একে অতুলনীয় স্বাদ, তার ওপর অপ্রতুল। তাই কোহিতুর আমের দামও আকাশছোঁয়া। মুর্শিদাবাদে লালবাগের কাছে আট-দশটা, জিয়াগঞ্জে তিন-চারটে। গোটা জেলায় শ’খানেক গাছ আছে কি না সন্দেহ! কোনও গাছেই গোটা পঞ্চাশের বেশি আম ধরে না। বাঙালি রসনা তৃপ্তির জন্য কোহিতুর আম তাহলে পাবে কীভাবে? আমচাষী, বিজ্ঞানীদের সাফ জবাব, পাবে না। খলনায়ক মূলত ‘আবহাওয়া’।
প্রবীণদের যেকোনও আড্ডায় কান পাতলেই শোনা যাবে, তাঁদের যৌবনে সবকিছুই ছিল দারুণ। পরিবেশ-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সিনেমা-থিয়েটার, পড়াশুনা থেকে খাবার, হা-হুতাশ ঝরে পড়ে তাঁদের গলায়– ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। সবেচেয়ে বেশি আক্ষেপ গঙ্গা-পদ্মার ইলিশের স্বাদ নিয়ে। তারপরেই থাকে মিষ্টি, দুধ, টাটকা শাকসবজি, আচার, পিঠে-পুলি-পায়েস নিয়ে খেদ। বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির মূল সূত্র ‘মেলবন্ধন’। নিজস্ব খাবারের সঙ্গে বাঙালি আপন করে নিয়েছিল নানা বিদেশি খাদ্যকেও। তাতে যুক্ত করেছিল নিজস্ব উদ্ভাবন।
বিভিন্ন খাদ্যসম্ভারের মধ্যে সেই তুলনায় ফল নিয়ে কথা একটু কমই হয়। কিন্তু প্রকৃত ভোজনরসিকদের রসনা তৃপ্তিতে ফলও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিশেষত, আম-কাঁঠাল-আনারস-লিচুর দাম ও আস্বাদ নিয়ে মুখ ফোলান অনেকেই। আর যদি শুধু আমের দিকে তাকানো যায়, তাহলে গোটা দেশ তথা বিশ্বকে বলে বলে একশো গোল দেবে বাংলার মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলা।
অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে প্রায় চারশো বছর বাংলা-বিহারে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল পাল বংশ। সেই আমল থেকেই মালদা অঞ্চলের আমের প্রসিদ্ধি ছিল বিস্তর। চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং-এর লেখায় সুস্বাদু আমের উল্লেখ রয়েছে। হুমায়ুন-আকবরের আমলে বাংলায় আমের ফলন আরও বিস্তার লাভ করেছিল। তারপর এল নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ-র আমল। বাংলার প্রথম নবাব রাজধানী সরিয়ে আনেন মুর্শিদাবাদে। সেখানে তাঁর, এবং পরে তাঁর উত্তরাধিকারীদের উৎসাহে তৈরি হয় আমবাগান। সেই বাগান পাহারা দিতেন নবাবের রক্ষীরা। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলত। সেই সব বাগানেই ফলত ল্যাংড়া, রানিপসন্দ, গোলাপখাস, মির্জাপসন্দ, সারেঙ্গা, হিমসাগর। কিন্তু সে তুলনায় তেমন প্রচারই পায়নি ‘কোহিতুর’। আমের জগতে যাকে ‘কোহিনুর’ বলা হয়, মাছের মধ্যে ‘ইলিশ’-এর সঙ্গে তুলনা করেন ভোজনরসিকরা।
বর্তমানে মুর্শিদাবাদে প্রায় ১০০ রকমের আম পাওয়া যায়। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে দামি, বিরল ও লোভনীয় ‘কোহিতুর’। যার একেকটির দাম ৮০০ থেকে শুরু হয়ে পৌঁছে যায় ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত! ‘সব আমের সেরা, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত’। এতটাই জটিল তার ফলন যে, ফল পাড়ার সময় ব্যবহার করতে হয় দস্তানা, প্রতিটি আম গাছ থেকে ছেঁড়ার সময় লাগে বিশেষ জাল। যাতে আমের গায়ে সামান্যতম আঁচড় না লাগে। গাছ পাকা হলে কোহিতুরের স্বাদ বদলে যায়। তাই হিসেব কষে দু’-তিনদিন আগেই তা পেড়ে ফেলতে হয়। সাধারণত, আম পাড়া হয় লাঠির ডগায় দড়ির জাল দিয়ে (স্থানীয় ভাষায় ঠোসা)। কিন্তু কোহিতুরের ক্ষেত্রে সেই জালের মধ্যে থাকে তুলোর বিশেষ আস্তরণ। রাখাও হয় তুলোর মধ্যে। দিনের মধ্যে অন্তত ছ’বার সেগুলি উল্টে-পাল্টে দিতে হয়। যাতে চাপ লেগে বা গরমে তার আকৃতি নষ্ট না হয়। দিনভর তার উপর নজর রাখতে হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বর্তমানে মুর্শিদাবাদে প্রায় ১০০ রকমের আম পাওয়া যায়। