এক সাক্ষাৎকারে ডলিভাই বলেছেন, উনি জানতেন না উনি কাকে চা খাওয়াচ্ছেন। এইটা হচ্ছে কেত। এই কেত নিয়ে আপনার চেনা কোন মানুষটা শুধুমাত্র চা বিক্রি করে এতটা সফল হয়েছে বলতে পারবেন? নিজেকেই প্রোডাক্ট করে তোলার এই অপূর্ব কৌশল ডলি ভাইয়ের মতোই রপ্ত করেছে আরও বহু মানুষ।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
কোভিড পরবর্তী নিও-নর্মালের সময় বিজ্ঞাপনেরও যাবতীয় শুচিবায়ুতা বাঁধ ভেঙে গিয়ে একটা মোদ্দা কথায় নেমে এসেছে যে, ‘গুরু মাল বেচতে হবে, যেভাবে হোক, মালটা আগে বেচে দিতে হবে তারপর অন্য কথা। তোমার বোধে যাকে হাস্যকর মনে হচ্ছে বাজারের বোধে তার দাম বেশ উঁচু হয় তাহলে তুমি ভুল। সবার ওপর বাজার সত্য!’
নাগপুর শহরে ডলি চায়েওয়ালা নামে এক চা-দোনাকি আছেন। অপূর্ব চমকপ্রদ তাঁর সাজপোশাক, অনন্য তাঁর স্কিলসেট। বাইশতলা থেকে নিখুঁত নিশানায় চায়ের পাত্রে দুধ ফেলার টেকনিক, থালাইভা সুচারুতায় গগল পরিয়ে দেওয়ার ঠাঁট, হাত থেকে ম্যাজিকের মতো পয়সা নিয়ে খুচরো ফেরত দেওয়ার সাবলীলতা– সব কিছু মিলিয়ে বহুদিন ধরেই তিনি ‘ভাইরাল’। চা বিক্রি করার পাশাপাশি হলদে-সবুজ সানগ্লাস বিক্রি করাতেও জুড়ি মেলা ভার! তা এই ডলি চাওয়ালার কাছ থেকে সাম্প্রতিককালে কে চা কিনে খেয়েছেন জানেন? বিল গেটস! বিশ্বের ৭ নম্বর ধনী, মাইক্রোসফটের কর্তা– বিল গেটস! সেটার জন্য ডলি ভাইকে শুধু নিজেকে বিজ্ঞাপনযোগ্য করে তুলতে হয়েছে, বিজ্ঞাপন করে দিয়েছেন স্বয়ং বিল গেটস। আসলে ডলি ভাই বাজার বুঝতে পেরেছেন। উনি বুঝতে পেরেছেন মানুষ কী চায়। এই যেমন ভরভরন্ত লকডাউনের সময় একটি বিজ্ঞাপন বেজায় জনপ্রিয় হয়েছিল। দু’টি বাচ্চা মেয়ে, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক পরে, বিভিন্ন আসবাবের ওপর লাফাচ্ছে, খেলছে, চড়ছে এবং একই সুরে বলেই চলেছে, ‘দামে কম মানে ভালো কাকলি ফার্নিচার’।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
চিরকালই আমরা দেখে এসেছি যে, বিজ্ঞাপন মূলত এক ধরনের। যে বিজ্ঞাপন মনে থাকে। বিজ্ঞাপন তৈরির পিছনে মূল পরিশ্রমটাই বোধহয় এটা কারণ একটা বিজ্ঞাপন যখন মনে থাকার মতো দাগ কাটতে পারছে তখন প্রোডাক্ট নিজে থেকেই বিক্রি হয়ে যাবে। সাম্প্রতিককালে যেমন রাহুল দ্রাবিড় একটি বিজ্ঞাপনে ব্যাট হাতে গাড়ির মাথায় উঠে চিৎকার করেছেন। সেই দেখে চারপাশে বিস্ময়, হইচই, শেয়ার, ‘ওহ দারুণ বানিয়েছে!’ ইত্যাদিতে ছয়লাপ হয়ে পড়েছে। যে জিনিসের জন্য এই বিজ্ঞাপন তার নাম রাতারাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সকলের মুখে মুখে ওই একটি বিজ্ঞাপনের দৌলতে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
