আর্য হোক বা দ্রাবিড়, তাঁরা সকলেই কিন্তু অন্য স্থান থেকে ‘ভারত’ নামের ভূখণ্ডে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। কেউ আগে, কেউ বা পরে। এটাই যা পার্থক্য। বস্তুত যে কোনও সভ্যতা-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেন অভিবাসীরা। ঐতিহাসিকভাবেই অভিবাসন বহু দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির কারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পরিকাঠামো উন্নয়ন এতটা সম্ভব হত না, যদি না অভিবাসী শ্রমিকরা না থাকতেন।
ভারতের সবচেয়ে ক্ষুদ্র রাজ্য গোয়া। যদিও পর্যটনস্থল হিসেবে বিশ্বজুড়ে তার নাম। আর সেই রাজ্যের ‘শিশু’ রাজনৈতিক দল ‘রেভেলিউশনারি গোয়ানস পার্টি’, নথিভুক্ত হয় ২০২২ সালে। গত বিধানসভা নির্বাচনে ৩৮টি আসনে প্রার্থী দিয়ে মাত্র একটিতে জয়। কিন্তু সেই অকিঞ্চিৎকর আঞ্চলিক দলের সদ্য প্রকাশিত নির্বাচনী ইস্তেহারই ফের খুঁচিয়ে তুলেছে বহু বিতর্কিত অভিবাসী বনাম ভূমিপুত্র ইস্যু।
দলটির সোজাসাপ্টা বক্তব্য, পরিযায়ী-অভিবাসীরাই রাজ্যের যাবতীয় সমস্যার মূল। কংগ্রেস-বিজেপির মতো জাতীয় দলগুলি এ-বিষয়ে মুখ খুলবে না। তাই রাজ্যের স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বার্থরক্ষা করতে পারে একমাত্র তারাই। রাজ্যের জমি-পরিচিতি-সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিবাসীদের ‘বাড়বাড়ন্ত’ রুখতে হবে। ভূমিপুত্রদের জীবন-জীবিকার মান উন্নয়ন করার ঘোষণাও করেছে তারা।
বিষয়টি নতুন নয়। কিন্তু বিপজ্জনক।
গোয়ার ভূমিপুত্র! নিজস্ব সংস্কৃতি! আর্য, দ্রাবিড়দের সঙ্গে স্থানীয়দের মিশ্রণে গোয়ার সংস্কৃতির প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে গোয়া কখনও মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে, অশোকের সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। কখনও ছিল চালুক্য, রাষ্ট্রকূট ও বিজয়নগরের সাম্রাজ্যের অধীন। বিচ্ছিন্নভাবে বাহমনির সুলতান ও বিজাপুরের আদিল শাহ গোয়ায় কর্তৃত্ব করেছেন। পরবর্তী সময়ে ১৫১০ থেকে গোয়ায় পর্তুগিজ শাসন কায়েম হয়। যা চলে ১৯৬১ পর্যন্ত। তাহলে গোয়ার নিজস্ব সংস্কৃতি কী? হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ, সবকিছুই মিশে আছে গোয়ার সংস্কৃতিতে। ৪৫০ বছরের পর্তুগিজ শাসনের ঐতিহ্যই যদি ধরা যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, পর্তুগিজরা কবে গোয়ার ভূমিপুত্র হল? তারাও তো ঔপনিবেশিক শাসক, দখলদার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পরিকাঠামো উন্নয়ন এতটা সম্ভব হত না, যদি না অভিবাসী শ্রমিকরা না থাকতেন। অভিবাসীদের অবদানে ‘উন্নত’ আমেরিকার দিকে তাকান। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, এনরিকো ফেরমি মতো বিজ্ঞানী, খলিল জিব্রান-এর মতো সাহিত্যিক, বব মার্লের মতো শিল্পী, ইলন মাস্ক, গুগল-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন, রুপার্ট মারডকের মতো শিল্পপতি, জ্যাকি চ্যান, আর্নল্ড সোয়ার্জনেগার থেকে আন্তোনিও ব্যানদেরাস, সালমা হায়েকের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রী– তালিকা দীর্ঘ থেকে শুধু দীর্ঘতরই হবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জীবন-জীবিকা-খাদ্যের জন্য অভিবাসীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া, নতুন সভ্যতা-দেশ গঠন, এটাই ইতিহাসের রীতি। আধুনিক হোমোসেপিয়েন্স ‘মানুষ’ আফ্রিকা থেকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারাই নানা সময় ভূ-প্রাকৃতিক কারণে বিভিন্ন জনজাতিতে ভাগ হয়ে যায়। অর্থাৎ আফ্রিকা ছাড়া বাকি গোটা বিশ্বের মানুষই আদতে ‘অভিবাসী’। হরপ্পা সভ্যতা কারা সৃষ্টি করেছিলেন, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কিন্তু আর্য হোক বা দ্রাবিড়, তাঁরা সকলেই কিন্তু অন্য স্থান থেকে ‘ভারত’ নামের ভূখণ্ডে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। কেউ আগে, কেউ বা পরে। এটাই যা পার্থক্য। বস্তুত যে কোনও সভ্যতা-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেন অভিবাসীরা। ঐতিহাসিকভাবেই অভিবাসন বহু দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির কারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পরিকাঠামো উন্নয়ন এতটা সম্ভব হত না, যদি না অভিবাসী শ্রমিকরা না থাকতেন। অভিবাসীদের অবদানে ‘উন্নত’ আমেরিকার দিকে তাকান। