শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, এর শুধুমাত্র রূপান্তর ঘটে। কিন্তু সৃষ্টির আদিলগ্নে শক্তির উৎসটা তবে কী ছিল? কোথা থেকে পেলাম আমরা এত শক্তি? এই খোঁজই জন্ম দিল একটি গভীর ও জটিল তত্ত্বের। যা হিগস-বোসন কণা কিংবা ‘ঈশ্বর কণা’ নামে পরিচিত। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক আবিষ্কৃত ‘বোসন কণা’র সঙ্গে মিল থাকায় এর এরকম নামকরণ।
পূর্ব শতাব্দীর সাতের দশকে বিশ্ব পদার্থবিদ্যার জগতে বেশ হইচই পড়ে, যখন একদল বিজ্ঞানী দাবি করেন ‘ঈশ্বর কণা’র অস্তিত্বের। প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে প্রথমবারের জন্য পদার্থের মৌলিক কণার ভর সৃষ্টির নেপথ্য বিস্তার সম্পর্কিত একটি দাবি জোরালো হয়। এডিনবরা ছিল যার প্রাণকেন্দ্র। যে শহর জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের জন্মভূমি, যিনি আবিষ্কার করেছিলেন তড়িৎ ও চৌম্বকত্ব– যা আদতে একই বলের ভিন্ন প্রকাশরূপ।
তবে এই দাবিটা ছিল খানিক অন্যরকম। আমরা জানি– শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, এর শুধুমাত্র রূপান্তর ঘটে। কিন্তু সৃষ্টির আদিলগ্নে শক্তির উৎসটা তবে কী ছিল? কোথা থেকে পেলাম আমরা এত শক্তি? এই খোঁজই জন্ম দিল একটি গভীর ও জটিল তত্ত্বের। যা হিগস-বোসন কণা কিংবা ‘ঈশ্বর কণা’ নামে পরিচিত। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক আবিষ্কৃত ‘বোসন কণা’র সঙ্গে মিল থাকায় এর এরকম নামকরণ।
পিটার হিগসের জন্ম ২৯ মে, ১৯২৯; ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেল-আপন-টাইন শহরে। বাবা টমাস হিগস ছিলেন বিবিসি-র সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। পিটারের শৈশব কেটেছে ব্রিস্টল শহরে। অধ্যয়ন চলাকালীন নিউক্লীয় অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে রাজনৈতিক পক্ষের কর্মকাণ্ডেও যোগ দিয়েছিলেন হিগস। সেই আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরিচয় হয়েছিল জোডি উইলিয়ামসনের সঙ্গে। ১৯৬৩-তে যে সম্পর্কের শুভ পরিণয় ঘটে। এরপর টানা চলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রায় একই সময়ে অবশ্য আরও দুই বিজ্ঞানী একইরকম এক কণার কথা বলেছিলেন আলাদা গবেষণাপত্রে। তাঁরা হলেন ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট এবং রবার্ট ব্রাউট।
বিজ্ঞানের দুনিয়ায় যেকোনও গবেষণা যতই প্রবন্ধাকারে লেখা হোক না কেন, হাতেনাতে প্রমাণ দিতে না পারলে তা প্রতিষ্ঠা করা শক্ত, সেজন্য শুরু হল বিস্তর এক কঠিন লড়াই। সময়টা বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক। হিগস-বোসনের খোঁজে কাজ শুরু হল যুক্তরাষ্ট্রে। ৫৪ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গে এই পেল্লায় যন্ত্রটি বসাতে আনুমানিক খরচ ১ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু কিছুদূর কাজ এগোনোর পরেই অর্থবরাদ্দে পিছু হটল সরকার। দেশের সাধারণ মানুষের করের টাকায় বিজ্ঞানের রহস্য উন্মোচনের যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দিহান দেশের কর্তাব্যক্তিরা। সংকটে পড়ল বিজ্ঞানীদের এই মহাযজ্ঞ। যদিও, এই বিপদের সময় এগিয়ে এলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিদ লিওন লেডারম্যান। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের এই গবেষণার গুরুত্ব বোঝাতে কলম ধরলেন তিনি। লিখে ফেললেন আস্ত একটি গ্রন্থ, যার নাম– ‘দ্য গড-ড্যাম পার্টিকেল’ (The God-damn Particle)। যদিও পরে এর নাম পালটে রাখা হয়েছিল– ‘দ্য গড পার্টিকেল’ (The God Particle)।