দু’দশক আগে পর্যন্ত রেলকর্তাদের চিন্তাভাবনার ভরকেন্দ্রে ছিলেন সাধারণ মানুষ। নামকরণেই তার প্রমাণ। জনতা এক্সপ্রেস, হামসফর, শ্রমজীবী এক্সপ্রেস। কিন্তু এখন ‘টার্গেট’ বদলে গিয়েছে। এখন কর্তাদের মুখে ক্রমাগত শুধু ‘বন্দে ভারত’, ‘বুলেট ট্রেন’। রেলকে লাভজনক করতে হবে। তার উপায় বেসরকারীকরণ, আউটসোর্সিং। নিট ফল অপ্রতুল কর্মী, রেলের স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও রেললাইনের সুরক্ষার সঙ্গে আপোস।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
‘রেল কম ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম!’ শৈশবে এই ছড়াটি শোনেনি বা বলেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! এই ছড়া আওড়াতে আওড়াতেই রেলগাড়ি তথা ট্রেন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়েছিল। স্বপ্ন দেখতাম, ট্রেনে চেপে মাঠঘাট, খেতের ফাঁক দিয়ে চলেছি কোন সুদূরে। পিছনে সরে যাচ্ছে গাছপালা। ঝমঝম করে ট্রেন পেরিয়ে যাচ্ছে নদীর ওপরের পুল, ট্রেনের দুলুনিতে চোখে ঘুমের ঘোর নেমে আসছে।
উপমহাদেশে রেল চালু হয়েছিল ব্রিটিশদের হাত ধরে। এক সময় রেলগাড়ি ছিল এক রোমাঞ্চকর বিস্ময়। কত সৃষ্টিসুখের উল্লাস। ‘পথের পাঁচালী’-তে অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার বিস্ময়ই হোক বা রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’র রোমান্টিকতা– ‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,/ ভাবিনি সম্ভব হবে কোনেও দিন। আগে ওকে বারবার দেখেছি/ লাল রঙের শাড়িতে/ ডালিম ফুলের মতো রাঙা,/ আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,/ আঁচল তুলেছে মাথায়…’।
কিন্তু স্টেশনে দাঁড়িয়ে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, অনিশ্চয়তা বাড়তে থাকে, তখন কি আর রোমাঞ্চ জাগে? ভারতীয় রেলওয়ের শৈশবে যা ছিল কষ্টকল্পনা, যৌবনের মধ্যগগনেও যা ছিল অধরা, বুড়ো থুত্থুড়ে হয়ে তার সেই স্বভাব পাল্টাবে, এ ভাবনা আশা করাই বৃথা। তাই মনে পড়ে যায় রুনা লায়লার গান– ‘ইস্টিশনের রেল গাড়িটা/ মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা/ প্ল্যাটফরমে বইসা ভাবি/ কখন বাজে বারোটা’।
১৮৫৩ সালে ভারতীয় রেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যা বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম রেল পরিবহণ ব্যবস্থার অন্যতম। যাকে আক্ষরিক অর্থেই দেশের ‘লাইফ লাইন’ বলে অভিহিত করা যায়। গড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটি যাত্রী এবং ৫০ লক্ষ টনেরও বেশি পণ্য ভারতীয় রেলপথে চলাচল করে। কিন্তু সে-জন্য উপযুক্ত পরিষেবা আদৌ রেল দেয় কি? সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই নিত্যদিন একের পর এক দুর্ঘটনা, অন্য কোনও না কোনও বিপত্তির খবর চোখে পড়বে। ২০১৪ সালে বিশাখাপত্তনম থেকে উত্তরপ্রদেশের বাস্তি যেতে একটি পণ্যবাহী ট্রেন লেট করেছিল সাড়ে তিন বছর! ক’দিন আগেই বিহারের গয়া জেলার ওয়াজিরগঞ্জে ট্রেনের ইঞ্জিন বেলাইন হয়ে সোজা চলে গিয়েছিল পাশের মাঠে! নেহাত কপাল ভালো, তার সঙ্গে কোনও কামরা ছিল না। আবার কিছুদিন আগে কলকাতা-অমৃতসর দুর্গিয়ানা এক্সপ্রেস ‘পথ হারিয়ে’ সোজা অন্য রুটেই চলে গেল!
