শহরের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া পাখিদের আবার ফিরিয়ে আনার রাকেশ খাত্রীর অভূতপূর্ব উদ্যোগের তারিফ এবং স্বীকৃতি এসেছে দেশ-বিদেশ থেকে। তিনি পেয়েছেন ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং এফর্টস ইন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ‘ইন্টারন্যাশনাল গ্রিন অ্যাপেল অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘আর্থ ডে নেটওয়ার্ক স্টার’-এর মতো সম্মান। মিলেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার’-এর সদস্যপদ। ‘লিমকা বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ এ নাম উঠেছে তাঁর। এ বছর সোনি-বিবিসি আর্থ চ্যানেল তাঁকে ‘আর্থ চ্যাম্পিয়ন’ শিরোপায় সম্মানিত করেছে। তবে সব পুরস্কারের সেরা পুরস্কার হয়তো তাঁর ‘নেস্ট ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ পরিচয়।
শেষ কবে ধুলোয় ডুবে চড়ুইপাখির চান করা দেখেছেন, মনে করতে পারেন?
আচ্ছা, ধুলোর কথা উড়িয়ে দিন। দুপুরে বৃষ্টি থামার পর উঠোন কিংবা রাস্তার ধারে জমে থাকা চিলতে জলে চড়ুইদের ডানা ঝাপটিয়ে হাপুস হুপুস করে ডুব দিতে দেখেছেন? মনে পড়ছে না তো?
ভাতের চাল ধোওয়ার সময় মা যখন সিকিমুঠো চাল উঠোনে ছড়িয়ে দিতেন, তখন ঝাঁক বেঁধে পাখিরা নেমে আসত বনভোজনের আহ্লাদে। গেরস্থবাড়ির এ ছিল খুব চেনা ছবি। মনে পড়ছে? যদি শহরবাসী হন, তবে তো এই স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে আপনি আপনার শৈশবে ফিরে যাবেন। আর যদি শহর ছাড়িয়ে আপনার ঠিকানা হয় কোনও গ্রাম বা শহরতলি, তবে হয়তো এখনও মাঝেমধ্যে এর সাক্ষী হলেও হতে পারেন।
আমাদের কংক্রিটের খিদে ক্রমাগত গ্রাস করছে গাছপালা, ঝোপজঙ্গল। ডালপালা ছড়ানো দেশি গাছের জায়গায় আমরা বাহারি পরদেশি গাছ লাগাচ্ছি। ‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না’, সেথা কি পাখি ঘর বাঁধতে পারে! আধুনিক ঘরবাড়ি আর ফ্ল্যাটবাড়িতে নেই কোনও ঘুলঘুলি, নেই চিলেকোঠার ফাঁকফোঁকর। চারপাশে বাসা-বান্ধব গাছ নেই, গেরস্থের ঘুলঘুলি নেই, তাই কার্নিশে-পাঁচিলে চড়ুই, শালিক, বুলবুলিদের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়াউড়িও নেই। ওরা যে মানুষের গা-ঘেঁষে বাস করতে অভ্যস্ত। ওরা লোকালয়ের পাখি। ওদের ঘর বাঁধার পরিসরটুকুও আমরা কেড়ে নিচ্ছি। এ শহরে থাকব শুধু আমরাই, এ পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াব শুধু আমরাই! আমাদের আত্মমুখী যাপন বিলাস নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে বহু জীব-প্রজাতিকে। চড়ুই, টুনটুনি, বুলবুলিরাও প্রহর গুনছে। কমছে লোকালয়ের পাখির সংখ্যা। জাতীয় সমীক্ষা বলছে, বিশেষ করে চড়ুইপাখির সংখ্যা তরতরিয়ে নেমে আসছে।