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পিটার হিগসের জন্ম ২৯ মে, ১৯২৯; ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেল-আপন-টাইন শহরে। বাবা টমাস হিগস ছিলেন বিবিসি-র সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। পিটারের শৈশব কেটেছে ব্রিস্টল শহরে। অধ্যয়ন চলাকালীন নিউক্লীয় অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে রাজনৈতিক পক্ষের কর্মকাণ্ডেও যোগ দিয়েছিলেন হিগস। সেই আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরিচয় হয়েছিল জোডি উইলিয়ামসনের সঙ্গে। ১৯৬৩-তে যে সম্পর্কের শুভ পরিণয় ঘটে। এরপর টানা চলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এরপরেই বিষয়টি নিয়ে সাধারণের মধ্যে প্রবল আলোড়ন তৈরি হয়। সত্যিই তো, এটা এমন একটা কণা, যা কিনা গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে ভরের জোগান দেয়! সুতরাং, এর নামের সঙ্গে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি জুড়ে থাকা মানেই তো পাঠকের আগ্রহ অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলা! হয়েছিলও তাই। প্রকাশের ঠিক পরেই বেস্টসেলার হয়ে যায় বইটি। আর হিগস-বোসন সাধারণের মনে জায়গা করে নেয় ‘গড পার্টিকেল’ বা ‘ঈশ্বর কণা’ নামে।
কিন্তু মহাকাব্য যে এখানেই শেষ নয়! মাত্র ২৪ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ খোড়া হলে টাকার ছুতো দেখিয়ে এর কিছুদিন পরে মার্কিন সরকার বাতিল করে দেয় প্রকল্পটি। শেষ হয় প্রথম প্রচেষ্টা। এই কণা শুধুমাত্র একটা ধারণা হয়েই পড়ে থাকে সাধারণের মনে। প্রায় দীর্ঘ ২০ বছর!
এরপর এই কার্যে এগিয়ে এলেন আরও বিজ্ঞানীরা। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে সার্ন*-এর ‘লার্জ ইলেকট্রন পজিট্রন কলাইডার’ (EPC) এবং শিকাগোর ফার্মিল্যাবে ‘টেভাট্রন প্রোটন-অ্যান্টিপ্রোটন কলাইডার’ (PAC)। কিন্তু এই পরীক্ষার জন্য চাই আরও শক্তিশালী কলাইডার। এই সময়েই সার্ন ‘লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার’ (LHC) তৈরির প্রস্তুতির শুরু, তখন ২০০৮ সাল।
পেল্লাই এই যন্ত্রে হ্যাড্রন জাতীয় কণার (যারা কোয়ার্কের সমন্বয়ে তৈরি, যেমন প্রোটন, নিউট্রন, ইত্যাদি) মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হয়। এলএইসি-র প্রধান তিনটি অংশ– কলাইডার, ডিটেক্টর এবং যন্ত্রগণনা বা কম্পিউটিং (Computing)। ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলএইচসি সুড়ঙ্গে মাত্র চারটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে তীব্র গতিশীল প্রোটন-প্রোটন (বা ভারী আয়ন) কণাস্রোত মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়ানো হয়। এরপরে যা হয়, তা অসাধ্যসাধন বই কি! এও যেন একপ্রকার ম্যাজিক!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: রাকেশ শর্মার সাম্যবাদ শুধু পৃথিবীতে আটকে নেই
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তথ্য বিশ্লেষণ করে ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট (GeV) শক্তিসম্পন্ন একধরনের কণার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, যা চরিত্রে অনেকটাই হিগস-বোসনের মতো। বিজ্ঞানীদের মতে, এই কণাটি হিগস-বোসন হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯৯৯ শতাংশ।
কেল্লা ফতে! এরপর, ৪ জুলাই, ২০১২-তে সার্নের অডিটোরিয়ামে যখন এই পরীক্ষার ফল ঘোষণা হল তখন হিগস সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। দু’-চোখে তাঁর অশ্রুভরা। আনন্দশ্রু! সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ভাবতে পারিনি, আমার জীবদ্দশায় এই কণার আবিষ্কার দেখে যেতে পারব। আমি ভাগ্যবান!’
এর ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ট-কে। (বেঁচে থাকলে হয়তো রবার্ট ব্রাউটও পুরস্কারের ভাগীদার হতেন। কিন্তু ২০১১ সালে তিনি মারা যান)
গত ৮ এপ্রিল, ২০২৪– ৯৪ বছর বয়সে এডিনবরায় নিজের বাড়িতেই বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ‘ঈশ্বর কণা’-র ঈশ্বর-বিজ্ঞানী হিগস। তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধা, তাঁর এই দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতি রইল কুর্নিশ!
* CERN বা সার্ন: উচ্চ-শক্তি কণা পদার্থবিদ্যায় সহযোগিতামূলক গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সংস্থা।