Robbar

লেখায় অশ্লীলতা ছিল না, তবুও গ্রেফতার হয়েছিলেন ‘হাংরি’র দেবী রায়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 7, 2023 6:58 pm
  • Updated:October 7, 2023 6:58 pm  

১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ‌্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের রাজত্বকালে হাংরি কবি-লেখকদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। দেবী রায় ছিলেন তাঁদের অন‌্যতম।

সুজিত সরকার

বাংলা সাহিত‌্যে বিশ শতকের ছয়ের দশকটি ছিল আন্দোলনের দশক। এদের মধ‌্যে প্রধান তিনটি আন্দোলন হলে ‘হাংরি’, ‘শ্রুতি’ ও ‘শাস্ত্রবিরোধী’। বাংলা কবিতায় দেবী রায়ের আবির্ভাব এই হাংরি আন্দোলনের সময়ে। মুখ‌্যত মলয় রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে এই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। হাংরি-র বুলেটিনে ঘোষণা করা হয়েছিল: ‘ইচ্ছে ক’রে, সচেতনতায়, সম্পূর্ণরূপে আরণ‌্যকতায় বর্বরতার মধ‌্যে মুক্ত কাব‌্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবীর কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা। সমস্ত প্রকার নিষিদ্ধতার মধ‌্যে তাই পাওয়া যাবে অন্তর্জগতের গুপ্তধন। কেবল, কেবল কবিতা থাকবে আত্মায়।’

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ছিল এরকম: ‘আমি কি কর্বো কোথায় যাবো ও কিছুই ভাল্লাগছে না/ সাহিত‌্য-ফাহিত‌্য লাথি মেরে চলে যাবো শুভা/ শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও।’ পাঁচের দশকের কয়েকজন অগ্রজ কবি ও লেখক, শক্তি চট্টোপাধ‌্যায়-উৎপলকুমার বসু-সন্দীপন চট্টোপাধ‌্যায়-সমীর রায়চৌধুরী এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আন্দোলনটি জোরদার হয়। ‘হাংরি’-র বুলেটিনে সম্পাদক হিসেবে নাম ছিল দেবী রায়ের। তাঁর সে-সময়ের কবিতার কিছু অংশ:

নির্বাসিত উজ্জ্বল দ্বীপে বসে

আমি কাঁদছি আমি হাসছি

হাসপাতালের প্রতিটি বেড-এ শুয়ে বুঝতে পেরেছি

আমার ক‌্যান্সার হয়নি–

নিরাময়হীন রোগাক্রান্ত আমি ১ মানুষ

আমার পরিত্রাণ নেই

 

কিংবা,

 

নখ কাটতে গিয়ে আমার আঙুলে ব্লেড গেঁথে যায়

অনেক দূরে ডিপ হয়ে

আমি অপেক্ষা করি– রক্তের দেখা নেই

দারুণ ভয় আমাকে চিৎ করে ফ‌্যালে, আমি ঢোঁক গিলি

এই ভয়– বিষম অন্তরঙ্গ কোনো মৃত‌্যুরই সমান অবিশ্বাস‌্য

বাস ট্রাম আমার বহু সময় গিলে নেয় কোনো কোনো

বন্ধুর ফ্ল‌্যাটে যেতে

এক পায়ে খাড়া হয়ে কড়া নাড়ি দরজায় বহুক্ষণ এক

নাগাড়ে

হাত ভেরে যায় ‘বাড়ি নেই’ অপরিচিত- বিদেশী স্বরে

বলে ওঠে কেউ কেউ

 

হাওড়ায় থাকতেন দেবী রায়। ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী। প্রবল দারিদ্র্রের মধ‌্যে বড় হয়েছেন। প্রকৃত নাম হারাধন ধাড়া। ছোটবেলা থেকেই ছোটখাটো কাজের মাধ‌্যমে অর্থোপার্জন করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। স্নাতক হওয়ার পরে হিন্দি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশ করেন। পরবর্তীকালে শ্রীকান্ত বর্মার কবিতা হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন।

১৯৬৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ‌্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের রাজত্বকালে হাংরি কবি-লেখকদের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। দেবী রায় ছিলেন তাঁদের অন‌্যতম। তাঁর লেখায় যদিও তেমন কোনও অশ্লীলতা ছিল না। যা হোক, পুলিশের ভয়ে, চাকরি হারানোর  আতঙ্কে, নিরাপত্তাবোধের অভাবে অনেকেই আন্দোলন ত‌্যাগ করেন, আন্দোলন থেমে গেলেও দেবী রায় বাদবাকি জীবন একজন প্রতিবাদী কবি হিসেবেই নিজের পরিচয় রেখে গেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ‌্য কাব‌্যগ্রন্থ ‘কলকাতা ও আমি’, ‘মানুষ, মানুষ’, ‘ভ্রূকুটির বিরুদ্ধে একা’, ‘উন্মাদ শহর’, ‘এই সেই তোমার দেশ’, ‘পুতুল নাচের গান’, ‘সর্বহারা, তবু অহংকার’ ইত‌্যাদি ইত‌্যাদি।

দেবী রায়ের কবিতায় লক্ষ‌্য করা যায় অসম্পূর্ণ বাক‌্য, ভাঙাচোরা শব্দ, টুকরো টুকরো চিত্রকল্পের সমাবেশ, এক ধরনের পারস্পর্যহীনতা। তাঁর বিভিন্ন কবিতার কিছু কিছু অংশ :

মা–

কর্তা গিয়েছেন স্বর্গে… একথা কেন উড়ে আসে?

চোখে কি বালি? দৃষ্টিও ঝাপ্‌সা, সামনের যা কিছু

সব অস্পষ্ট, ধোঁয়া…এর ভিতর নাতনি দৌড়ে এসে

বুকে ঝাঁপায়…

#

 

মা–

চোখের জল গড়িয়ে পড়ে রামায়ণের হলুদ-পাতায়!

কিংবা

পিঁপড়ে নই যে পাবো মর্ম, চিনির–

এ মোহান্ধ-জীবন কেবলি তা না না না…

অথবা,

তফাৎ শুধু এই, লিখি

জীবন

অবসরে চর্বিত চর্বণ

ক্ষেপামন, হায় রে যৌবন, হায়

সে হাত নেড়ে বিষণ্ণ স্বরে

বলে যায়

বিদায়।

কবি-প্রাবন্ধিক উত্তম দাশ বলেছেন, দেবী রায়ের কবিতায় আছে ‘বন্দী আত্মার ক্রন্দন’, আরও বলেছেন ‘অস্তিত্বের অসহায়তায় নিমজ্জিত ব‌্যক্তির মধ‌্যে ডুবে নিজের মানবসত্তার অর্থ খোঁজায় আছে তার কবিতার উদ্দেশ‌্য, কবিতার পরিত্রাণ।’

৩ অক্টোবর, ২০২৩। ৮৩ বছর বয়সে দেবী রায় পরলোক গমন করেছেন।