বইমেলার উদ্বোধনী-বক্তৃতায় জাঁক দেরিদার ৭৫ মিনিটের বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘বই’। পরের বক্তৃতা ছিল, ‘দর্শন’ এবং তৃতীয় বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আতিথেয়তা।’ সেই বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসদনে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সময়ের কোনও সিডি বা ক্যাসেট আর পাওয়া যায় না।
বইমেলা, যার আসল নাম ‘পুস্তকমেলা’, সত্তরের মধ্যভাগে অর্থাৎ, ১৯৭৬-’৭৭ সালের আবির্ভাব থেকেই বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে স্ট্যাটাস সিম্বল। শুরু হয়েছিল ময়দানের দক্ষিণপ্রান্তে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস— রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পূর্ব দিকে একখণ্ড জমিতে। কয়েক বছর পরে ভিক্টোরিয়ার সামনের ময়দানে এক বছর কাটিয়ে বইমেলা প্রায় দু’দশক সময় ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছে পার্ক স্ট্রিটের বিপরীতে জেনারেল ট্যাঙ্ক বরাবর অনেকটা জায়গা জুড়ে। ১৯৯৭ সালে বইমেলা উদ্বোধন করতে এসে প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদা যার নাম দিয়েছিলেন, ‘বুক সিটি’।
…………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন মিনতি চট্টোপাধ্যায়-এর বইমেলাধুলো-র লেখা: স্টলের ভেতরে মহীনের ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে আর স্টলের বাইরে ময়দানের মাটিতে গোল হয়ে বসে চলছে গান
……………………………………………………………………………………………………………………………………..
সাতের দশকের শেষভাগে রবীন্দ্রসদনের সামনের দিকে যখন বইমেলা হত, তখন এত বিপুল ভিড় তাকে গ্রাস করেনি। তার ছিল গাম্ভীর্য এবং আভিজাত্য। এমন ‘হাটুরে’ এবং ‘হুজুগে’ বাতাবরণ ছিল না সেই বইমেলার। ১৯৭৮ সালে খ্যাতিমান লেখক, মন্ত্রী, ফিল্মস্টাররাও আসতেন, কিন্তু তাঁদের নিয়ে কোনও ‘আদেখলাপনা’ ছিল না। সত্যজিৎ, সৌমিত্র, মৃণাল সেনরা যেমন আসতেন, তেমনই সমরেশ বসু-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রাও ছিলেন। বেঁটেখাটো সমরেশ বসুকে ঘিরে মেয়েদের আগ্রহ ছিল সেই সময় অনেক বেশি।
সেই সময় একদিন দেখা গেল, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র-কে হাত ধরে টানতে টানতে লিটল ম্যাগাজিনের ছাতার দিকে এগিয়ে চলেছেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অশোক মিত্র সামান্য বিব্রত হলেও হাসছিলেন। একটি ছাতার কাছে তরুণ কবিদের স্টলের সামনে এসে থামলেন তাঁরা। অশোক মিত্র বললেন, ‘বীরেনবাবুর কবিতার বইগুলি আমি কিনতে চাই।’ মন্ত্রীর হাত চেপে ধরলেন কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘আরে কন কী? এই জন্যই কি আপনারে আমি টাইন্যা আনলাম? এই যে তরুণ কবি সাগর, বিপুল আপনি এঁদের কবিতা পড়েন। আমার বইয়ের জন্য আপনারে আমি এইখানে আনি নাই।’ অশোক মিত্র বইগুলি কিনলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
হিরণ মিত্রের বইমেলাধুলো: এই বইমেলায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গলায় মিনিবুক ঝুলিয়ে ফেরি করতেন
………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনুষ্টুপের ছোট্ট একশো স্কোয়্যার ফুট স্টলে তখন আমরা নিয়মিত পেতাম হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শোভন সোম, রাম হালদার-এর মতো মানুষকে। তাঁরা কেউ-ই আর নেই। সাধন চট্টোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, ভগীরথ মিশ্র, প্রসাদ রায়-রা এখনও আছেন এবং তাঁরা তখনও এত বিখ্যাত হয়ে ওঠেননি। সেই সময় থেকেই ছোট পত্রিকা ক্রমে ক্রমে প্রকাশনায় আসতে থাকে এবং আজ তারাই সমান্তরাল প্রকাশনা জগৎ নির্মাণ করে বাংলা