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, এনরিকো ফেরমি মতো বিজ্ঞানী, খলিল জিব্রান-এর মতো সাহিত্যিক, বব মার্লের মতো শিল্পী, ইলন মাস্ক, গুগল-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিন, রুপার্ট মারডকের মতো শিল্পপতি, জ্যাকি চ্যান, আর্নল্ড সোয়ার্জনেগার থেকে আন্তোনিও ব্যানদেরাস, সালমা হায়েকের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রী– তালিকা দীর্ঘ থেকে শুধু দীর্ঘতরই হবে।
বস্তুত অভিবাসীদের নিয়ে এই সমস্যা শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই। এবং যুগে যুগে তা নিয়ে বিবাদ ঘটেছে। যেমন আমেরিকায়। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান দিয়ে অভিবাসীদের আটকাতে সীমান্তে বেড়া দেওয়া থেকে শুরু করে কঠোর আইন আনা, কী করেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প! অথচ সেই তিনিই কিন্তু জার্মান ও স্কটল্যান্ড থেকে আসা অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তান। তাঁর বর্তমান স্ত্রী মেলানিয়া স্লোভেনীয়। ২০০৬ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। আমেরিকা আদতে ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ব্রিটেন থেকে আসা অভিবাসীরা বিদ্রোহ করে এবং আদি-বাসিন্দাদের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করে বর্তমান আমেরিকার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: সংস্কৃত ভাষার জ্ঞানপীঠ জুটলেও রাজনীতির কল্যাণে ভুল ব্যাখ্যা কিছু কমবে না
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মুখে জার্মান জাতীয়তাবাদের কথা বললেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অ্যাডলফ হিটলারের উত্থানের নেপথ্যে ছিল প্রবল ইহুদি-বিরোধিতা। তার সঙ্গে কি গোয়ার এই রাজনৈতিক দলটির সামঞ্জস্য মিলছে না? জাতিসত্তা ও মারাঠি অস্মিতা নিয়ে একইভাবে সরব ছিল শিবসেনা। যার ধারা কিছুটা বজায় রেখেছে মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা। বাংলায় গোর্খাল্যান্ড, কামতাপুর, নাগাল্যান্ডে আন্দোলন হয়েছে। এখনও রক্তাক্ত মণিপুর। অতীতে ভাষা ও জাতিগত কারণে আন্দোলন হয়েছে অসমে। খলিস্তান আন্দোলনে রক্ত ঝরেছে পাঞ্জাবে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও আঞ্চলিকতাবাদ ও দ্রাবিড় সংস্কৃতির পক্ষে সমর্থন যথেষ্ট প্রবল। এভাবে চললে ভবিষ্যতে ভারত নামে কোনও যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বই থাকবে না। দেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ যারা এই ধরনের পৃথক জাতিসত্তায় বিশ্বাসী, তারা কি নিজেদের ভারতীয় বলে গর্ববোধ করেন? ‘ভারতীয়’ বলতে তাঁরা কী বোঝেন? ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁদের কী ধারণা? এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, চিন, শক, হুন, পাঠান, মোগল যে লীন হয়ে গিয়েছে এক দেহে, সেই বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের বাস্তবতা ও ইতিহাস কি এত সহজে মুছে ফেলা সম্ভব?
সংকীর্ণ স্বার্থে জাতিগত অস্মিতার এই আস্ফালন সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দা হয়তো ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আদৌ কোনও লাভ হবে কি?