খাপছাড়াভাবে জনপ্রিয় বা ততটা জনপ্রিয় নয়, এমন লেখকদের বই মাঝে সাঝে অনূদিত হয়েছে বইকি, কিন্তু সে বই কি বিশ্ব পরিসরে পৌঁছেছে? তার যোগ্য বিপণন হয়েছে? বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করার জন্য অ্যাকাডেমি রয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে বিশ্বপরিসরে বাংলা বই পৌঁছে দেওয়ার কোনও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা কি হয়? প্রকাশনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি শুধুই বাঙালি পাঠকের হাতে হাতে নিজেদের বই ঘুরে বেড়ানোতেই সফল? প্রকাশনায় সম্পাদকের আসনটিই আজ ভগ্নপ্রায়, উইধরা। সেখানে ভালো বাংলা বইয়ের অনুবাদক জুটবে, তা কি আশা করা যায়? কেন অনুবাদের একটা আলাদা শাখা গড়ে উঠবে না, যেখানে ধারাবাহিকভাবে অনূদিত হবে বাংলা সাহিত্য?
গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ২০২২ সালে হিন্দি ভাষার গীতাঞ্জলি শ্রী-র ‘রেত সমাধি’ (‘টোম্ব অফ স্যান্ড’) আন্তর্জাতিক বুকার জিতে নেওয়ার পরে এই বছরও কন্নড় সাহিত্যিক বানু মুশতাকের ‘হার্ট ল্যাম্প’ একই পুরস্কার পায়। এর আগেও মলয়ালম, তামিল ও অন্যান্য ভাষার সাহিত্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে উঠে এসেছে। অথচ বাংলা সাহিত্য– যা একদা ভারতীয় সাহিত্যের পুরোভাগে ছিল– বুকার তালিকায় এখনও অনুপস্থিত। যখন বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার সাহিত্য একে একে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে চিহ্নিত হচ্ছে, তখন বাংলা ভাষার অনুপস্থিতি শুধু অবাক করে না– এক ধরনের উদ্বেগও তৈরি করে। এর আগে মহাশ্বেতা দেবী মনোনীত হয়েছিলেন– যদিও তখন নিয়ম আলাদা ছিল, পুরস্কার দেওয়া হত লেখকের সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তিকে, নির্দিষ্ট কোনও উপন্যাস বা গল্প সংকলনকে নয়।
আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার অনূদিত কথাসাহিত্যের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পুরস্কার। বাংলা ভাষায় অনুবাদের ইতিহাস কম সমৃদ্ধ নয়। রবীন্দ্রনাথের নিজের অনুবাদ যেমন যুগান্তকারী, তেমনই বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে আন্তর্জাতিক পাঠক মুগ্ধ হয়েছেন। প্রতিটি ভাষারই থাকে একটি সাংস্কৃতিক ধ্বনি, একটি ভেতরের স্বর– যা শুধুই ব্যাকরণ নয়, বরং একটা সামগ্রিক অভিজ্ঞতা। যেমন ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর ‘নৌকাডুবি’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র-ভাষ্যকে নতুন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছিলেন– একটা সংলাপ তৈরি করেছিলেন ভাষা আর সময়ের মধ্যে। সাহিত্য অনুবাদেও সমান দক্ষতার ইতিহাস বাংলায় বিরল নয়। সাহিত্য অনুবাদেও সমান দক্ষতার ইতিহাস বাংলায় বিরল নয়। উৎসের প্রতি সম্মান রেখেও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-পৌলমী সেনগুপ্তরা যেমন টিনটিনকে সূক্ষ্মভাবে বাঙালির নিজের করে দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বুকার মনোনীত সাম্প্রতিক কিছু উপন্যাস যেমন– ভিনসেন্ট দেলাক্রোয়ার ‘স্মল বোটস’, বা ভিনচেনজো লেট্রোনিখোর ‘পারফেকশন’– নগর নিঃসঙ্গতা, মানব অভিবাসন বা পরিযায়ী বাস্তবতা নিয়ে গভীর ভাবনার খোরাক জোগায়। এদের মধ্যে যেমন পাওয়া যায় সমকালের সমস্যার সঙ্গে গভীর সংযোগ, আবার চিরন্তনের উচ্চারণও। সেরকমই মারিইকে রাইনভেল্ড, জেনি এরপেনবেক, ওলগা তোমারচুক বা জশুয়া কোহেনের লেখায় ইন্টারনেট গোপনীয়তা, আসল ও কৃত্রিম অভিব্যক্তির ভেদরেখা, কিংবা রাজনৈতিক জটিলতা বলিষ্ঠ, সাহসী ভাষায় অনূদিত হয়। আজকের সমকালীন বাংলা উপন্যাসে আজ সেই বিস্তার, সেই ঝুঁকি, সেই পরীক্ষাধর্মিতা এখন কি সংখ্যালঘু? আজকের বাংলা গদ্য কি নির্মাণে সংশয়ী কিংবা অপ্রতিভ? নাকি লেখা হয়ে চলেছে, পাঠক সেই লেখার কাছাকাছি পৌঁছতে পারছে না! বঙ্গে এমন বিলাপ প্রায়শই শোনা যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও তিলোত্তমা মজুমদারের পর, বিশেষত বাংলা গদ্যের বৈচিত্রে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি হয়েছে? জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও এঁদের বই কি তেমন অনূদিত হয়েছে নিয়মিতভাবে? খাপছাড়াভাবে জনপ্রিয় বা ততটা জনপ্রিয় নয়, এমন লেখকদের বই মাঝে সাঝে অনূদিত হয়েছে বইকি, কিন্তু সে বই কি বিশ্ব পরিসরে পৌঁছেছে? তার যোগ্য বিপণন হয়েছে? বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করার জন্য অ্যাকাডেমি রয়েছে, কিন্তু সেখান থেকে বিশ্বপরিসরে বাংলা বই পৌঁছে দেওয়ার কোনও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা কি হয়? প্রকাশনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি শুধুই বাঙালি পাঠকের হাতে হাতে নিজেদের বই ঘুরে বেড়ানোতেই সফল? প্রকাশনায় সম্পাদকের আসনটিই আজ ভগ্নপ্রায়, উইধরা। সেখানে ভালো বাংলা বইয়ের অনুবাদক জুটবে, তা কি আশা করা যায়? কেন অনুবাদের একটা আলাদা শাখা গড়ে উঠবে না, যেখানে ধারাবাহিকভাবে অনূদিত হবে বাংলা সাহিত্য?