প্রকাশনাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে নাম থাকলেও ‘কলিকাতা পুস্তকমেলা’ প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠেনি। যদিও দিল্লির প্রকাশকরা নিয়মিত আসতেন বিদেশি বইয়ের সম্ভার নিয়ে। বামফ্রন্ট সরকারও ময়দানে একটি বইমেলা চালু করেছিলেন, কিন্তু তাতে অর্থের অপচয় হত বলে ১৯৯৬ সালে সেই মেলা তাঁরা তুলে দেন। ফলে কলকাতা বইমেলা হয়ে উঠল সর্বেসর্বা। আর ১৯৯৭ সালে কলকাতা বইমেলার প্রথম ফোকাল থিম হল ‘ফ্রান্স’। ফরাসি দূতাবাস থেকে জানতে চাইল, জাঁক দেরিদা অথবা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট– কে উদ্বোধন করলে আমরা রাজি হব। আমরা কখনও কোনও রাজনৈতিক নেতাকে দিয়ে উদ্বোধন করাইনি। সুতরাং আমরা জাঁক দেরিদাকে চাইলাম। কিন্তু তিনি গড়িমসি করতে লাগলেন, এ-কথা বলে যে, বইমেলা তো বাণিজ্যের জন্য, সেখানে তিনি কেন যাবেন? ফরাসি বিদেশ দপ্তরের আমন্ত্রণে আমরা দু’জন প্যারিসে দেখা করে কথা বললাম। তিনটি বক্তৃতা দিলেন জাঁক দেরিদা। উদ্বোধনী বক্তৃতায় তাঁর ৭৫ মিনিটের বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বই’। পরের বক্তৃতা ছিল, ‘দর্শন’ এবং তৃতীয় বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আতিথেয়তা।’ সেই বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসদনে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সময়ের কোনও সিডি বা ক্যাসেট আর পাওয়া যায় না। ভুলে যাওয়ার নয়, অবাঙালি হয়েও মি. শর্মা কীভাবে এই বিষয়ে ফরাসি সরকারের প্রতিনিধি হয়ে আমাদের সাহায্য করেছিলেন।
কিন্তু সেই বছরই ঘটে গেল বিপর্যয়! অগ্নিদগ্ধ হল বইমেলা। জাঁক দেরিদা চলে গেলেন সোমবার সকালে, আর সেই দিন বিকেলে একটি খাবারের দোকানের স্টোভ থেকে যে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা, তা ছড়িয়ে গেল বইমেলার বাকি অংশে। সেটা ছিল ‘ব্ল্যাক মানডে’, কালো দিন। সরকারের অকৃত্রিম ও আন্তরিক সহযোগিতায় সাতদিনের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াল ‘ফিনিক্স’ পাখির মতো সেই বইমেলা।
১৯৯৮-এ, পরের বছর বইমেলার থিম ছিল ইউনাইটেড কিংডম অর্থাৎ ব্রিটেন। উদ্বোধন করেছিলেন রিচার্ড ডকিন্স। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক এবং বিশ্বখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী। বইমেলা আরও বিস্তৃত হয়ে ফিরে এসেছিল স্বমহিমায়।
১৯৯৯ সালে বইমেলার লোকাল থিম ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। উদ্বোধক ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমান। এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে আমরা ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে ময়দানে রাজনৈতিক মঞ্চে দেখেছিলাম। তারপর আমরা পেলাম শেখ হাসিনাকে, যিনি বইমেলা উপলক্ষে এলেন। বাংলাদেশের নিয়ম ছিল, সে-দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী যে অনুষ্ঠানে থাকেন, সেখানে তাঁরাই কেবল হতে পারেন উদ্বোধক। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম, আপনি মাননীয় শামসুর রাহমান-কে সঙ্গে করে নিয়ে আসুন, কেননা কোনও রাজনৈতিক নেতা কখনও বইমেলার উদ্বোধন করেন না। আপনি হবেন সম্মাননীয় প্রধান অতিথি। তিনি সেকথা রেখেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান ছিলেন উদ্বোধক। শেখ হাসিনা ছিলেন প্রধান অতিথি।
স্পেশাল ইভেন্টগুলো খুব উপভোগ করতাম, যেমন, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেকেন্ড চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। সেবারের অনুষ্ঠানে কলকাতার বহু নামী শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন বম্বের অনেক নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী।