বিজেপিকে দুটি লোকসভার আসন থেকে প্রায় ২০০ আসনে পৌঁছে দেওয়ার রাজনীতির কান্ডারি তো তিনিই ছিলেন– লালকৃষ্ণ আদবাণী। হিমাচল প্রদেশের পালমপুরে জাতীয় কার্যকরী সমিতির বৈঠকে ১৯৮৯ সালে অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণের আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। রোটারি ভবনে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়– আডবাণীর নেতৃত্বে রথযাত্রা শুরু হবে।
১৯৮৭ সালের কথা। নয়াদিল্লির পান্ডারা রোডে থাকতেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। প্রথম যেদিন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, ওঁর স্ত্রী কমলা দেবী নিজের হাতে আম কেটে দিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশের হিমসাগর আম। স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা সেদিনই এক ঝুড়ি হিমসাগর আম দিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন প্রথম দেখলেন আমাকে। কিন্তু কী অসাধারণ আতিথেয়তা! কার্যত তখন আমি এক নাবালক রিপোর্টার। কিন্তু ফেরার সময় তিনি বাড়ির গেট পর্যন্ত এসেছিলেন। বললেন, ‘খুব ভালো লাগল। মাঝে মাঝে এসো এভাবে।’
পরে জানতে ও বুঝতে পারলাম, যে-ই ওঁর বাড়িতে আসুন না কেন, তাঁকে এভাবেই তিনি বিদায় জানান। এমনকী, গাড়ি করে এলে, জানলার সামনে হাত জড়ো করে নমস্কারের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। পরে কেউ কেউ বলেছিলেন, এই সৌজন্য-সংস্কৃতি তিনি শিখেছেন আরএসএসের কাছ থেকে।
’৮৭ সালের সেই অপরাহ্নের কথা মনে পড়ছে। তখন তিনি বিরোধী বিজেপি নেতা। এরপর ধাপে ধাপে বিজেপিকে দুটি লোকসভার আসন থেকে প্রায় ২০০ আসনে পৌঁছে দেওয়ার রাজনীতির কান্ডারি তো তিনিই ছিলেন। হিমাচল প্রদেশের পালমপুরে জাতীয় কার্যকরী সমিতির বৈঠকে ১৯৮৯ সালে অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণের আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। রোটারি ভবনে অনুষ্ঠিত সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়– আডবাণীর নেতৃত্বে রথযাত্রা শুরু হবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আজ নরেন্দ্র মোদির যে হিন্দুত্বর রাজনীতি, বালক রামের প্রতিষ্ঠা উৎসব, এসবের পটভূমিতে আছে আডবাণীর আন্দোলন। এই হিন্দুত্বর রাজনীতিকে সমর্থন করা বা না-করা কিন্তু ভিন্ন আলোচনার বিষয়। সেই উচিত-অনুচিতের নীতিশাস্ত্র থেকে বেরিয়ে যদি আডবাণী-মোদির রাজনীতির নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে মনে হয়, আডবাণী যেন এক ট্রাজিক মহানায়ক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, সোমনাথ থেকে এই রথযাত্রা শুরু হয়। সেদিন অটলবিহারী বাজপেয়ী কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ থাকা সত্ত্বেও সেদিন আডবাণীর নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। একেই বোধহয় বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যে বাজপেয়ী এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেন, বিপুল বিজয়ের পর কিন্তু আডবাণী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। জোট সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ উদার ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন বাজপেয়ী।
আজ এত বছর পর যখন পিছন ফিরে তাকাই, তখন বিশ্লেষণ করতে গেলে মনে হয়, আজ নরেন্দ্র মোদির যে হিন্দুত্বর রাজনীতি, বালক রামের প্রতিষ্ঠা উৎসব, এসবের পটভূমিতে আছে আডবাণীর আন্দোলন। এই হিন্দুত্বর রাজনীতিকে সমর্থন করা বা না-করা কিন্তু ভিন্ন আলোচনার বিষয়। সেই উচিত-অনুচিতের নীতিশাস্ত্র থেকে বেরিয়ে যদি আডবাণী-মোদির রাজনীতির নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে মনে হয়, আডবাণী যেন এক ট্রাজিক মহানায়ক। ’৯৬ বছর বয়সে এসে তিনি যেন এক নিঃসঙ্গ সম্রাট। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে পরেই বৃদ্ধতন্ত্র-কে সরিয়ে দেয় বিজেপি। ‘মার্গদর্শক মণ্ডলী’ তখনই তো তৈরি হয়। এনডিএ-র চেয়ারপার্সনের পদ থেকেও সরে যান আডবাণী। সংসদ ভবনে তাঁর নেমপ্লেট হঠাৎ একদিন সরে যায়। তবে দলের অশেষ কৃপা, ৩০ পৃথ্বীরাজ রোডের বিস্তৃত লন সম্বলিত বাংলোটি তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়নি– তিনি সংসদ সদস্য না থাকলেও।