প্রকাশনার প্রতিবন্ধকতা এখানেই শেষ নয়। বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলি বাংলা সাহিত্য অনুবাদে সামান্য আগ্রহ দেখালেও, তা প্রায়শই ক্লাসিক লেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের বহু মূল্যবান লেখা শুধু প্রকাশকের অনীহার কারণেই অনুবাদের আলো দেখতে পায় না। বেশিরভাগ অনুবাদ এখনও আটকে আছে পুরনো কালের মহীরুহদের মধ্যে। সমকালীন লেখকদের কাজের অনুবাদ এখনও বিরল । সেই তুলনায়, মলায়লাম ভাষার ‘মুস্ট্যাশ’ ও ‘আ প্রিফেস টু ম্যান’ অথবা তামিলের ‘পায়ার’-এর অনুবাদ বিকল্প প্রকাশকের সহায়তায় আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সম্প্রতি ‘পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া’ শ্রীজাতর ‘হাউস অফ রেইন অ্যান্ড স্নো’ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম। অধিকাংশ লেখকই অনুবাদের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হন। অনুবাদকের সম্মানদক্ষিণা কম হওয়ায় দক্ষ অনুবাদকেরাও নিরুৎসাহিত হন। বাংলার বিকল্প বা কুটির প্রকাশনাগুলোর সামনে রয়েছে এক বিশাল সম্ভাবনা। তারা সাহিত্যের মান বজায় রাখলেও, আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছনোর আর্থিক ও পরিকাঠামোগত সক্ষমতা তাদের নেই। আর বড় প্রকাশকরা (যেমন পেঙ্গুইন, হার্পার কলিন্স) কদাচিৎ বাংলা অনুবাদে আগ্রহ দেখায়।
এই প্রেক্ষাপটে, আশাব্যঞ্জক কিছু উদ্যোগ অবশ্যই দেখা যাচ্ছে। যেমন, অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ট্রান্সলেশন’ নিষ্ঠার সঙ্গে আধুনিক বাংলা সাহিত্য অনুবাদের দায়িত্ব করে চলেছে। ২০২২-এ একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক অরুণাভ সিনহা মন্তব্য করেন, বাংলা সাহিত্যে ভালো বইয়ের অনুবাদ করার ক্ষমতা থাকলেও, তা প্রকাশ করার সদিচ্ছা কম।
আরেকটি বড় সমস্যা হল প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা। হিন্দি, তামিল কিংবা মলায়লম সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রচারে যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নানা পদক্ষেপ চোখে পড়ে, সেখানে বাংলা সাহিত্য প্রায় একান্তই রাজ্য সরকারের দায়িত্বে সীমিত। ‘সাহিত্য অকাদেমি’ বা ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’ অনুবাদ প্রকাশ করলেও, সেগুলিকে আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরিচিত করানোর মতো বিপণন কাঠামো প্রায় অনুপস্থিত। অনুবাদকদের উৎসাহ ও স্বীকৃতি– উভয়ই এতে খর্ব হয়।
বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারের উপযুক্ত করে তুলতে হলে প্রয়োজন সাহিত্যের কৌশলগত অনুবাদ, আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ ও বহুভাষিক যোগাযোগের সেতু নির্মাণ। বাংলা এখনও সেখান থেকে অনেক দূরে। এই বাস্তবতা যত দ্রুত বোঝা যায়, তত দ্রুত সম্ভব নতুন পথের সন্ধান। বাংলা সাহিত্যের ভিত যথেষ্ট শক্ত, কিন্তু তার উপস্থাপন ও প্রসারের কৌশলে বদল দরকার। পরীক্ষামূলক বিষয় এবং লিখনশৈলী প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের ঝুঁকি নেওয়া জরুরি। তরুণ অনুবাদকদের জন্য কাঠামোগত প্রশিক্ষণও প্রয়োজন। তেমনই দরকার বিকল্প প্রকাশকদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক প্রকল্প– যেখানে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের বিপণন সুসংগঠিত হবে। আন্তর্জাতিক পুরস্কার সাহিত্যের গুণগত মানের একমাত্র পরাকাষ্ঠা হতে পারে না, কিন্তু এই পুরস্কার তৈরি করে পাঠক, প্রকাশক ও পেশাদার জগৎ– বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারের জন্য যা অপরিহার্য।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………………