যেতে হবে। পাকাপাকিভাবে গায়ে সেঁটে যাবে ‘অপরাধী’ তকমা। নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে থানায়। একটা মানুষ কতটা মরিয়া হলে এমন কাজ করতে পারে, তার কোনও ধারণা আছে ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা শীর্ষ আমলা, নীতি নির্ধারক মাতব্বরদের!
……………………………………………………………….
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর কপি: চোট সারানোর সময় নেই, তাই আঙুল বাদেও দ্বিধাহীন ম্যাথিউ ডসন
……………………………………………………………….
একটা কাগজের টুকরো, সরকারি নথি আজ আমাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের ‘চাবিকাঠি’। যা আমজনতার ‘বাঁচা-মরা’-কে সংজ্ঞায়িত করছে সব সময়। আধার কার্ড, প্যান কার্ডের চক্করে হাঁসফাঁস করছে গোটা দেশ। পরাধীনতার শৃঙ্খল-মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত যে সংবিধান তৈরি করেছিল, তার প্রস্তাবনায় ছিল রাষ্ট্রের কল্যাণকামী ভূমিকার কথা। জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছিল ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’-কে। অথচ বাস্তবে জনগণের অধিকার ভূলুণ্ঠিত। সংবিধান যে ন্যায়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কথা বলছে, তার বিপরীত প্রেক্ষিত তৈরি হচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে। নাগরিকপঞ্জি তৈরি হলে কী হতে পারে, অসম তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। এ দেশের কত মানুষের কাছে জন্ম-মৃত্যু-শিক্ষার পর্যাপ্ত নথি রয়েছে? বাড়ির দলিল, পাসপোর্ট?
আবার অন্য দেশ থেকে এসে বেআইনিভাবে আধার, প্যান কার্ড, পাসপোর্ট বানানোর অভিযোগও রয়েছে প্রচুর। সমীক্ষা বলছে, নগরোন্নয়ন ও শিল্পায়নের আগ্রাসনে বিভিন্ন শহরের বিরাট অংশ উচ্ছেদের শিকার হন। স্থায়ী বাসস্থান, পানীয় জল, শিক্ষা-সহ নাগরিক পরিষেবা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। অথচ তাঁরাও এই দেশেরই মানুষ, নাগরিক। অনেকের ভোটাধিকার রয়েছে। কিন্তু এই উদ্বাস্তু তথা উচ্ছিষ্ট মানুষরা কি পারবেন পাহাড়প্রমাণ সরকারি নথি পেশ করে নিজেদের ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করতে? রাষ্ট্র তাঁদের পুনর্বাসন দিতে ব্যর্থ। এরপর কি তাঁদের বেঁচে থাকার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হবে?
তা বলে কি নাগরিকের কোনও পরিচয়পত্র বা নথির প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু নাগরিকদের কাছে সেই নথি পৌঁছে দেওয়া সরকারের কর্তব্য। তাদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু সে কাজে সরকারি অনীহা অপরিসীম। পরিকাঠামো তথৈবচ। তার ওপর রয়েছে দুর্নীতির সংগঠিত চক্র। উল্টে নানা সময় ‘বাংলাদেশি নয় তো’ বা ‘নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা’র মতো শব্দবন্ধও শুনতে হয় ভুক্তভোগীদের। ২০১৫-র ১১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, আধার বাধ্যতামূলক নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, আধার ছাড়া আমআদমি ‘অচল’। কোনও সরকারি পরিষেবা তো দূর অস্ত, ব্যাঙ্কেও কল্কে পাবেন না।
কথায় বলে– ‘ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই’। তারই যেন সার্থক উদাহরণ হয়ে উঠছে, একবিংশ শতকের উন্নত ভারত।
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………….