চড়াই-উতরাই নিয়ে পরিসংখ্যান যাই বলুক, আমরা কিন্তু নির্বিকার। আমরা কোনওদিন ভেবে দেখিনি চড়ুইপাখি উধাও হয়ে গেলে পরিবেশে তার প্রভাব কী হবে! তবে নির্বিকার নন রাকেশ খাত্রী (Rakesh Khatri)। দিল্লির ময়ূর বিহারের বাসিন্দা, ৬৩ বছরের পরিবেশপ্রেমী এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা রাকেশ খাত্রী, গত দেড় দশক ধরে পাখির বাসা বানিয়ে চলেছেন। শুরু ২০০৮-এ। কংক্রিটে মোড়া নিজের মহল্লায় চড়ুইপাখির অনুপস্থিতি তাঁর চোখে লাগে। মনে হয়, ওদের বাসা বাঁধার জায়গা কোথায়! কেনই বা ওরা আসবে! ভাবতে ভাবতে নিজেই বানিয়ে ফেললেন একটা পাখির বাসা। নারকেলের মালা, পাটের দড়ি, টুকরো-টাকরা কাপড়, কাগজ, এইসব দিয়ে। টাঙিয়ে দিলেন সেই বাসা সুবিধেমতো কোনও জায়গায়। পাখিদের জন্যে রইল উন্মুক্ত আহ্বান। না, পাখি আসে না। একদিন-দু’দিন- তিনদিন যায়। কোনও পাখি এসে আপন করে নেয় না মানুষের হাতে গড়া বাসাকে। আড়চোখে তাকিয়ে কোনও প্রতিবেশী মুচকি হাসেন, কেউ বলেন, ‘পাখিদের বয়ে গেছে মানুষের বানানো বাসায় এসে থাকতে!’
কিছুটা হতাশ হন রাকেশ। পূর্ব দিল্লির গড়িমান্ডু জঙ্গলের এক বনকর্মী একদিন কথায় কথায় রাকেশকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘বাসা বানানো কিছুতেই বন্ধ করবেন না। চড়ুইপাখিকে আপনি ঘর দিচ্ছেন, যে ঘর আমরাই একদিন তাদের থেকে কেড়ে নিয়েছি।’ রাকেশের মনে ধরে কথাগুলো। বাসা বানিয়ে চলেন রাকেশ। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাসা তৈরির উপাদান বদল করতে থাকেন। এক সময় লক্ষ্য করেন পাখিরা আসছে তাঁর তৈরি বাসায়। আসছে এবং দখল নিচ্ছে। থাকছে এবং ডিম পাড়ছে। কচি কচি ছানারা উঁকি দিচ্ছে বাসার ভিতর থেকে। আনন্দে বুক ভরে যায় রাকেশের। সার্থক হতে চলেছে তাঁর স্বপ্ন!
তবে তিনি বুঝেছিলেন, শুধু একক উদ্যোগে এ স্বপ্ন সফল হবার নয়। তাই বাসা তৈরিতে আরও বহু মানুষকে যুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য সংস্থায় হাতে-কলমে বাসা তৈরি শেখানোর কর্মশালা করতে লাগলেন। এ যাবৎ তিনি ৭,০০০-এর বেশি কর্মশালা করেছেন এবং সাত লক্ষ তিরিশ হাজারের বেশি বাসা তৈরি হয়েছে তাঁর তত্ত্বাবধানে। শুধু বাসা বানাতে শেখা নয়, বাসা ঝোলানোর উপযুক্ত জায়গা চিনতেও শিখিয়েছেন রাকেশ। তাঁর অভিজ্ঞতায়, প্রায় ৮০ শতাংশ বাসাই পাখিদের পছন্দ হয়েছে। চড়ুই, দোয়েল, বুলবুলিরা দখল করেছে মানুষের গড়া কৃত্রিম বাসা। রাকেশ গড়ে তুলেছেন ‘ইকো রুটস ফাউন্ডেশন’ নামের এক সংগঠন। সেই সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি হাতে নিয়েছেন ‘জলস্পর্শ’ কর্মসূচি।
