রেলওয়ের মোটামুটি ৮৪০টি প্রোজেক্ট আপাতত লেটে রান করছে। তাও এক-দু’দিন নয়, প্রকল্প শেষ হতে গড়ে ৩৬ মাস করে দেরি হবে বলে আন্দাজ কর্তৃপক্ষের। এই গড় হিসেবকে টেনেটুনে দেখলে দেখা যাবে, এর মধ্যে রয়েছে ললিতপুর-সাতনা-রেওয়া-সিংরৌলি রেললাইন পাতার কাজ, যা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরও ১৬ বছর পরে গিয়ে শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আবার উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা প্রোজেক্টের গল্প সত্যি সত্যিই বিশ বাঁও জলে, থুড়ি বিশ বছর পিছিয়ে পড়েছে। দেরি করে এই দেরি নিয়ে লেখা, ছাপাও হল খানিক দেরি করেই।
কোন ব্যাপারে ভারতীয় রেল আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সফল? উত্তর: লেট করায়। কেনই বা হবে না? আমাদের দু’পায়েই কম কেলোর কীর্তি ঘটে! রেলের তো অত্তগুলো চাকা, তবু সে হতভাগা সময়-নড়বড়ে। তার ওপর বস্তুটার সরণ বলতে শূন্য! কে একই রাস্তায় দিনের পর ধাঁ করে যায় আর আসে? এ বড় বোরিং কাজ, যাই বলুন। ফলে, পেটের মধ্যে যতই মানুষ বা মালপত্তর থাকুক না কেন, একটু আশপাশ দেখতে দেখতেই ট্রেনের এই ঢিমে তাল। দেশের যে-ক’টি রাজ্যে হুড়মুড়িয়ে লোকাল ট্রেন চলে, তার মধ্যে চেনা জায়গা ব’লে এই বাংলার কথাই বলি।
এক-একদিন এই বঙ্গ-ট্রেন আদ্যন্ত জাদুবাস্তব। পিছনে হাঁটতে হাঁটতে ঘড়ির কাঁটা পৌঁছে যায় সেই আমলে, যখন যোগাযোগ ছিল গরুর গাড়ির। চলে ধিকিয়ে ধিকিয়ে। এ ট্রেনে চেপে বসলে মার্কেজ এমনিতেও জানতে পেরে যেতেন, কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না কেন, কারণ দেরির ঠেলায় সে চিঠির আর এসে পৌঁছতই না কোনও দিন! ধরুন, ভ্রূপল্লবে ডাক এসেছে, এদিকে চন্দনের বনে পৌঁছতেই দেরি হয়ে গেল পাক্কা ৩৬ মাস! কী কাণ্ড বলুন তো! যদিও শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘দেরি করে যে এসেছে, ইচ্ছে করে ভালবাসি তাকে’; কিন্তু মনে রাখবেন, কবিতার নাম ছিল ‘নালিশ’! তেড়ে বকে দিতেই গিয়েছিলেন, নেহাত কলম ধরলেন, আর সেই তালে হিংসা পগারপার! কিন্তু ওদিকে ভ্রূপল্লবে যে ডাক দিয়েছিল চন্দনের বনে, সে নির্ঘাত কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে প্রেম করে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার করেছে। হয়তো সন্তানের নাম দিয়েছে ‘মোগলি’।
কবিদের অবশ্য দেরি করা স্বভাবসিদ্ধ। বাঙালির অত্ত বড় কবি জী-দা বনলতা সেনের কাছে পৌঁছতেও এত দেরি করে ফেললেন যে নাটোরের কন্যা চোখ তুলে বললেন, এতদিন কোথায় ছিলেন? কেন হেঁটেছিলেন তিনি, বুঝুন, সেও নিশ্চয়ই কোনও ট্রেনযাত্রার ওপর রাগ করেই হবে হয়তো। শোনা যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বহুবার বাড়ি ফিরতে দেরি করেছেন, আর পরে জানা গিয়েছে হঠাৎ করেই পাড়ি দিয়েছেন চাইবাসায়। দেরি করে আসা যে অন্য কোথাও যাওয়ার আরেক নাম– এই সংগত যুক্তি কবিদেরই অধিগত। সত্যি বলতে, অন্যদের মনে এইসব হাজির-জবাব আসতেও বড্ড দেরি করে ফেলে। অনেকটা সরকারি অফিসের মতোই। না হলে বলতে হত, পথই যদি না এগোয়, তাহলে পথে দেরি না হয়ে উপায় আছে!
