আজকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আসলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সরকার ও আওয়ামি লীগ দলটিও চায়নি বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীন মুক্ত কণ্ঠস্বর। তারা মোসাহেব তৈরিতেই বেশি উৎসাহী ছিল, যাতে করে তাদের রাজনৈতিক একাধিপত্য বজায় থাকে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও একদা মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সম্প্রতি একটি টিভি সাক্ষাৎকারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের পর তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে তাঁদের প্রস্তাব ছিল প্রথমে একটি প্রভিশনাল রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্ট তৈরি করে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করার।
বাংলাদেশ এক গণআন্দোলন দেখছে। শুরু হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিরাট অংশের সংরক্ষণকে চ্যালেঞ্জ করে। সংরক্ষণ ব্যবস্থার সংস্কার দাবি করে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেমে আসে ছাত্রলীগ ও পুলিশের বর্বর অত্যাচার। আন্দোলনরত ছাত্ররা কিন্তু একবারও বলেননি সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সংরক্ষণ তুলে নিতে হবে, তাদের দাবি ছিল স্পষ্ট– মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষণের সামাজিক প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে, তাই তা বাতিল করতে হবে। ছাত্রদের ওপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ক্রমে পথে নামেন বস্ত্র শ্রমিক, রিকশাচালক, ছোট ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকবৃন্দ। স্বতস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনের চেহারা নেয় ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন। রাষ্ট্রব্যবস্থা যাঁরা চালান, তাঁদের ধারণা ছিল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে ক্ষোভ বুঝি প্রশমিত হবে। কিন্তু তা হয়নি। তার দুটো মূল কারণ, প্রথমত, আদালতের রায় সরকারি চাকরি-ব্যবস্থাকে ৯৩% সংরক্ষণ-মুক্ত করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৫% সংরক্ষণ বহাল রাখল, ফলে মহিলা, জনজাতি, বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য পড়ে থাকল মাত্র ২% সংরক্ষণ! এটা মেনে নেওয়া আন্দোলনকারী ছাত্রদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা সরকার যে পৈশাচিক দমন-পীড়ন নামিয়ে আনল তাতে আপোষ রফার কোনও জায়গা আর থাকল না। আওয়ামি লীগ সরকার যে প্রতিক্রিয়া দেখাল তাতে মনে হচ্ছিল যেন সে তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে আজ বাংলাদেশের মানুষ কারফিউ ও বুলেটের ভয় জয় করে আওয়াজ তুলল ‘এক দফা এক দাবি’। পরিণামে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটল।
প্রশ্নটা হল, এখানে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী? সত্যি কথা বলতে, তেমন কোনও ভূমিকাই নেই। হাতে গোনা কয়েকজন অবশ্যই বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের তার বাইরে কোনও বৃহত্তর ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যেকোনও দেশে আজকের দিনে বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ শিক্ষক-অধ্যাপকবৃন্দ। একটা দেশের মুক্তচিন্তার ধারক ও বাহক বলে তাঁদের মনে করা হয়। তাদের একটা অংশ পথে নেমেছেন ছাত্রদের ওপর নেমে আসা অত্যাচারের প্রতিবাদে। ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, চট্টগ্রাম– দেশের প্রধান সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন। কিন্তু তার অনেকটাই বিবেকের তাড়নায়। সরকারি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁরা আজ বেশ কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে সোচ্চার হলেও এখনও সম্প্রদায়গতভাবে তাঁদের মত ও অবস্থান পরিষ্কার নয়। এঁদের মধ্যে অনেকেই, তাঁরা বেশিরভাগই ক্ষমতাবান ও বরিষ্ঠ অধ্যাপক, মুখ তো খোলেনইনি এমনকী, আন্দোলনকারীদের অশান্তি সৃষ্টিকারী ও সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের খলনায়ক বলে অভিযুক্ত করেছেন! অথচ এঁদের পূর্বসূরিরা আজ থেকে ৫৫ বছর আগে কালান্তক রাজাকারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ছাত্র আর মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে দাঁড়িয়ে কারাবরণ করেছিলেন, এমনকী, শহিদত্ব বরণ করেছিলেন। আর তারও পূর্বে আমরা জানি, এই ভূখণ্ডে ছাত্র-শিক্ষক-বিজ্ঞানী-আইনজীবী-লেখক প্রত্যেকে মিলে দুর্দান্ত ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিলেন।
