কার্ল মার্ক্সের লেখায় পড়েছি, সভ্যতা এগলে, পুঁজি নাছোড়বান্দা হলে, মানুষ মানুষকে পণ্যে পরিণত করবে। আমার বোধে, সেই কথারই কিঞ্চিৎ আপডেটেড ভার্সান হল: মানুষ মানুষকে পরিণত করবে কন্টেন্টে। তাই দেখতে পাই, হেঁটে-চলে বেড়ানো আস্ত মস্ত কন্টেন্ট হয়ে উঠেছি আমরা। বাদবাকি ফাউ। প্রেমিকা ছেড়ে গেছে? আয়, তোকে এইবার ভাইরাল করে দিই। আদর মাখোমাখো মুহূর্ত বিক্রি করি। আমি পাওয়ারফুল। কন্টেন্টের ভাইরালিটি আমাদের উত্তর-আধুনিক মোক্ষ। হিন্দু-মুসলিমের সৌহার্দ্য সম্প্রীতিও তাই ভাইরাল করতে হয়। নইলে ভুলে যাই কি না!
রোদ্দুর মিত্র
যে হিংস্র দাঁত আর ক্ষুরধার নখের পশরা সাজিয়ে আমরা বসেছিলাম বিগত শত শত বছরগুলোতে, বহুল ব্যবহারে সেইসব প্রায় ভোঁতা হয়েছে। এ-সভ্যতার বুক, পেট ও পশ্চাৎ খিমচে ও কামড়ে যত রকমারি মাংস খুবলে খাওয়া সম্ভব, খেয়েছি। রক্তের ফিনকিতে দোল খেলেছি। মৌলিক অধিকারকে মিম বানিয়েছি। স্বীকার করি, ভালো লেগেছে। আরও ভালো ভায়োলেন্স অথবা নিসর্গ সুন্দরের জন্য তাই খুঁজতে বেরিয়েছি অস্ত্র। বোমা-বারুদের গন্ধ থেকে যোজন দূরে থাকা সহজ সহজ কোনও মানুষ, একুশ শতকে পৌঁছে দেখেছে অস্ত্রের নিয়মিত অনুশীলন বা অকেশনালি প্রদর্শন– খুব মস্তির এবং বাধ্যতামূলক। রামনবমীর মিছিলে। হায়দরাবাদের বিস্তারিত প্রকাণ্ড অরণ্যে। প্যালেস্তাইনে। হয় রাষ্ট্র, নয় পুঁজির বেহায়া স্বার্থে। আড়ে-বহরে টের পাইয়ে দেওয়া তুমি না-মানুষ। সংখ্যালঘু। একটা পাওয়ারলেস পিপীলিকা। ভাঁড়ারে যে অস্ত্র ছিল, আছে, থাকবেও। তবু অস্ত্রের সমগ্র ধারণা রিডিফাইন করে, অস্ত্র এখন বুলডোজার। অস্ত্র এখন– আয়, তোকে ভাইরাল করে দিই!
মেট্রো স্টেশনে তুমি চুমু খেয়েছ? কী সাহস! যাও, আজ থেকে তুমি ভাইরাল! জোম্যাটোর ডেলিভারি বয় আড়াই মিনিট দেরিতে কেন পৌঁছল? যাও, ভাইরাল! পোস্ট অফিসে দুপুর তিনটের পরে টাকা জমা নেবে না? যাও, ভাইরাল! ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো শাড়ি-গয়না-কাজল? ট্রান্সজেন্ডার? যাও, তুমিও ভাইরাল! ভাইরাল আসলে একটি প্যারামিটারবিহীন ফেনোমেনা– ভালোবাসা, অপেক্ষা, জিরাফ, ধর্ম, বিরিয়ানি একেবারে ঘেঁটে ঘ! আছে বলতে, পাঁচ হাজার ফলোয়ার্সের ভার্চুয়াল পরাক্রম। রদ্দি ইমোশনে ভেজা কয়েকটা লাইন। প্রয়োজনে কলকাতা পুলিশ। এবং সবশেষে, এক ভার্চুয়াল বিচারসভা। কারণ এ-পৃথিবীতে তুমি মহান পাপী, তোমার মুখ সকলের মগজে ডিজিটাল স্মৃতি হয়ে গেঁথে যাক। এইবার তুমি পালাবে কোথায় উল্লুক?
ভাইরাল হতে চেয়ে কেউ পরোটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে। কেউ দামড়া একটা কাতলা মাছের সঙ্গে লাফায়। কেউ দারুণ চুলোচুলি করে বলে, প্র্যাঙ্ক! সে ঘটনা ভিন্ন। সে ঘটনায় এই ‘আমি’ বলে বস্তুটির অপরিসীম লোভ যুক্ত। কিন্তু ‘আয়, তোকে ভাইরাল করে দিই!’– এ ঘটনায় ওতপ্রোত জড়িয়ে এই ‘আমি’-র প্রচ্ছন্ন দম্ভ। যে দম্ভ নিয়ে, যে ক্রোধ নিয়ে কেউ হুমকি দেয়: মব-লিঞ্চড করে দেব! এ-ও ঠিক তেমন।
……………………………………
উত্তর ভারতে এক মাছ-ব্যবসায়ী ট্রাক-ভর্তি মাছ নিয়ে ফিরছিলেন। রাস্তা আটকায় একটি বাইক। সেই বাইকের চালক জিজ্ঞেস করছে, জ্যান্ত মাছগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করবে তুমি? এই যে আমি ১০,০০০ হাজার টাকা দিলাম। সব মাছ কিনে নিচ্ছি। পরক্ষণেই সেই বাইক চালক ও তার সাঙ্গপাঙ্গ সব ক’টি মাছের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে শুরু করে এবং একটি নদীতে ছেড়ে দেয়। বলে, এমন পাপকর্ম আর করবে না তোমরা। এতই আকাট আর মূর্খ হয়েছি, হুহু শেয়ার করতে দু’বার ভেবেছেন? বিলকুল না। অথচ বর্ষাকাল এলেই, সর্ষে-ইলিশের জন্য মন আঁকুপাঁকু করবে! এ কেমন ডাবল ট্রুথের দুনিয়ার বাঁচছেন আপনি!
……………………………………
যে ছেলেটি খাবার কাঁধে দু’মিনিট দেরিতে পৌঁছেছিল, সে কী বয়ান দিয়েছে, আদৌ তা কতখানি সত্যি বা মিথ্যা– তোয়াক্কা থোড়াই করছি! সোশাল মিডিয়ায় তা অস্তিত্বহীন। বরং, আমি যেভাবে ঘটনার নেপথ্য নির্মাণ করেছি, সত্যিটা গুবলেছি অথবা সজ্ঞানে চেপেছি, ভদ্রের শরীরে আরোপ করেছি অভদ্রতার ভাষা, আসলে সেটাই ঠিক। আসলে সেটাই ভাইরালযোগ্য। কারণ অস্ত্রপ্রয়োগ করে আমি বলছি! আপনারা দেখুন, সমাজের পক্ষে এহেন জীব দুর্দান্ত ক্ষতিকারক!
সম্প্রতি একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল। উত্তর ভারতে এক মাছ-ব্যবসায়ী ট্রাক-ভর্তি মাছ নিয়ে ফিরছিলেন। রাস্তা আটকায় একটি বাইক। সেই বাইকের চালক জিজ্ঞেস করছে, জ্যান্ত মাছগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করবে তুমি? এই যে আমি ১০,০০০ হাজার টাকা দিলাম। সব মাছ কিনে নিচ্ছি। পরক্ষণেই সেই বাইক চালক ও তার সাঙ্গপাঙ্গ সব ক’টি মাছের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে শুরু করে এবং একটি নদীতে ছেড়ে দেয়। বলে, এমন পাপকর্ম আর করবে না তোমরা। এতই আকাট আর মূর্খ হয়েছি, হুহু শেয়ার করতে দু’বার ভেবেছেন? বিলকুল না। অথচ বর্ষাকাল এলেই, সর্ষে-ইলিশের জন্য মন আঁকুপাঁকু করবে! এ কেমন ডাবল ট্রুথের দুনিয়ার বাঁচছেন আপনি! ভিডিওটি যে বানিয়েছেন, সমগ্র ভারতের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে আদৌ কোনও ধারণা রাখেন না। অথচ কী মুশকিল, সেই মাছ-ব্যবসায়ী রাতারাতি হয়ে উঠলেন সোশাল মিডিয়ায় এক কালপ্রিট। তাকে ঘিরে অপমান এবং অবহেলার ছররা। কিন্তু সৎপথেই তো রোজগার করছিলেন, তবে অস্ত্রাঘাত কেন? কেন ভাইরাল?
কার্ল মার্ক্সের লেখায় পড়েছি, সভ্যতা এগলে, পুঁজি নাছোড়বান্দা হলে, মানুষ মানুষকে পণ্যে পরিণত করবে। আমার বোধে, সেই কথারই কিঞ্চিৎ আপডেটেড ভার্সান হল: মানুষ মানুষকে পরিণত করবে কন্টেন্টে। তাই দেখতে পাই, হেঁটে-চলে বেড়ানো আস্ত মস্ত কন্টেন্ট হয়ে উঠেছি আমরা। বাদবাকি ফাউ। প্রেমিকা ছেড়ে গেছে? আয়, তোকে এইবার ভাইরাল করে দিই। আদর মাখোমাখো মুহূর্ত বিক্রি করি। আমি পাওয়ারফুল। কন্টেন্টের ভাইরালিটি আমাদের উত্তর-আধুনিক মোক্ষ। হিন্দু-মুসলিমের সৌহার্দ্য সম্প্রীতিও তাই ভাইরাল করতে হয়। নইলে ভুলে যাই কি না!
সুধীর মিশ্র একটি ছবি তৈরি করেছিলেন। ‘আফওয়া’। সে ছবির রাজনীতি কিংবা অভিঘাত ছেড়ে, একটি দৃশ্যের কথা বলি। ভরা বাজারে রাজনৈতিক লুম্পেনদের নোংরামির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র, রাহাব জনগণকে বলেছিল, আপনারাও সর্বক্ষণ একটি অস্ত্র বহন করছেন। সদব্যবহার করবেন কবে? অপব্যবহারের কথাই বেশি লেখা হল। তবু, স্মার্টফোনই তো এখন আমাদের প্রাথমিক অস্ত্র। ন্যায়ের। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কখনও আত্মরক্ষার। আত্মপ্রদর্শনের কিংবা আত্মদম্ভের।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোবববার ডিজিটাল
……………………………………