মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা আরও একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রদায়িক সংকট আজ বড্ড প্রবল, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীস্বাধীনতায় খাপ বসাচ্ছে বহু গোষ্ঠী। সেখানে স্বমহিমায় ফিরলেন ‘বিনোদিনী’। যাঁর লড়াই ছিল লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে, যাঁর যুদ্ধ ছিল ধর্মের ধ্বজাধারীদের যাবতীয় সমস্ত ফরমানের বিরুদ্ধে। প্রাপ্যসম্মান পেলেন বিনোদিনী। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বদলাল ধারাপাত।
‘দেহ পট সনে নট সকলই হারায়’। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। চক্রব্যূহে আবদ্ধ ইতিহাস ফিরিয়েও দেয় তার প্রাপ্য সম্মান। তাতে কেটে যাক না প্রায় দেড়শো বছর। ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির গোলকধাঁধায় যে মানুষ পথ হারায়, সেই পথিককে পথও খুঁজে দেয় সময়। যেমন ঘটল বিনোদিনী দাসীর সঙ্গে। বহু সাধের, বহু স্বপ্নের স্টার থিয়েটারে যেন পুনঃপ্রবেশ ঘটল তাঁর। না, এখন আর ‘স্টার’ নয়, যাঁর আত্মত্যাগে এই থিয়েটারের পথচলা শুরু, তাঁর নামেই পরিচিত হবে উত্তর কলকাতার ইতিহাস সমৃদ্ধ রঙ্গমঞ্চ। এখন তার নাম ‘বিনোদিনী মঞ্চ’।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঐতিহ্যবাহী এই প্রেক্ষাগৃহের নতুন নাম ঘোষণা করলেন– ‘বিনোদিনী মঞ্চ’। অথচ এই নামটা হওয়ার কথা ছিল ১৮৮৩ সালে! ঠিক এই নামটা নয়, আসলে নাম হওয়ার কথা ছিল ‘বি থিয়েটার’। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। যাঁদের আপন পরিবার বলে ভেবেছেন, যাঁকে জীবনের ‘গুরু’ বলে মেনেছেন, যাঁদের জন্য আত্মসম্ভ্রমটুকুও ত্যাগ করেছেন, বিশ্বাসঘাতকতা এল সেই গিরিশচন্দ্র ঘোষদের থেকেই। এক ‘বেশ্যা’র নামে সেজে উঠবে নতুন থিয়েটার! উনিশ শতকের জনতা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে তাকে। আর বিনোদিনীই তো আসল ‘স্টার’। বকলমে এই তো ছিল অজুহাত।
এমনিতেও কটাক্ষের অভাব ছিল না। একমঞ্চে পুরুষ-নারী অভিনয় করবে, কী করে মানবে রক্ষণশীল সমাজ? পথ দেখিয়েছিল বেঙ্গল থিয়েটার। ১৮৭৩ সালে তারা পাঁচজন নারী অভিনেত্রী নিয়োগ করেছিল। সমাজের যাবতীয় রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পাল্লা দিয়ে অভিনয় চালিয়েছিলেন গোলাপসুন্দরী (সুকুমারী দেবী), শ্যামা, জগত্তারিণী, এলোকেশীরা। সেই পথ ধরেই আগমন বিনোদিনী দাসীর। মাতামহীর সংসারে প্রবল দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন কাটছিল তাঁর। শেষ ভরসা বলতে যেটুকু গহনা ছিল, সেটুকুও বিক্রি করে দিতে হল। সেই সময় একদিন ন্যাশনাল থিয়েটারের গঙ্গামণি প্রস্তাব দেন বিনোদিনীর মাতামহীকে, ‘তোমার নাতনিটিকে থিয়েটারে দেবে? এখন জলপানি বলে কিছু টাকা পাবে। তারপর কাজকর্ম শিখলে একটা মাইনে হবে।’
সেই শুরু হল যাত্রা। পরে মাইনে জুটল ১০ টাকা। নামডাক হতেও দেরি হল না। রীতিমতো নাড়া বেঁধে গানও শিখলেন বিনোদিনী। বাংলা থিয়েটারের অবস্থা তখন কিছুটা টালমাটাল। ১৮৭৬ সালে নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের সাহায্যে টুটি চেপে ধরেছে ব্রিটিশ সরকার। প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে কিছুটা বিভ্রান্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ। ‘ক্যালকাটা স্টার কোম্পানি’ খুলে দলবল নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। ততদিনে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’-এ অভিনয় দেখে বিনোদিনীর ওপর নজর পড়েছে গুর্মুখ রায়ের। হোরমিলার কোম্পানির বেনিয়া গণেশ দাস মুসুদ্দির পুত্র গুর্মখ ১৮ বছর বয়সে পিতৃহীন হয়ে প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। ফলস্বরূপ উচ্ছৃঙ্খলতা। সেই সময় বিনোদিনীর রূপমুগ্ধা গুর্মুখ রায় প্রস্তাব নিয়ে এলেন গিরিশচন্দ্রের কাছে। নতুন থিয়েটারের পুরো খরচ দেবেন তিনি, বদলে চাই বিনোদিনী।