তাহলে বিগত পাঁচ দশকে কী এমন ঘটল যে, বাংলাদেশে একটা সিভিল সোসাইটি গড়ে উঠল না যাঁরা কিনা স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার স্পর্ধা রাখেন। বরং উল্টোদিকে এমন একটা ক্ষুদ্র শহুরে মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিল– যাঁরা গরমেও কোট-প্যান্ট পরে ও রাষ্ট্র-ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরে বেড়ায়। তাঁদের একমাত্র উচ্চাশা উচ্চবিত্তের মতো ‘দেখনদারি’ জীবন কাটানো আর অক্ষমের কাছে ক্ষমতার আস্ফালন করা। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। কারণ একটা মুক্তিযুদ্ধে জয়ী দেশে ‘উই দ্য পিপল’-এর স্বর আরও সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল, গণতন্ত্রের ভিত আরও সুদৃঢ় হওয়ার কথা ছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ড. আনিসুজ্জামান বা হুমায়ুন আজাদের মতো মুক্তচিন্তা করা আপোষহীন বুদ্ধিজীবী-অধ্যাপকরা সেদেশে সংখ্যালঘু হয়ে থেকে গেলেন। বেশিরভাগই হয়ে গেলেন ক্ষমতার দাক্ষিণ্যের ভিক্ষাপ্রার্থী ও মোসাহেব। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটের পরাজয় ঘটল।
………………………………………………………
একটা মুক্তিযুদ্ধে জয়ী দেশে ‘উই দ্য পিপল’-এর স্বর আরও সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল, গণতন্ত্রের ভিত আরও সুদৃঢ় হওয়ার কথা ছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ড. আনিসুজ্জামান বা হুমায়ুন আজাদের মতো মুক্তচিন্তা করা আপোষহীন বুদ্ধিজীবী-অধ্যাপকরা সেদেশে সংখ্যালঘু হয়ে থেকে গেলেন। বেশিরভাগই হয়ে গেলেন ক্ষমতার দাক্ষিণ্যের ভিক্ষাপ্রার্থী ও মোসাহেব। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটের পরাজয় ঘটল।
………………………………………………………
আজকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আসলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সরকার ও আওয়ামি লীগ দলটিও চায়নি বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীন, মুক্ত কণ্ঠস্বর। তারা মোসাহেব তৈরিতেই বেশি উৎসাহী ছিল, যাতে করে তাদের রাজনৈতিক একাধিপত্য বজায় থাকে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও একদা মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সম্প্রতি একটি টিভি সাক্ষাৎকারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের পর তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে তাঁদের প্রস্তাব ছিল প্রথমে একটি প্রভিশনাল রেভল্যুশনারি গভর্নমেন্ট তৈরি করে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করার। সেসব দাবি মানা হয়নি। আওয়ামি লীগ ও তার অনুগামীদের ক্ষমতা পাইয়ে দেওয়ার ইচ্ছাটাই প্রাধান্য পেল। আর বিরোধিতা করলে ‘রাজাকার’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যাসটা আজকের নয়, গোড়া থেকেই ছিল। সেদিনও বাংলাদেশে ‘রাজাকারদের সহযোগী’ অপবাদ দিয়ে হাজার হাজার কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়েছিল। কবি, মুক্তিযোদ্ধা, বিপ্লবী ও সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ সিকদারের হত্যা তার অন্যতম উদাহরণ। ১৯৭৫ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর দল তখন জেলায় জোতদার ও সুদখোরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। পুলিশ কাস্টডিতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও জনগণের স্বাধীন মুক্ত স্বরকে ধূর্ত আওয়ামি লীগ আর একটা পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় করেছিল। তারা আওয়ামি লীগ-বিরোধী সমস্ত সেকুলার কণ্ঠস্বরকে পর্যায়ক্রমে হয় হত্যা করেছিল বা নীরব করে দিয়েছিল। ফলে আওয়ামি লীগ বনাম বিএনপি-জামাত– এই বাইনারির বাইরে বেরনোর কোনও উপায় ছিল না মানুষের কাছে। এমনকী, সমাজের অগ্রণী অংশের আপোষহীন শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের কাছেও আওয়ামি লীগকে সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিল না। ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হল এই বাইনারির বাইরে তাঁরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে দেখার চেষ্টা করেছেন। সেই স্পর্ধাটা খুব জরুরি ছিল। একটা সফল গণ-আন্দোলন ছাড়া অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব ছিল না। আসলে এইরকম একটা র্যাডিক্যাল সমাধানের কথা চিন্তা করা বুদ্ধিজীবী-কুলের পক্ষে একটু কঠিন, কারণ এই ধরনের বিরাট পরিবর্তন তাঁদের শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে অনুকূল নয়। এইরকম বৈপ্লবিক পরিবর্তন যে অনিশ্চয়তা আনে, তা শ্রেণিগতভাবে বুদ্ধিজীবীদের জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়। ম্যাক্সিম গোর্কি তো সবাই হয় না!
………………………………………………………
আরও পড়ুন সালমান সাদ-এর লেখা : আমাকে বেঁচে থাকতে হবে আমার আক্রান্ত ভাই-বোনেদের কথা বলার জন্য
………………………………………………………..
আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন। আন্দোলনের জয় হল। যদিও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলাদেশের শিক্ষক-অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীকুল আন্দোলনকে তেমন কোনও দিশা দেখাতে পারেননি। ‘স্বতস্ফূর্ত’ আন্দোলনে তাঁরা অবশ্য অনেকে সহমর্মিতা জানিয়েছেন, কিন্তু ওইটুকুই। এখন সারা পৃথিবীর চোখ বাংলাদেশের দিকে, নতুন যে সরকার তৈরি হবে তারা গণতন্ত্রকে সুনিশ্চিত করতে কী পদক্ষেপ করে, তা দেখার। তবে এটা বলাই যায় যে, মুক্ত স্বাধীন একটা বুদ্ধিজীবীকুল গড়ে না তুলতে পারলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিষ্কণ্টক হবে না। সেটা বাস্তবে হবে কি না, তার জবাব আপাতত ভবিষ্যতের হাতে।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….