রবিশঙ্করের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল একটি তহবিল সংগ্রহকারী কনসার্টের আয়োজন করা, যার মাধ্যমে যদি ২৫,০০০ আমেরিকান ডলার সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু হ্যারিসনের পরিকল্পনা ছিল আরও বড়– মার্কিন ও ব্রিটিশ রক সংগীতশিল্পী এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সমন্বয়ে এক তারকা-সজ্জিত কনসার্ট, যা অনুষ্ঠিত হবে নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। কনসার্টের দিন ঠিক হয়– ১ অগাস্ট, ১৯৭১।
১৯৭১ সালের শুরুর দিকে ঘটনা। রবিশঙ্কর তাঁর বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে দেখা করতে যান তাঁর নতুন কেনা লন্ডনের শহরতলিতে ফ্রাইয়ার পার্ক ম্যানসনে। ডিনারের সময় তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশের দুর্দশা নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়। সাতের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষা এবং বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের দৃঢ় প্রত্যাখ্যান। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক এবং তাঁর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর বর্বরতা। রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত এক চরম দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা। কলকাতা এবং তার উপকণ্ঠে শরণার্থীর ঢল। রবিশঙ্কর ভাবতেও পারেননি যে, হ্যারিসন এতটা সংবেদনশীল ভাবে বিষয়টি বুঝতে পারবেন, বিশেষ করে যখন এটি ছিল হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের একটি তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি। এমন একটি জাতির কাহিনি, যারা নিজেদের পরিচয়ের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, নিজরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
জুন মাসের শেষের দিকে, ‘সানডে টাইমস’-এ পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখা একটা প্রতিবেদন বের হয়। ‘Genocide’ নামক প্রতিবেদনটিতে, তিনি বিস্তারিত তুলে ধরেন বাংলাদেশের অবস্থা। সরকারপক্ষের প্রচারের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে ১০ দিনের ঢাকা সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তিনি গিয়ে যা দেখেন, সেটা প্রকাশ করার জন্য তিনি করাচি না ফিরে, সপরিবারে লন্ডনে পালিয়ে যান, এবং সেখানে গিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতার এক বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন ‘সানডে টাইমস’-এ। পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যমে এই প্রথম বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে কোনও লেখা প্রকাশিত হয়।
রবিশঙ্করের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল একটি তহবিল সংগ্রহকারী কনসার্টের আয়োজন করা, যার মাধ্যমে যদি ২৫,০০০ আমেরিকান ডলার সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু হ্যারিসনের পরিকল্পনা ছিল আরও বড়– মার্কিন ও ব্রিটিশ রক সংগীতশিল্পী এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সমন্বয়ে এক তারকা-সজ্জিত কনসার্ট, যা অনুষ্ঠিত হবে নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে। কনসার্টের দিন ঠিক হয়– ১ অগাস্ট, ১৯৭১।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে, হ্যারিসন বিভিন্ন তারকা সংগীতশিল্পীকে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন, অংশগ্রহণের আশায়। গায়ক-গীতিকার লিয়ন রাসেল, গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপটন, ড্রামার জিম কেল্টনার, গায়ক ও কি-বোর্ডিস্ট বিলি প্রেস্টন, ব্যাডফিঙ্গার ব্যান্ড, এবং তাঁর নিজের প্রাক্তন ব্যান্ডমেটরা, বিটলসের প্রাক্তন সদস্য– জন লেনন এবং রিঙ্গো স্টার। পল ম্যাককার্টনি অবশ্য বিটলস-এর ভাঙনের তিক্ততার কারণে অংশগ্রহণ করতে রাজি হননি। কিন্তু হ্যারিসনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বব ডিলানকে রাজি করানো, যিনি তখন লাইভ পারফরম্যান্স থেকে অনেকটাই দূরে ছিলেন সচেতন সিদ্ধান্তে।
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে, হ্যারিসন ‘Bangla Desh’ (বাংলা দেশ) নামে একটি গানও রেকর্ড করেন, যার প্রথম লাইন ছিল– ‘My friend came to me with sadness in his eyes/ Told me that he wanted help before his country dies.’ একই সময়, তিনি রবিশঙ্করের ‘জয় বাংলা’ নামক ইপি-টিরও প্রযোজক ছিলেন, যা আলি আকবর খান ও আল্লা রাখা-সহ রেকর্ড করা হয়। তাঁরা দু’জনে ঠিক করেন এই দু’টি রেকর্ডেরই মুনাফা ইউনিসেফ-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিলে দেওয়া হবে।
কনসার্টটিকে সংগঠিত করার জন্য হ্যারিসনের যে দায়িত্ববোধ ও আবেগ, তা দেখে ক্লাউস ভুরম্যান বলেন, ‘জর্জ কখনওই ফ্রন্টম্যান ছিলেন না। দর্শকদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। তিনি কেবল তাঁর বন্ধু রবিশঙ্করের জন্য এটি করতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই এই কনসার্ট এত শক্তিশালী ও সফল হয়েছিল।’