রাকেশের মনে হয়েছিল বাসা তৈরির কাজটিকে আরও পরিবেশ-বান্ধব করা দরকার! সেই ভাবনা থেকেই তাঁর মাথায় আসে কচুরিপানা থেকে থেকে বাসা তৈরির কথা। এতে সুবিধে বহুমুখী। কচুরিপানার চাপে বহু জলাশয় হাঁসফাঁস করছে। জলের অক্সিজেন টেনে নিয়ে কচুরিপানা জলের ইকোসিস্টেমকে নষ্ট করে দেয়। এহেন ক্ষতিকর কচুরিপানাকে জল থেকে তুলে যদি বাণিজ্যিকভাবে পাখির বাসা বানানোয় ব্যবহার করা যায়, তবে বহু মানুষের রুজির সংস্থান হবে এবং জলাশয়গুলিও ফিরে পাবে তাদের স্বাস্থ্য।
ইতিমধ্যেই শ’দুয়েক জলাশয়কে কচুরিপানা-মুক্ত করেছে ‘জলস্পর্শ’ প্রকল্প। বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানার দু’ হাজারের বেশি মহিলা বর্তমানে এই প্রকল্পের অধীনে কচুরিপানা তোলা এবং তা ব্যবহার করে বাসা তৈরির কাজে যুক্ত। এই সব গ্রামীণ মহিলাদের হাতে আসছে রোজগার। পরিবেশ বাঁচানোর এই লড়াই মেয়েদের ক্ষমতায়নের পথ খুলে দিচ্ছে।
শহরের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া পাখিদের আবার ফিরিয়ে আনার অভূতপূর্ব উদ্যোগের তারিফ এবং স্বীকৃতি এসেছে দেশ-বিদেশ থেকে। রাকেশ খাত্রী পেয়েছেন ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং এফর্টস ইন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, ‘ইন্টারন্যাশনাল গ্রিন অ্যাপেল অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘আর্থ ডে নেটওয়ার্ক স্টার’-এর মতো সম্মান। মিলেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার’-এর সদস্যপদ। ‘লিমকা বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’ এ নাম উঠেছে তাঁর। এ বছর সোনি-বিবিসি আর্থ চ্যানেল তাঁকে ‘আর্থ চ্যাম্পিয়ন’ শিরোপায় সম্মানিত করেছে।
…………………………………..
আরও পড়ুন মৌসুমী ভট্টাচার্য্য-র লেখা: অ্যান্ট-ই সোশাল এবং কুটুসতন্ত্র
…………………………………..
তবে সব পুরস্কারের সেরা পুরস্কার হয়তো তাঁর ‘নেস্টম্যান অফ ইন্ডিয়া’ (The Nestman Of India) পরিচয়। এ পরিচয় খুব সহজে আসেনি। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ তিনি পাখিদের ঘরামি। এমন আরও হাজারও ঘরামি তিনি তৈরি করেছেন এবং করে চলেছেন অবিরত। তারা ঘর বুনছে ঘরছাড়াদের জন্যে। তবে পরের হাতে নয়, নিজের বাসা নিজে বানানোর আনন্দ ফিরে পাক পাখিরা। ‘নেস্টম্যান’-এর স্বপ্ন বাস্তব হোক। পরিবেশ হয়ে উঠুক বিহঙ্গ-সোহাগী। শহরের যান্ত্রিক কোলাহলে মিশুক পাখিদের নির্ভয় কলতান। অকারণ আনন্দে হয়তো একদিন তারা ঢুকে আসবে আপনার সাজানো বসার ঘরে। আপনাকে চমকে দিয়ে আবার উড়ে যাবে অন্য জানলা দিয়ে। রোজকার চোখাচোখি পরস্পরকে কাছে আনবে। রবিঠাকুরের মতো আপনারও কোনওদিন মনে হবে–
‘ওগো আমার ভোরের চড়ুই পাখি/ একটুখানি আঁধার থাকতে বাকি/ ঘুমঘোরের অল্প অবশেষে/ শাসির পরে ঠোকর মারো এসে/ দেখো কোন খবর আছে নাকি।’
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।