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে দামি, বিরল ও লোভনীয় ‘কোহিতুর’। যার একেকটির দাম ৮০০ থেকে শুরু হয়ে পৌঁছে যায় ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত! ‘সব আমের সেরা, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত’। এতটাই জটিল তার ফলন যে, ফল পাড়ার সময় ব্যবহার করতে হয় দস্তানা, প্রতিটি আম গাছ থেকে ছেঁড়ার সময় লাগে বিশেষ জাল। যাতে আমের গায়ে সামান্যতম আঁচড় না লাগে। গাছ পাকা হলে কোহিতুরের স্বাদ বদলে যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কোহিতুর কেটে খাওয়াও কিন্তু যে সে লোকের কম্ম নয়। নবাবি আমলে তাঁরা আম দু’তিন ঘণ্টা বরফ জলে ভিজিয়ে রাখতেন। আম কাটার জন্য ছিল রুপো দিয়ে তৈরি বিশেষ ছুরি, যাতে আমের গায়ে দাগ না লাগে। পরে অবশ্য বাঁশের তৈরি বিশেষ ছুরিও ব্যবহার হত। যা মিলত শুধু জিয়াগঞ্জ, আজিমগঞ্জে। আর এই কোহিতুর আমের চাষ করেন শেহেরওয়ালি সম্প্রদায়। যাঁরা আদতে ওসওয়াল জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ। অষ্টাদশ শতকে ব্যবসা করতে নবাবের মুর্শিদাবাদ এসেছিলেন। কোহিতুর আমের শুধু ওপরের অংশই খাওয়া হয়। কারণ এর পর আঙুলের ছাপ পড়ে যায়। বদলে যায় আমের স্বাদ। তাই পরের অংশ ব্যবহার হয় আমের রস তৈরিতে।
মুর্শিদাবাদের নবাবদের আইনি উপদেষ্টা ও ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন আইনজীবী, শিক্ষাবিদ পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। তিনি তাঁর ‘দ্য মসনদ অফ মুর্শিদাবাদ (১৭০৪-১৯০৪)’ বইতে লিখেছেন, আম চাষে কতটা গুরুত্ব দিতেন নবাবরা। তাঁর কথায় “মোবারক মঞ্জিলে সেরা আমের ফলন হত। আম পাড়তে হত একটা একটা করে। গাছের ডালে ঝাঁকুনি দিয়ে আম পাড়া হত না, মাটি থেকে তোলা হত না। যেগুলি ‘চুনাখালি আম’ নামে বিখ্যাত ছিল কলকাতার রসিক মহলে। কিন্তু যা পাঠানো হত, সেগুলো ছিল তুলনায় নিকৃষ্ট মানের। সত্যিকারের ভাল আম মুর্শিদাবাদের চৌহদ্দি পেরতে দিতেন না নবাবরা।” আর সেই আম নিয়েই ধন্য ধন্য করতেন কলকাতার বাবুরা, সাহেব-সুবোরা। এখনও সেই রীতির খুব একটা বদল হয়নি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: অনলাইন অফারে ব্যস্ত ক্রেতা, অসম প্রতিযোগিতায় খুচরো বিপণি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একে অতুলনীয় স্বাদ, তার ওপর অপ্রতুল। তাই কোহিতুর আমের দামও আকাশছোঁয়া। মুর্শিদাবাদে লালবাগের কাছে আট-দশটা, জিয়াগঞ্জে তিন-চারটে। গোটা জেলায় শ’খানেক গাছ আছে কি না সন্দেহ! কোনও গাছেই গোটা পঞ্চাশের বেশি আম ধরে না। বাঙালি রসনা তৃপ্তির জন্য কোহিতুর আম তাহলে পাবে কীভাবে? আমচাষী, বিজ্ঞানীদের সাফ জবাব, পাবে না। খলনায়ক মূলত ‘আবহাওয়া’। প্রথমত, তাপমাত্রা ৪০-৪৫ ডিগ্রিতে পৌঁছলে আমের আকার ছোট হয়ে যায়। আগে যেখানে একেকটা আমেরও ওজন হত ২৫০ গ্রাম, এখন তার অর্ধেক। গরম বাড়লে, কম বৃষ্টি হলে আমের মুকুলও ঝরে যায় প্রাকৃতিক নিয়মেই। ২৫০ আম ফললে তার মধ্যে একশো তো ঝরেই যাচ্ছে, আক্ষেপ কৃষকদের। তার ওপর আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা। আগে বৃষ্টি হত জুন-জুলাই-আগস্টে। এখন সে সময়ে বৃষ্টির পরিমাণ কমছে। উল্টে বৃষ্টি হচ্ছে অক্টোবরেও। আর আমের ‘ইলিশ’ কোহিতুর ফলে জেলার মাত্র ১১-১২টি ব্যক্তিগত বাগানে।
কোহিতুরের ফলনও খরচ ও শ্রমসাধ্য। তাই বাণিজ্যিকভাবে এই আমের ফলন লাভজনক নয়। বহু বাগানের গাছ কেটে জমি তুলে দেওয়া হয়েছে বহুতল তৈরির জন্য। নবাব বা তাঁদের উচ্চপদস্থ কর্মীরা কোহিতুর লাগাতেন নিজেদের রসনা তৃপ্তির জন্য। আর কাশিমবাজারে পাঠানোর আগে তাদের ‘বন্ধ্যা’ করে দেওয়া হত, যাতে অন্য কেউ তার চাষ করতে না পারে। এভাবেই আমের ‘মনোপলি’ ধরে রেখেছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ।
এখন আর ‘একচেটিয়া ব্যবসা’ সম্ভব নয়। কিন্তু বাঁশই যদি না থাকে, বাঁশি বাজবে কী করে! প্রকৃতির রোষে আর মানুষের নিজের কৃতকর্মের জেরেই বর্তমান প্রজন্ম কার্যত ‘কোহিতুর’-এর নাম জানে না। বঞ্চিত হচ্ছে তার আস্বাদ থেকেও। কোহিতুর এসে পৌঁছচ্ছে না আমজনতার পাতে।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved