সুসংহত পরিকল্পনার মাধ্যমে এইসব আগ্রাসী ও পরিবেশ-অবান্ধব গাছের বাড়বাড়ন্ত দমন করতে পারে রাষ্ট্রই। তাতে অবশ্য বাধ সাধবে এদের ঘিরে গড়ে ওঠা সফল বাণিজ্যচক্র। হয়তো বা তাতে মিশে থাকবে রাজনীতির ফিকে রঙও। তাও এসব গাছের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে সরকার এবং অসরকারি স্বেচ্ছসেবী সংস্থাদের। জীববৈচিত্র বজায় রাখতে দেশীয় প্রজাতির গাছপালাই যে ভরসা, সে বার্তা পৌঁছে দিতে হবে আনাচে-কানাচে, প্রান্তীয় জনপদে।
‘কেন্দা পিয়াল শেষেঁই ভেল/ মহুল কুসুম কাটি লেল…’। শাল পিয়াল, মহুল কুসুমের খাস তালুকে কেউ পা টিপে টিপে ঢুকে রাজা হতে চায়! ‘উ তো সাহেব বটে’! ফুরফুরে, আঁটোসাঁটো, লম্বা। বেশ ঘটা করে একদিন এই পরদেশিকে ডেকে এনেছিলেন যাঁরা, তাঁদের কল্পনাতেও ছিল না এই ভিনদেশি একদিন পথের ধারের দখলদারি করবে, আদায় করে নেবে সরকারি নীতিকারদের আশকারা। এ ভিনদেশির নাম সোনাঝুরি। নিশ্চয়ই আপনার চোখে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির হাটের ছবি ভেসে উঠছে? সারি সারি আকাশ ছোঁয়া গাছের পায়ের কাছে রংবেরঙের পসরা সাজিয়ে চলছে বিকিকিনি! কিংবা মুকুটমণিপুরের আস্ত টিলা, বনদপ্তরের কল্যাণে সারা গায়ে যার সোনাঝুরির জামা। নামই সোনাঝুরি পাহাড়। আজ অবিশ্যি তা টিকে আছে কি না, কে জানে! আজ শহর থেকে দু’পা বাড়ালেই দেখা মেলে সোনাঝুরির। মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, বীরভূম এবং পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সোনাঝুরির বাস। কেউ কেউ হয়তো আকাশমণি নামে চেনেন তাকে। রবিঠাকুর আকাশমণির রূপে মুগ্ধ হয়ে তার নাম দেন ‘সোনাঝুরি’। গাঢ় হলুদ রঙের আকাশমণি ফুল থোকায় থোকায় ফোটে মঞ্জরীতে। শীতের বেলায় যখন গাছ ভরে যায় ফুলে, তখন তার দেমাক দেখে কে! যেন গা-ভর্তি সোনা। মাটি আলো করে ছড়িয়ে থাকে তার ঝলমলে রেণু। অতি বড় প্রকৃতি-বিমুখ মানুষও একবার যেন না-তাকিয়ে পারে না।
তার বড় হওয়ার ভারী তাড়া। দুদ্দাড় গতিতে বেড়ে চলে। যেন আকাশ ছোঁয়ার পণ করেছে। ১৫ থেকে ৩০ মিটার অবধি লম্বা হয়ে যায় মাত্র কয়েক বছরেই। ছড়িয়ে দেয় ডালপালা। বছরভর সবুজ এই গাছের পাতাগুলো যেন এক একখানা কাস্তের ফলা। নৌকো বললেও ভুল হবে না। গাছের তলায় বিছিয়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো যেন একখানা হাল পেলে এক্ষুনি সাত সমুদ্দুরে পাড়ি দেয় ঢেউ তুলে। বিজ্ঞান-সম্মত নাম অ্যাকেশিয়া অরিকুলিফরমিস। আদি নিবাস, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং পাপুয়া নিউ গিনি।
শৌখিন এ গাছের এদেশে প্রথম বেড়ে ওঠা পূর্ব-ভারতের চা বাগানে। ১৯৩০ সাল নাগাদ চা-এর খেতে ছায়া দিতে ইতিউতি লাগিয়ে দেওয়া হয় সোনাঝুরির চারা। বাগানের শোভাও বাড়ে তাতে। তারপর ধীরে ধীরে দেশীয় বনভূমি আপন করে নেয় এই বিদেশিনীকে। আকশমণি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। বিভিন্ন রাজ্যের বনদপ্তর হাতে চাঁদ পায়। ঝটপট বড় হয়ে যাওয়া আকাশমণি চটজলদি সবুজায়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পে জায়গা করে নেয় আকাশমণি। পথের ধারের সবুজায়ন থেকে পতিত জমির রূপান্তরের কান্ডারী হয় এই যাদুবৃক্ষ। আম জাম শাল পিয়াল কদম করঞ্জা যেন বেশ ব্রাত্যই হয়ে পড়ে। ধীর পায়ে হাঁটা এই সব গেঁয়ো যোগীদের পিছনে ফেলে তরতরিয়ে এগিয়ে চলে আকাশমণি।