আধ ঘণ্টা ভুল লাইনে চলার পর দুর্গিয়ানা এক্সপ্রেসের চালক গোলমাল বুঝতে পারেন। এতটা সময় রেলকর্মী থেকে কর্তা, কেউ বুঝতেই পারলেন না ট্রেন ভুল পথে চলছে! ওই লাইনে অন্য ট্রেন চলে এলে কী বিপত্তি ঘটত, তা সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গত, গত বছর জুনে ওড়িশার বাহানাগায় সিগন্যালিংয়ে গোলমালের জেরেই করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়েছিল। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় প্রায় তিনশো মানুষের।
…………………………………………………………….
১৮৫৩ সালে ভারতীয় রেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যা বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম রেল পরিবহন ব্যবস্থার অন্যতম। যাকে আক্ষরিক অর্থেই দেশের ‘লাইফ লাইন’ বলে অভিহিত করা যায়। গড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটি যাত্রী এবং ৫০ লক্ষ টনেরও বেশি পণ্য ভারতীয় রেলপথে চলাচল করে। কিন্তু সে-জন্য উপযুক্ত পরিষেবা আদৌ রেল দেয় কি? সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই নিত্যদিন একের পর এক দুর্ঘটনা, অন্য কোনও না কোনও বিপত্তির খবর চোখে পড়বে।
…………………………………………………………….
এভাবেই দিনের পর দিন, কোথাও না কোথাও ট্রেন বেলাইন হচ্ছে, উল্টে যাচ্ছে। মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর পাশাপাশি রয়েছে নাশকতার ছক। গত কয়েকদিন ধরেই দেশের নানা প্রান্তে রেললাইনে মিলছে ডিটোনেটর, লোহার রড, গ্যাস সিলিন্ডার। কোনও মতে এড়ানো গিয়েছে বড় ধরনের বিপর্যয়। কিন্তু তাতে রেলকর্তাদের আদৌ কোনও হেলদোল আছে? ১৯৫৬ সালে আরিয়ালুর দুর্ঘটনার দায় নিয়ে ইস্তফা দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ১৯৯৯ সালে গাইসালের দুর্ঘটনার পর পদত্যাগ করেন নীতীশ কুমার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গ্রহণ করেননি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ব্যস্, সেখানেই শেষ। অথচ, প্রায় প্রত্যেক মন্ত্রীর আমলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এবং সেই সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে। তারপর চলে ‘বলির পাঁঠা’ খোঁজার পালা। এত কিছুর পরেও কোনও দিন বড় কোনও কর্তার চাকরি যায় না। হয় কোনও গেটম্যান, না-হয় লাইনম্যান, ট্রেনের চালক বা গার্ডের ঘাড়ে কোপ পড়ে। খুব বেশি হলে স্টেশন মাস্টার। তার উপরের আধিকারিক, হাতে গুণে বলা চলে।
আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা আদৌ কি রেলকে অগ্রাধিকার দেন? প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কারণ, ট্রেনের সওয়ার আমজনতা। নীতিনির্ধারকরা তো চলেন আকাশপথে। রেলের সংস্কার তাই দুয়োরানি। এর পিছনে তাদের কোনও ফন্দি আছে কি না, সেটাও বুঝে নেওয়া দরকার।