‘লেটলতিফ’ বলে বাঙালির ভারি বদনাম! সে প্রবল অলস, ভাতঘুমে জব্বর নামকরা। ডেলিভারির সময় যতই সে প্রিম্যাচুওর হোক না কেন, এই লেট করা নাকি তার জন্মগত অধিকার। তক্ক-বাংলা সিনেমা-সংস্কৃতি এমনকী, ভাষা– সব-হারানো জীবনে সেইটুকু অধিকার সে প্রখর দাবিতে বুঝে নেয়। সকালে তার বাথরুমে দেরি, ফলত বাজারে যেতেও। ভিড় খামচে পছন্দসই বাজার সারতে দেরি, আবার কেতরে পড়া কাতলা আর কানা বেগুন নিয়ে ফিরলে মনকষাকষির ঠেলায় সেকেন্ড রাউন্ড চা হতেও দেরি। এই করতে করতে অফিসের জন্য বাড়ি থেকেও বেরোতে দেরি। অটোর লাইনে তো দেরি না হয়ে উপায়ই নেই! মাইনের দিনটা আসতে কত দেরি, আর তার জন্য কোন কোন কাজকে দেরির খাতায় ঠেলে দেওয়া যাবে, সেই ডেবিট-ক্রেডিট মেলানো যায় লাইনে দাঁড়ানোর বাড়তি সময়েই। এর মাঝে অফিসে যদি-বা বেতন বাড়ে, তা চালু হতে দেরি। সরকারি হলে ডিএ পেতে দেরি, তবে দরকারি কাজ ক’জনই বা তাড়াতাড়ি করে, এই ভেবেই ক্ষমাঘেন্না করে নেওয়া। বোনাসে দেরি হলে পুজোর কেনাকাটাতেও দেরি। দেরির দৌরাত্ম্যে তার দিনবদলের আশাও ক্রমশ পিছিয়ে যায়। দিনরাত পরিশ্রম করে, তবু তার বোধোদয়ে দেরি। যখন হয়, হাত থেকে ফসকে গিয়েছে অনেক কিছুই। তবু দেরিরোগ সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না। তবে পথে কাঁটা ছড়ানো থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছতে দেরি না হয়ে উপায় আছে! এই যেমন ধরুন না, ঘুমোতে যেতে যতই দেরি হোক, ঘুম ভাঙার সময় অবধারিতভাবে কানে আসবেই– দেরি হয়ে গেল! ছুটির দিনে ইচ্ছেমতো ‘ল্যাদ’ খেতে গেলে ভাত খেতে দেরি হওয়া নিয়ে গজগজানি। কেবল ইচ্ছেমতো দেরি করার অধিকার পাওয়ার জন্যই নিজের বাড়ি পেতে সাধ জাগে, আর তারপর দেরি হওয়া নিয়ে চোখ রাঙায় ইএমআই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘লেটলতিফ’ বলে বাঙালির ভারি বদনাম! সে প্রবল অলস, ভাতঘুমে জব্বর নামকরা। ডেলিভারির সময় যতই সে প্রিম্যাচুওর হোক না কেন, এই লেট করা নাকি তার জন্মগত অধিকার। তক্ক-বাংলা সিনেমা-সংস্কৃতি এমনকী, ভাষা– সব-হারানো জীবনে সেইটুকু অধিকার সে প্রখর দাবিতে বুঝে নেয়। সকালে তার বাথরুমে দেরি, ফলত বাজারে যেতেও। ভিড় খামচে পছন্দসই বাজার সারতে দেরি, আবার কেতরে পড়া কাতলা আর কানা বেগুন নিয়ে ফিরলে মনকষাকষির ঠেলায় সেকেন্ড রাউন্ড চা হতেও দেরি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে এই আলস্য কি বাঙালির একার? গোটা ভারত দিব্যি কর্মরত-ঘর্মরত? মোটেই না। এই আলস্য-আখ্যানে বাঙালিকে জুড়ে গিয়ে বাকি ভারত বরং নাক ডাকছে। উদাহরণ চাই? তা বেশ, খবর বলছে, রেলওয়ের মোটামুটি ৮৪০টি প্রোজেক্ট আপাতত লেটে রান করছে। তাও এক-দু’দিন নয়, প্রকল্প শেষ হতে গড়ে ৩৬ মাস করে দেরি হবে বলে আন্দাজ কর্তৃপক্ষের। এই গড় হিসেবকে টেনেটুনে দেখলে দেখা যাবে, এর মধ্যে রয়েছে ললিতপুর-সাতনা-রেওয়া-সিংরৌলি রেললাইন পাতার কাজ, যা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরও ১৬ বছর পরে গিয়ে শেষ হবে বলে আশা। আবার উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা প্রোজেক্টের গল্প সত্যি সত্যিই বিশ বাঁও জলে, থুড়ি বিশ বছর পিছিয়ে পড়েছে। মানে ভাবুন, জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার! তা রিপ ভ্যান উইঙ্কল যেখানে ২০ বছর ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিল, সেখানে কেউ চলতে চলতে ২০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে কপিরাইট ইস্যুতে শাহরুখ খান ছাড়া কে কী বলবে! আর এই বিরাট হিসেবের নিরিখে দেখলে ৩৬ মাস তো বেশ তাড়াতাড়িই, কী বলেন?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ‘ঘাটিয়া’ কি বাংলা বিশেষণের তকমা পাবে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অতএব, হে বাঙালি, এবার যে ব্যাপারেই মুখ বুজে থাকুন না কেন, আলস্যের বিশ্বকাপখানা কেউ হাতে তুলে দিতে চাইলে সপাটে মুখঝামটা দিন! দেরি করুন, অপূর্ব এক দেরি, যাতে বাঙালির মৃত্যুদিন কখনও না এসে পৌঁছয়।