এ’রম সময়ই নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পিছনের পাতায় ‘A Concert by George Harrison and Friends’ নামে ছোট একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। বিজ্ঞাপনটি বাকি বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে গেলেও, কনসার্টের সব টিকিটই প্রায় মুহূর্তের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। যার ফলে, একই দিনে একটি দ্বিতীয় শো ঘোষণা করা হয়।
জুলাই মাসের শেষে, যখন সব সংগীতশিল্পী নিউ ইয়র্কে রিহার্সালের জন্য আসতে শুরু করেন, তখন ব্যাকিং ব্যান্ডে ছিলেন বিলি প্রেস্টন, ব্যাডফিঙ্গারের চার সদস্য, ক্লাউস ভুরম্যান, জিম কেল্টনার, এবং জিম হর্নের ‘Hollywood Horns’। এরিক ক্ল্যাপটন, যিনি তখন হেরোইন আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, উপস্থিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। জন লেনন শুরুতে অংশগ্রহণে রাজি হলেও, পরে স্ত্রী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে যান। তবে রিঙ্গো স্টার নিশ্চিত ছিলেন, এবং তিনি স্পেনে তাঁর চলমান সিনেমার শুটিং বন্ধ রেখে কনসার্টে অংশ নেন।
৩১ জুলাই রাতে, ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে শেষ মহড়ায় অবশেষে বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটন উপস্থিত হন। তবে ক্ল্যাপটন তাঁর হেরোইন আসক্তির জন্য অনিশ্চিত ছিলেন, এবং ডিলান এত বড় দর্শকের সামনে পারফর্ম করার ব্যাপারে নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। হ্যারিসন তাঁকে বোঝান, ‘দেখো, এটা আমার জন্যও সহজ নয়। অন্তত তুমি একা লাইভ পারফর্ম করেছ আগে, কিন্তু আমি কখনও একা দর্শকের সামনে পারফর্ম করিনি।’ বিটলসের ১৯৬৬ সালের টুরের পর, এটি ছিল হ্যারিসনের প্রথম পেইং অডিয়েন্সের সামনে পারফরম্যান্স। বব ডিলানও একই সময় লাইভ পারফর্ম করা বন্ধ করেন। শুধু ‘আইল অফ ওয়াইট ফেস্টিভ্যাল’-এ, ১৯৬৯ সালে একটি পারফরম্যান্স করেন, এর আগে সেটিই ছিল ডিলানের শেষ পারফরম্যান্স।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট, ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে এক আজব বিদ্যুতায়িত পরিবেশ তৈরি হয়। দুপুরে একটি শো এবং সন্ধ্যায় আরেকটি। দু’টিই রবিশঙ্কর, আলি আকবর খান এবং আল্লা রাখা-র ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে শুরু হয় এবং শেষ হয় জর্জ হ্যারিসন ও বন্ধুদের দীর্ঘ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে। শো শেষ হওয়ার পর ডিলান এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে, হ্যারিসন ১৬ বছর পরে স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ঈশ্বর! আমরা যদি তিনটি শো করতাম!’ ২০০৫ সালে একটি ইন্টারভিউ-তে ‘রোলিং স্টোন’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ওয়েনার জানান, “১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কে বিটলসের আগমনের পর এমন ‘উত্তেজনা’ আর দেখা যায়নি।” রবিশঙ্করও পরবর্তীকালে বলেন, ‘যা ঘটেছিল তা এখন ইতিহাস: এটি ছিল শতাব্দীর অন্যতম চলমান এবং তীব্র সংগীত অভিজ্ঞতা।’
কনসার্টটি একাধিকভাবে সফল হয়। এটি শুধু বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিলে আড়াই লক্ষ ডলার তুলে দেয়নি, এটি বাংলাদেশের গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের বিষয়টিকে পশ্চিমের গণমাধ্যমের সামনে আরও প্রকটভাবে তুলে ধরে। আমেরিকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারেও সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং প্রবল সমালোচনা শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। আমেরিকা, ব্রিটেন এবং অন্যান্য জায়গা থেকে ভলান্টিয়াররা বাংলাদেশ যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে। যাঁদের মধ্যে অন্যতম অ্যালেন গিন্সবার্গ, জোয়ান বায়েজ প্রমুখ।
এরিক ক্ল্যাপটন ১৯৭৪ সালে বিশ্ব সফরে বের হন এবং বব ডিলান ১৯৭৫ সালে ‘Rolling Thunder Revue’ টুরের মাধ্যমে আবার লাইভ পারফর্ম শুরু করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালের ‘লাইভ এইড’ এবং ‘ফার্ম এইড’, ২০০১ সালের ‘কনসার্ট ফর নিউ ইয়র্ক সিটি’ এবং একুশ শতকের ‘লাইভ ৮’-এর মতো কনসার্টগুলোর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
এত কম সময়ের মধ্যে বিশ্বখ্যাত এই কনসার্টটির সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। হ্যারিসনও কি জানতেন এই কনসার্ট এভাবে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে, যে কনসার্টের নাম এত বছর পরও মুখে মুখে ঘুরবে? কিন্তু বাংলাদেশের গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের এমন নৃশংসতা দেখে হ্যারিসন থেকে শুরু করে বিশ্বজোড়া সাধারণ মানুষ চুপ করে থাকতে পারেননি।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
বিজ্ঞাপনের নিচে ঠিকানার জায়গায় আমাদের দে’জ পাবলিশিং-এর ঠিকানা, ১৩ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট লেখা আছে। যদি খুব ভুল না করি তাহলে এই ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’ দু-বার মাত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’ সংকলন ও ছাপার ভার ছিল বামাদার ওপর।
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?