দু’দশক আগে পর্যন্ত রেলকর্তাদের চিন্তাভাবনার ভরকেন্দ্রে ছিলেন সাধারণ মানুষ। নামকরণেই তার প্রমাণ। জনতা এক্সপ্রেস, হামসফর, শ্রমজীবী এক্সপ্রেস। কিন্তু এখন ‘টার্গেট’ বদলে গিয়েছে। এখন কর্তাদের মুখে ক্রমাগত শুধু ‘বন্দে ভারত’, ‘বুলেট ট্রেন’। রেলকে লাভজনক করতে হবে। তার উপায় বেসরকারিকরণ, আউটসোর্সিং। নিট ফল অপ্রতুল কর্মী, রেলের স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও রেললাইনের সুরক্ষার সঙ্গে আপোস। যদিও সরকারি নানা রিপোর্টেই রেলের পরিকাঠামো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারা ফুটে উঠেছে, তবুও দায় নিতে অনীহা কর্তাদের। লোক না থাকায় অনেক সময় চালক ও গার্ডরা টানা ১২ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করছেন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাচ্ছেন না।
নতুন নিয়োগ বন্ধ, চুক্তিভিত্তিক শ্রমশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি ও যথেচ্ছ আউটসোর্সিং। এর ফলে কর্মী সংখ্যা কমছে অস্বাভাবিক হারে। একটি আরটিআই অনুসারে গ্রুপ সি-তে ১৪,৭৫,৬২৩ পদের মধ্যে ৩.১১ লক্ষ ফাঁকা রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ট্র্যাকম্যান, সিগন্য়াল অপারেটর, সিগন্যাল অপারেটরের মতো পদ। ফলে যাত্রী সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে গাফিলতি থেকে যাচ্ছে।
………………………………………………
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: পাথর নাকি প্রাণ, মানুষের বিচারসভায় পরীক্ষা ভগবানেরও
………………………………………………
২০২০ সালে ভারতীয় রেলের সুরক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বহু বিজ্ঞাপিত সংঘর্ষরোধী প্রযুক্তি ‘কবচ’। কিন্তু বাহানাগায় দুর্ঘটনার পর জানা গিয়েছে, রেলের ৯৮ শতাংশ রুটেই এই প্রযুক্তির কাজ শুরু হয়নি। যদি রেলওয়ে ট্র্যাকের আধুনিকীকরণ, উন্নত সিগন্যালিং ব্যবস্থা, দুর্ঘটনার অভিঘাত সহ্য করতে সক্ষম এলএইচবি কোচ বাধ্যতামূলক করার মতো সুরক্ষার প্রাথমিক ব্যবস্থা হত, তাহলে অবশ্যই ভারতীয় রেলের সুরক্ষা সংক্রান্ত পরিকাঠামোর খোলনলচে পাল্টে যেত। কিন্তু বাস্তবের ছবিটা একেবারে উল্টো। বিলাসবহুল, তীব্র গতির ট্রেন চালানোর চেষ্টা হচ্ছে শতাব্দী প্রাচীন রেললাইনে! সোজা কথায় ভারতীয় রেলে এখন ‘গরিব হটাও’ প্রকল্প চলছে। পৃথক মন্ত্রক তুলে দেওয়ার পর চেষ্টা চলছে ভারতীয় রেলকে কর্পোরেট সংস্থায় পরিণত করার। যেখানে শুধুই নজর মুনাফা, ঝাঁ-চকচকে চেহারায়। অবহেলিত যাত্রী সুরক্ষা, স্বাচ্ছন্দ্য, আধুনিকীকরণ।
যার নিট ফল, আমআদমির সবচেয়ে নির্ভরতার ‘দেশের জীবনরেখা’ কার্যত পরিণত হয়েছে নরকযন্ত্রণায়। যেখানে পদে পদে মৃত্যুর হাতছানি। তাই যতই ‘গাড়ি বুলা রহি হ্যায়, সিটি বাজা রহি হ্যায়’, সেই রোমান্টিকতা ভুলেই ট্রেনের অনিশ্চিত যাত্রার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে। এটাই আমাদের ভবিতব্য।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………