চিরকালই আমরা দেখে এসেছি যে, বিজ্ঞাপন মূলত এক ধরনের। যে বিজ্ঞাপন মনে থাকে। বিজ্ঞাপন তৈরির পিছনে মূল পরিশ্রমটাই বোধহয় এটা কারণ একটা বিজ্ঞাপন যখন মনে থাকার মতো দাগ কাটতে পারছে তখন প্রোডাক্ট নিজে থেকেই বিক্রি হয়ে যাবে। সাম্প্রতিককালে যেমন রাহুল দ্রাবিড় একটি বিজ্ঞাপনে ব্যাট হাতে গাড়ির মাথায় উঠে চিৎকার করেছেন। সেই দেখে চারপাশে বিস্ময়, হইচই, শেয়ার, ‘ওহ দারুণ বানিয়েছে!’ ইত্যাদিতে ছয়লাপ হয়ে পড়েছে। যে জিনিসের জন্য এই বিজ্ঞাপন তার নাম রাতারাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সকলের মুখে মুখে ওই একটি বিজ্ঞাপনের দৌলতে। রাহুল দ্রাবিড়, যিনি চিরকালই আপামর ভারতবাসীর মননে মিতভাষী ভদ্রলোকের দৃষ্টান্ত রূপে জ্বলজ্বল করছে। সেই একই লোককে ওভাবে দেখাতেই ‘প্রোডাক্ট হিট’। বোঝাই যাচ্ছে, নির্মাতাদের কতটা ভাবতে হয়েছে। কতটা খাটতে হয়েছে। তারপর এইটার সঙ্গেও এটাও ভাবুন, যে সময়টায় অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না, বেড পাওয়া যাচ্ছে না, সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না, একের পর মৃত্যুতে গোটা পৃথিবীর নাজেহাল অবস্থা, সেই সময় একটা দোকান আপনাকে আলমারি বিক্রি চাইল এবং সফলও হল।
ফলে সময়ের দাবিতেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও গিয়েছে বদলে। যেমন বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে খাবারের দোকানগুলোর ক্ষেত্রে ফুড ব্লগিং-এর মতো বিজ্ঞাপনের মাধ্যম আর একটাও রয়েছে কি? এমন একটা মাধ্যম যেখানে পয়সা খরচ করারও প্রয়োজন পড়ছে না। বিজ্ঞাপন নির্মাতারা নিজেদের স্বার্থে নিজে থেকে আসছেন। খাবারের দোকানগুলোর পরিশ্রম বলতে শুধু নিজেদের বাকিদের থেকে আলাদা প্রমাণ করার চেষ্টা। কোনও দোকানের বিজ্ঞাপন চিৎকার করে বলছে: ওই দোকানের বিরিয়ানিতে বৃষ্টির মতো মাখন ঝরে পড়ে। কোনও দোকান আবার বলছে তাদের দোকানের মাটন জীবিত অবস্থায় ‘ভ্যা’ করে ডাকত। আচ্ছা, বিজ্ঞাপনের ভ্লগার মাধ্যম ছাড়া আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল কি যে, পেটাই পরোটা এতটা মার্কেট সফল প্রোডাক্ট? আর মনোরঞ্জন? আহা রে মনোরঞ্জন! ঝগড়াঝাঁটি আছে, কুটকচালি আছে, পাঞ্চলাইনের তো ছড়াছড়ি! নিজেদের মধ্যেই একটা হেলদি কম্পেটিশন যে– এই রে ও বোধহয় আমার থেকেও চাঞ্চল্যকর কিছু একটা বলে ফেলল! তবে জিনিসখানা শুধুই ফুড ভ্লগিংয়ে থেমে নেই। এর পরিধি ছড়িয়ে আছে বহু দূর, এমনকী, পড়াশোনার ক্ষেত্রেও। এক শিক্ষক গান গেয়ে গেয়ে পদার্থবিদ্যা পড়াচ্ছেন। একটা কোচিং এর কি কখনও এর চেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন হতে পারে? সাফল্য তো নিশ্চিত!