২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় বালক রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা দিবসে আডবাণী যেতে পারেননি বলে অনেকে অভিযোগ করেছিলেন– মোদি তাঁর ভূমিকাকে অবজ্ঞা করছেন। ইতিহাস বিস্মৃত মোদিময়তায় আক্রান্ত বিজেপি। অযোধ্যা ইভেন্ট অতিবাহিত হওয়ার এক পক্ষকালের আগেই আডবাণীকে দেওয়া হল ‘ভারতরত্ন’। প্রধানমন্ত্রী নিজে টুইট করে একথা দেশকে জানালেন। তার আগে একথা নিজমুখে গুরুকেও জানালেন ফোনে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলছিলেন, এই হলেন মোদি। কোনও উপদেষ্টার বুদ্ধি নয়, এ হল তাঁর মস্তিষ্কজাত প্রস্তাব।
বিহারের কর্পূরী ঠাকুরের মরণোত্তর ভারতরত্নের সঙ্গে যৌথ ঘোষণা করেননি। তাতে দু’টি সম্মানই লঘু হয়ে যেত। প্রথমে কর্পূরী ঠাকুরের ঘোষণার মাধ্যমে বিহার ও নীতিশ কুমারকে সামলেছেন, তারপর ৩ ফেব্রুয়ারি এ ঘোষণা। অযোধ্যা কাণ্ড কিঞ্চিৎ থিতিয়ে যাওয়ার পর। যাতে প্রতিপক্ষ অযোধ্যায় ওঁর অনুপস্থিতির সঙ্গে ভারতরত্নর কার্যকারণ সম্পর্কর কথা তুলতে না পারে। মোদির টুইটে আডবাণীর অবদান বলতে গিয়ে দলনেতা ও উপপ্রধানমন্ত্রীর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তাঁর রাম মন্দির আন্দোলনের কথা উল্লেখ হয়নি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: রামের সূত্রেই বাঙালির প্রাণের উৎসব, বাঙালির রাম দীর্ঘ সংস্কৃতিচর্চার ফসল
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আডবাণী উপপ্রধানমন্ত্রীও সঙ্গে সঙ্গে হননি। বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হয়েই তাঁকে উপপ্রধানমন্ত্রী করেননি। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন আর ২০০২ সালের জুন মাসে হন উপপ্রধানমন্ত্রী। আসলে বাজপেয়ী শরিকদের প্রিয় হলেও তিনি হিন্দুত্বর কর্মসূচি থেকে সরে যাচ্ছেন বলে সংঘ ক্রমশই ক্ষিপ্ত হতে থাকে। আরএসএস নেতা রজ্জু ভাইয়া তো সরাসরি বাজপেয়ীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেন যাতে আডবাণী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। বাজপেয়ী সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, না ম্যায় টায়ার্ড, না ম্যায় রিটায়ার্ড হু।
এরপর আরএসএসের প্রস্তাবে আডবাণী উপপ্রধানমন্ত্রী হন। শরিকদের বোঝানোর কাজটি করেন আডবাণী ঘনিষ্ঠ এনডিএ-র তৎকালীন কনভেনার জর্জ ফার্নান্ডেজ।
এরপর পাকিস্তানে গিয়ে জিন্না-সম্পর্কিত মন্তব্য আডবাণীকে আরও বড় ট্রাজেডির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আডবাণী সেদিন ভেবেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির সাহায্যে এবার তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ী হয়ে উঠবেন। এ হল ইমেজ রিকভার। আমরা বলতাম, আডবাণীর বাজপেয়ীকরণ। কিন্তু কট্টরবাদী ভাবমূর্তির ঘোড়ায় চাপলে তা থেকে নামা কঠিন। এর ফলে সেদিন আডবাণী দু’-কূলই হারালেন। দলের সভাপতির পদ থেকেও কার্যত তাঁকে সরানো হল সংঘের নির্দেশে।
২০১৪ সালের আগের ভোটেও আডবাণীর টি-শার্ট বিলি করে তবু দল প্রচার চালায়। কিন্তু সে ভোটেও বিজেপি হেরে যায়। ২০১৪ সালে ইচ্ছে থাকলেও দলের শীর্ষ নেতারা কেউই শেষ পর্যন্ত তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেননি! সুষমা স্বরাজ-রাজনাথ সিংহ-রা চাইলেও তিনি স্বভাবগত ভাবে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে মোদি বিরোধিতা করেননি। তাছাড়া গোয়া বৈঠকের সময় সংঘ পরিবারও যে মোদির পক্ষে, তাও আডবাণীকে জানিয়ে দেন।
যে শিষ্যকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে গোধরা কাণ্ডের পর বাজপেয়ী সরাতে চান, কিন্তু আডবাণীর প্রবল সমর্থনে শিষ্যকে সরানো সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর ট্রাজিক নায়ক তিনি। অ্যারিস্টটলের সংজ্ঞা অনুসারে, তিনিই ট্রাজিক নায়ক যিনি বহু সু-গুণ সম্বলিত প্রাথমিকভাবে সফল। কিন্তু নীতি বিহর্গিতভাবে নয়, শুধু ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল পদক্ষেপের জন্য যখন নায়ক ব্যর্থ হন, যখন তার জন্য করুণার উদ্রেক হয়, তখনই তিনি ট্রাজিক নায়ক। শিষ্য গুরুদক্ষিণা দিয়েছেন ভারতরত্ন ঘোষণার মাধ্যমে, তবু বৃদ্ধ আডবাণী এক নিঃসঙ্গ সম্রাট।