অভিনেতারাও অনুরোধ করলেন বিনোদিনীকে, ‘তুমি যে প্রকারে পার একটি থিয়েটার করিবার সাহায্য কর!’ থিয়েটারই জীবন, থিয়েটারই মরণ। যাঁদের এতদিন ধরে পরিবার ভেবে এসেছেন, তাঁদের কাতর অনুরোধ ফেলতে পারলেন না বিনোদিনী। সেই সময়ের পঞ্চাশ হাজার টাকার লোভনীয় প্রস্তাবও ছিল তাঁর কাছে। টাকা? টাকার জন্য কি বিনোদিনী দাসী থিয়েটারকে জীবন হিসেবে গ্রহণ করেছেন? তখন আরও একটি প্রস্তাব এল গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসুদের তরফে। জানানো হল, “এই যে থিয়েটার হাউস হইবে, ইহা তোমার নামের সহিত যোগ থাকিবে। তাহা হইলে তোমার মৃত্যুর পরও তোমার নামটি বজায় থাকিবে। অর্থাৎ এই থিয়েটারের নাম ‘বি’ থিয়েটার হইবে।” বিনোদিনী শেষ পর্যন্ত জানতেন, তাঁর নামেই থিয়েটারের নাম হবে। কিন্তু যখন রেজিস্ট্রি হল, তখন বাকিদের তরফ থেকে নির্বিকার মুখে উত্তর এল নামকরণ হয়েছে ‘স্টার’। দু’মিনিট কথা বলতে পারেননি, কোনও রকমে আত্মসংবরণ করেছিলেন।
না, অভিমানে থিয়েটার ছাড়েননি বিনোদিনী। বরং বিডন স্ট্রিটের ‘স্টার’কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবনপণ করলেন। প্রতিষ্ঠার পরের বছর অর্থাৎ, ১৮৮৪ সালে গিরিশচন্দ্র রচিত ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনীত হল। যে নাটক দেখতে এলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। নাটক শেষে বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করে বললেন ‘চৈতন্য হোক’। সেই বাণীর মধ্যে জীবনে নতুন পথের খোঁজ পেলেন বিনোদিনী। অন্যদিকে, বাংলা থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের বিষয়টিও যেন মান্যতা পেল।
১৮৮৬ সালে বঙ্গরঙ্গমঞ্চ থেকে চিরতরে বিদায় নিলেন ‘ফ্লাওয়ার অফ নেটিভ স্টেজ’ বিনোদিনী। তখন তাঁর বয়স ২২ কি ২৩! ১৯৪১ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ঠিকই, তবে আর কোনও দিন অভিনয় করতে নামেননি। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে মঞ্চত্যাগ করলেন তিনি। তারপর অবশ্য স্টারেরও ইতিহাস বদলেছে। বিডন স্ট্রিট থেকে গিরিশচন্দ্ররা সরে এলেও ‘স্টার’ নামের ‘গুডউইল’ ধরে রেখেছিলেন। পরে নয়ামঞ্চ হয় হাতিবাগানে। আজকের ‘স্টার’ সেই ইতিহাসের সাক্ষী।
…………………………………………….
আরও পড়ুন গুলশনারা খাতুন-এর লেখা: সেদিনের মতো আজও বিনোদিনীদেরই প্রশ্ন করা হয়
…………………………………………….
ইতিহাসের মোড় আবারও বদলাল। তার জন্য বাংলা থিয়েটার তথা বাঙালি সমাজকে অপেক্ষা করতে হল ১৪১ বছর। আর কী অদ্ভুত সমাপতন! ‘স্টার’ থেকে ‘বিনোদিনী’ নামকরণ হল একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা আরও একটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রদায়িক সংকট আজ বড্ড প্রবল, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীস্বাধীনতায় খাপ বসাচ্ছে বহু গোষ্ঠী। সেখানে স্বমহিমায় ফিরলেন ‘বিনোদিনী’। যাঁর লড়াই ছিল লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে, যাঁর যুদ্ধ ছিল ধর্মের ধ্বজাধারীদের যাবতীয় সমস্ত ফরমানের বিরুদ্ধে। প্রাপ্যসম্মান পেলেন বিনোদিনী। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বদলাল ধারাপাত। ওই যে সহ-অভিনেতারা বলেছিলেন, ‘তোমার মৃত্যুর পরও তোমার নামটি বজায় থাকিবে’, অবশেষে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে চিরকালের জন্য ‘খোদাই’ হয়ে রইল বিনোদিনীর নাম।
আসলে মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..