উপরিউক্ত ডলি ভাইয়ের কথাই ধরা যাক। এক সাক্ষাৎকারে ডলিভাই বলেছেন, উনি জানতেন না উনি কাকে চা খাওয়াচ্ছেন। এইটা হচ্ছে কেত। এই কেত নিয়ে আপনার চেনা কোন মানুষটা শুধুমাত্র চা বিক্রি করে এতটা সফল হয়েছে বলতে পারবেন? নিজেকেই প্রোডাক্ট করে তোলার এই অপূর্ব কৌশল ডলি ভাইয়ের মতোই রপ্ত করেছে আরও বহু মানুষ। একজন মানুষ দাঁত মাজা থেকে শুরু করে আচানো অবধি সারাদিনে কী কী করেন সেটার বিজ্ঞাপন করে তুলে ধরেছেন সোশাল মিডিয়ায়। ‘লাইফ স্টাইল’ ভ্লগ নামে। এই যে তিনি এটা করলেন, এই যে তিনি ক্যামেরার সামনে বসে একথালা ভাত খেয়ে দেখালেন, রাত্রিবেলা রুটি বেলে দেখালেন, প্রকৃত উপায় কী করে গাজর ছুলতে হয় সেটা দেখালেন, এই যে ওঁর নিজের জীবনটাকেই উনি বিজ্ঞাপন করে তুললেন– সেটা দেখল বহু লোকে। সেই বহু দর্শকের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও কোম্পানি রয়েছে। সেই কোম্পানি এবার ভাবল, বাহ, এ তো বেশ দারুণ উপায়! আর ব্যাস! এইবার সেই মানুষটা একথালা ভাত খেয়ে কোনও একটা গুলি দেখিয়ে বললেন উনি একটা করে খান বলেই ভাত দিব্যি হজম হয়ে যায়। অথবা একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির বেলন দেখিয়ে বললেন– এই জন্যই রুটি গোল হয় ইত্যাদি। ৭০ কেজি থেকে ৬৫ কেজি হওয়ার পুরো যাত্রা পথটা বিজ্ঞাপন করলেন কেউ আর ব্যাস! কয়েকদিনের মধ্যেই প্রোটিন শেক কোম্পানিগুলো পায়ে পড়ে যাবে– কী না, ভিডিওতে যখন উচ্ছের শরবত খাবে আমাদের লোগোছাপ বোতল থেকেই খেও। নিজেকেই হতে হবে একটা ঝাঁ-চকচকে বিজ্ঞাপন। নাচ হোক, গান হোক, রান্নাবান্না হোক– যা খুশি হোক– ‘ব্র্যান্ড’ হতে হবে। তবেই না লোকজনের মাতামাটির কেন্দ্রবিন্দু হওয়া যায়। মোবাইল আছে, মোবাইলে ক্যামেরা আছে, সে ক্যামেরা ধরার লোক আছে আর লোক না থাকলে আছে ট্রাইপড। বিজ্ঞাপন রেডি।
ভাগ্যিস সেই আগেকার অন্ধকার দিনগুলো আর নেই। যখন একটা সাবান বিক্রি করবার জন্য একটা লোককে লিখতে হয়েছিল, ‘দেখতে খারাপ মাখতে ভালো।’ ভাগ্যিস আগেকার অন্ধকার দিনগুলোর মতো এমন অপূর্ব কপি আর না-লিখলেও চলে যায়। ফেভিকলের বিজ্ঞাপনের মতো এমন বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞাপন আর বানালেও চলে যায়। শালিমারের বিজ্ঞাপনের মতো, কোকাকোলার বিজ্ঞাপনের মতো পুজোর আগে স্মৃতি উসকে দেওয়ার মতো চমৎকার বিজ্ঞাপনের গান না-মনে রাখলেও চলে যায়। না-হলে কতটা খাটনি হত বলুন তো? পেতাম এমন দামে কম মানে ভালো জিনিস?
ভালোটাকে একটু ভালো বলতে শিখুন তো। যত্তসব!
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।