ভোটবিমুখ তরুণদল। তারা দেখছে, দল ব্যাপারটা সহজেই বদলে নেওয়া যায়। দেখতে রাতবিরেতে রাতারাতি দল বদলে নিচ্ছে নীতিবিক্রেতারা। তারা কী করেই বা আস্থা রাখবে ভোটে? কিন্তু তর্জনী তাই বলে নিঃশব্দ থাকবে ভোটযন্ত্রে? এই-ই তো উপায় ছিল বদলে দেওয়ার। তবে কি বিকল্প নেই, কিংবা বিকল্পেরও ভরসা নেই? নেই মন্দের ভালো? তবু, আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব থেকে কি সহজে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়?
সিনেমাহল এতক্ষণ ফেটে পড়েছিল সিটি আর চিৎকারে! অকস্মাৎ, চতুর্থ দেওয়াল ভেঙে, যেন ঘোরতর রিয়েলিটিতে নেমে এলেন ভারতীয় গণমনের সুপারস্টার। শাহরুখ খান। তাঁর ডানহাতের তর্জনী উদ্যত। গভীর প্রত্যয়ে বলছেন, এই তর্জনীরই ক্ষমতা আছে প্রশ্ন করার। নাগরিক অধিকার বুঝে নেওয়ার। এবং, ভোট দেওয়ার!
‘জওয়ান’ ছবিটি মুক্তির পর, পেরিয়ে গিয়েছে ছ’মাস। তবু সে ছবির উদ্দামতা ফিকে হতে সময় লাগল বহুদিন। এরপর এল লোকসভা নির্বাচন। সাত দফা। পেল্লাই আয়োজন। দ্বিতীয় দফার নির্বাচন-মুহূর্তে দু’টি ঘটনা ঘটল বেঙ্গালুরু শহরে।
প্রথমটি, এক সত্তরোর্ধ নারীর। নাম কলাবতী। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমাগত কমছে। শুক্রবার দিন সকলকে বিস্মিত করেই, ভোট দিতে এলেন তিনি! স্ট্রেচারে শুয়ে। ভোট তো গণতান্ত্রিক অধিকার! কর্তব্য! এ-ঘটনার বিপ্রতীপে স্থির দাঁড়িয়ে বেঙ্গালুরু শহরের তরুণ প্রজন্মের ভোট-বিমুখতা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যত দোষ এই তরুণদলের? তাদের ভোটবিমুখতার নেপথ্যে কি রাষ্ট্র দায়ী নয়? তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ বেঙ্গালুরু শহর থেকে পরিযায়ী হয়েছে শেষ ক’বছরে। কেউ আবার বলেছে, কাকে ভোট দেব? আমাদের কথা নেতা-মন্ত্রীরা মনযোগ দিয়ে শোনে আদৌ? কেউ বা বলছে, যে নেতাকে সমর্থন করি, একরাতের মধ্যেই দল বদলে নেবে সে-ই। এরপরই সেই মোক্ষম প্রশ্ন: দায় আসলে কার? এক এবং একমাত্র নিরুদ্বিগ্ন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীর। ধীরে ধীরে রাজনীতির শব্দকোষ থেকে ‘নীতি’ শব্দটিকে উৎখাত করেছে তারাই।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অগত্যা কী উপায়? তর্জনীতে ভোটের কালি লাগলেই পাওয়া যাবে এক মগ বিয়ার। ধোসা। ঘি-ভাত। এসি ট্যাক্সিতে মনোরম যাত্রা। বিনামূল্যে। রেস্তোরাঁ ও পাবে বিশেষ ভোটকালীন ছাড়। অর্থাৎ, ভোটপ্রক্রিয়ার সঙ্গে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ এক্কেবারে মুফত! পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের কী কদাকার চেহারা।
তারপরও, বেঙ্গালুরু শহরের তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে ভোটদানের হার তলানিতেই। ৫৩ শতাংশ মানুষ ভোট দিলেন। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে, যা সর্বনিম্ন। অবশিষ্টরা উদাসীন। অথবা এড়িয়ে গেলেন। মুখ ফিরিয়ে থাকলেন তরুণ প্রজন্মের একাংশ। কেন? রাষ্ট্র তো সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছিল। বোঝাতে চেয়েছিল, গণতন্ত্রের পথ কতখানি মসৃণ! এক ইন্সটাগ্রাম রিল থেকে অন্য রিলে ‘সোয়াইপ’ করার মতোই সহজ, চিন্তাহীন এবং খুব ‘কুল’। পাশেই সাজানো রয়েছে ঠান্ডা বিয়ার। প্রলুব্ধকর একটা হ্যালের দুনিয়া। অথচ এই বেঙ্গালুরু শহরেই যে পানীয় জলের ভয়াবহ আকাল, সে খেয়াল করলেন কেউ?