……………………………………………………
শৌখিন এ গাছের এদেশে প্রথম বেড়ে ওঠা পূর্ব-ভারতের চা বাগানে। ১৯৩০ সাল নাগাদ চা-এর খেতে ছায়া দিতে ইতিউতি লাগিয়ে দেওয়া হয় সোনাঝুরির চারা। বাগানের শোভাও বাড়ে তাতে। তারপর ধীরে ধীরে দেশীয় বনভূমি আপন করে নেয় এই বিদেশিনীকে। আকশমণি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে। বিভিন্ন রাজ্যের বনদপ্তর হাতে চাঁদ পায়। ঝটপট বড় হয়ে যাওয়া আকাশমণি চটজলদি সবুজায়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
……………………………………………………
কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। কয়েক বছরের মধ্যেই পরিবেশ দপ্তর বুঝতে পারে এই আকাশমণি ভারী আগ্রাসী স্বভাবের। নিজের বংশ বিস্তার করে ছেয়ে ফেলে সমূহ অঞ্চল। যেখানে আকাশমণির আধিপত্য, সেখানে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে দেশীয় ঝোপঝাড়, ঘাস-লতা-গুল্ম। হারিয়ে যেতে থাকে তাদের সঙ্গে সহবাস করা পোকামাকড়, জীবজন্তুও। এককথায় দেশীয় ইকোসিস্টেম নষ্ট হতে থাকে। এলাকা দখল করে রাজত্ব করতে চায় আকাশমণি। এ বড় বিপদের কথা। জীববৈচিত্রের নিরীখে এ এক অশনি সংকেত। পরিবেশ দপ্তরের সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে বিরোধ বাঁধে বন দপ্তরের। বন দপ্তর চায় তড়িঘড়ি বনাঞ্চলের পরিধি বাড়িয়ে বাহবা নিতে। সোনাঝুরি তাই তার কাছে নীলনয়না। অন্যদিকে পরিবেশ দপ্তর চায় দেশীয় প্রজাতির গাছপালার সুরক্ষা। এ বিরোধ সহজে মেটার নয়। সোনাঝুরির পাল্লা যে বেশ ভারী!
এই রূপসী সোনাঝুরির ডালে বাসা বাঁধে না কোনও পাখি। এ গাছের ফলে কামড় দেয় না কোনও কাঠবেড়ালি, হনুমান কিংবা পাখপাখালি। এ গাছে আশ্রয় নেয় না কোন পোকামাকড়। এ ফুলের মধু খেতে গুনগুনিয়ে আসে না মৌমাছির ঝাঁক। এ গাছের পাতার ওপর মোমের মতো আস্তরণ থাকায় তা সহজে মাটিতে মিশে যায় না। কোন গবাদি পশুর খাদ্যও নয় এ পাতা। পাতার ট্যানিন আশপাশের ক্ষেতের উর্বরতা নষ্ট করে। মাটির গুণাবলি ধ্বংস করে। এ ফুলের পরাগ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে শ্বাসকষ্টের কথাও শোনা যায়। সোনাঝুরির পায়ের কাছে একটা ঘাসও জন্মায় না। এমন আত্মসুখী গাছ বুঝি কমই হয়।
এসব দোষের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। কিন্তু সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কথা হল, এ গাছ মাটির তলা থেকে হু হু করে জল শুষে নেয়। লাফিয়ে লাফিয়ে জনসংখ্যা বেড়ে চলা, নগরায়ণ এবং জল সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে দেশের ভূগর্ভস্থ জলস্তর এমনিতেই দ্রুত নেমে যাচ্ছে। তার ওপর সোনাঝুরির মতো গাছেরা তাদের জৈবিক চাহিদা মেটাতে টেনে নেয় বিপুল পরিমাণ জল। তার জন্য এরা শিকড় ডুবিয়ে দেয় মাটির অনেক গভীরে, ছড়িয়ে দেয় চারপাশেও, অনেক দূর দূর পর্যন্ত। গবেষণা বলছে সোনাঝুরি অঞ্চলের মাটি ক্রমাগত আর্দ্রতা হারাচ্ছে।