কলাবতী দেবী সম্ভবত খেয়াল করেছিলেন। তরুণ প্রজন্ম করতে চায়নি। কিন্তু যত দোষ এই তরুণদলের? তাদের ভোটবিমুখতার নেপথ্যে কি রাষ্ট্র দায়ী নয়? তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ বেঙ্গালুরু শহর থেকে পরিযায়ী হয়েছে শেষ ক’বছরে। কেউ আবার বলেছে, কাকে ভোট দেব? আমাদের কথা নেতা-মন্ত্রীরা মনযোগ দিয়ে শোনে আদৌ? কেউ বা বলছে, যে নেতাকে সমর্থন করি, একরাতের মধ্যেই দল বদলে নেবে সে-ই। এরপরই সেই মোক্ষম প্রশ্ন: দায় আসলে কার? এক এবং একমাত্র নিরুদ্বিগ্ন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীর। ধীরে ধীরে রাজনীতির শব্দকোষ থেকে ‘নীতি’ শব্দটিকে উৎখাত করেছে তারাই। জনসমর্থন নিয়ে পিংপং খেলছে আর খেলবেও তারাই। তাদের দলীয় পরিচয় পৃথিবীতে বায়বীয়। সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, এ-আই– সকলেই ধরব ধরব করে, কিন্তু শেষ অবধি ধরতে ছাই পারে না!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ভোটে যারা পরিযায়ী
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু তা’বলে, তরুণ প্রজন্মের নিজস্ব কিছু দায়িত্ববোধ তৈরি হবে না? সোশাল মিডিয়ায় দুটো ফেক নিউজ শেয়ার করাটাই নাগরিক কর্তব্য? অবশ্যই ঘেঁটে দেখে বুঝে নিতে হবে, ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলই ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা নেয়নি। এ-ও বুঝে নিতে হবে, ভোট মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। তর্জনীর আশ্চর্য ক্ষমতা। সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট খুব ভাইরাল, যেখানে চূড়ান্ত বিকৃতির পর্যায়ে পৌঁছেছে মানুষের খিদের অধিকার। একমুঠো ভাত চাওয়াটাই একুশ শতাকের উচ্চমার্গের মিম। হাজার শেয়ার। হাজার কমেন্ট। হাজার রিয়্যাকশান। আর জ্বলজ্বল করে, ক্ষুদাসূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষের অবস্থান– ১১১!
‘দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্স’-এ নোয়াম চমস্কি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বিষয় ছিল, গণতন্ত্রের উত্থান-পতন। সেখানে চমস্কি বলছেন: ‘অবিরাম প্রোপাগান্ডা মানুষের মন থেকে আজকের বাস্তব পরিস্থিতির একটা মৌলিক সত্যই মুছে দিতে পেরেছে যে রাজনীতি কদর্য হতে পারে, কিন্তু তার কারণ তো সমাজের ওপর ব্যবসায়িক জগতের অশুভ ছায়া। স্বভাবতই ছায়াটা দেখা যায়, কিন্তু কীসের ছায়া, তা দেখতে না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।’ ঠিক এরপরেই, তিনি যে-কথাটি বলেন, তার সরল করলে দাঁড়ায়: আধুনিক ধনতন্ত্রের এটাই নতুন তত্ত্ব– অধিকার নয়, বাজারে যা পাবে, সেটাই গ্রহণ করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যবসায়ীগণ! শাসকরা অবশ্য এই তত্ত্ব মেনে নেয়নি।
অতঃপর, গণতন্ত্রের লাজনিবারণে পুনরায় ভোট। ২০২৪ সালে, ভারতের যে প্রজন্ম প্রথম ভোটাধিকার পেল, ৭২ শতাংশই ভোট দিল না! ঝলমলে হোর্ডিং-এ লেখা, ডবল ডবল চাকরি হবে। প্রকাণ্ড মঞ্চ থেকে প্রচণ্ড স্বর শোনা যাচ্ছে, ভোটের পরে বেকারত্বের হার পৌঁছবে শূন্যে। দেশের একমাত্র হাই-টেক স্বপ্নশহর পুড়তে থাকে রোদে। বিনামূল্যে সুখ বিলি হয় রাস্তায়। ধুঁকতে ধুঁকতে সরকারকে এখনও প্রশ্ন করেন কলাবতীর মতো কেউ কেউ। দুই প্রজন্মের ভেতরে গণতন্ত্রের ধারণা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যায়। দুই মেরুতে ভীষণ ছটফট করে একই দেশের দুই কিসিমের, দুই ধারণার নাগরিক। আমি জোম্যাটোয় খাবার অর্ডার করি। সাইকেল চালিয়ে যে ছেলেটি আসে, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি! আমার ক্লাসমেট। বয়স তেইশ। গলা ধরে আসে। গ্রাসনালিতে খাবার আটকে যায়। ভাবি, রেটিং-এ কত দেব? অনন্ত ভোট?