তবু সোনাঝুরির প্রতি মানুষের ঝোঁক বেড়েই চলেছে। পতিত জমিতে তো বটেই, সাধারণ ক্ষেতেও অন্য ফসল না চাষ করে বহু চাষি সোনাঝুরি গাছ লাগাচ্ছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা, পাঁচ বছরে সোনাঝুরির থেকে যে আয় তাঁরা পান, ওই একই জমিতে দশ বছর ফসলের চাষ করেও সেই আয় তাঁরা পান না। জ্বালানি, আসবাব এবং শিল্পের প্রয়োজনে সোনাঝুরি কাঠের কদর খুব। বিশেষ করে কাগজ শিল্পে সোনাঝুরি কাঠের মণ্ডের বেশ চাহিদা আছে। নামমাত্র চাষের খরচ এবং খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে যাওয়ার কারণে বাণিজ্যিকভাবে অনেক বেশি লাভজনক হয়ে উঠছে এই বাহারি বিদেশিনী।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তাই সরকারিভাবেও সোনাঝুরিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। শুধু সোনাঝুরি নয়। সঙ্গে দোসর আরও এক সাহেবি গাছ। ইউক্যালিপটাস। প্রায় একই রকম ভাবে ইউক্যালিপটাসও জীববৈচিত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে বাণিজ্যসফল একমুখী চাষে প্রলুব্ধ করছে মানুষকে। মাটির নিচের জল শুষে নিতে সোনাঝুরির চেয়েও দড় ইউক্যালিপটাস।
একক মানুষ তার ব্যাক্তিস্বার্থই দেখবে। সমষ্টির দীর্ঘকালীন ভালো-মন্দের কথা ভাবতে তার বয়েই গেছে। সে দায় রাষ্ট্রের। সুসংহত পরিকল্পনার মাধ্যমে এইসব আগ্রাসী ও পরিবেশ-অবান্ধব গাছের বাড়বাড়ন্ত দমন করতে পারে রাষ্ট্রই। তাতে অবশ্য বাধ সাধবে এদের ঘিরে গড়ে ওঠা সফল বাণিজ্যচক্র। হয়তো বা তাতে মিশে থাকবে রাজনীতির ফিকে রঙও। তাও এসব গাছের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে সরকার এবং অসরকারি স্বেচ্ছসেবী সংস্থাদের। জীববৈচিত্র বজায় রাখতে দেশীয় প্রজাতির গাছপালাই যে ভরসা, সে বার্তা পৌঁছে দিতে হবে আনাচে-কানাচে, প্রান্তীয় জনপদে।
…………………………………………………..
আরও পড়ুন মৌসুমী ভট্টাচার্য্য-র লেখা:
…………………………………………………..
শাল, কুসুম, পলাশ, সেগুনের গায়ে পিঠে লুকোচুরি খেলবে শালিখ-ময়নারা। কদম, নিম, জাম, কাঁঠালের উঠোনে আনন্দে জেগে উঠবে হরেক ঘাসের শিষ। হরিতকি, বহেড়া, আমলকির ডালে নেচে বেড়াবে কাঠবেড়ালি। ঝোপেঝাড়ে নিশ্চিন্তে ঘরকন্না করবে ঝিঁঝিঁর দল। প্রজাপতি আর ফড়িং-এর ওড়াউড়ি দেখে আনন্দে-বিস্ময়ে তালি দেবে কচিকাঁচারা। একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে টিকিয়ে রাখবে পরিবেশের ভারসাম্য। কোনও একক প্রজাতির জঙ্গুলে-আগ্রাসন নয়, বৈচিত্রই হোক বনবিতানের জিয়নকাঠি। পরস্পরের বোঝাপড়াই হোক বনভূমির মর্মকথা।
অর্থকরী বিদেশিনীর প্রেমে মজবার দিন বোধ হয় ফুরিয়েছে। রাজা মিডাসের সোনার মোহের মতো সোনাঝুরির মোহ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ছিন্ন হোক এ মোহ-আবরণ। দেশজ গাছগাছালি, পশুপাখি, নিজ ভূমে পরবাসী না হয়ে যায়। আর না বিলাপ করেন প্রান্তবাসী জঙ্গল-সখা সেই সব মানুষেরা, যাঁদের বুকের মধ্যে বাস করে শাল-পিয়াল, যাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে থাকে মহুল বনের মাদকতা, যাদের দুচোখ জেগে থাকে পলাশ-কুসুম-তমাল বনের সীমাহীন পাহারায়। অরণ্য পাক তার দেশজ ঐতিহ্যের অধিকার।
‘আকাশমণি সোনাঝুরি, তর ল্যাগে গড় করি/ মরি গেলা, মরি গেলা গে ধনী/
ছেড়ি কেরীঘাস, সে তো মরি গেলা…’।
………………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………….