শতবর্ষ প্রাচীন জয়পুর ফ্রেস্কো মুছে ফেলা হল! আর্ট কলেজের একটি রেজিস্টার্ড অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে, তাদের কাছে কি কোনও বার্তা গিয়েছে এ ব্যাপারে? মনে হয় না। আমি একজন সাধারণ ওই আর্ট কলেজের পড়ুয়া হিসেবেই এই প্রশ্ন তুলতে পারি, এমন করা হল কেন? আমার শিল্পের আতুঁড়ঘর এই কলেজ। হঠাৎ কেন এই অদ্ভুত অকৃতজ্ঞ বদল? ‘অকৃতজ্ঞ’ বলছি এ কারণে যে, যে শিল্প এতকাল আমাদের বড় করেছে, ভাবনা জুগিয়েছে, মোহিত করেছে, সেই শিল্পকে মুছে ফেলতে তিলমাত্র কষ্ট করতে হল না এই কলকাতায়। এই স্বঘোষিত প্রতিভাবানদের দেশে, সবজান্তা শিল্পবিশেষজ্ঞর দেশে, স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ শিল্পীর দেশে, আমিই ‘শেষকথা’ প্রমাণ করার ঔদ্ধত্যময় দেশে– শিল্পের ইতিহাস ভেঙেচুরে যাবেই।
সরকারি আর্ট কলেজের ইতিহাস সকলেই কম-বেশি জানেন। আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল, পার্সি ব্রাউন, অবনঠাকুর, মুকুল দে, চিন্তামণি কর– এঁরা প্রত্যেকেই এক সময় এ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বদলে ফেলেছিলেন শিল্পের ধারণা। নিরন্তর শিল্প নিরীক্ষায় বিশ্বাস করেছেন। শিল্পকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, সেই ভালোবাসা শুধু বহিরঙ্গের নয়– শিল্পর প্রতি ঝুঁকে তাকে বাঁচানোর মতো মানুষিক ভালোবাসা। প্রাক্তনীদের তালিকা যদি দেখি, তা এতই সুদীর্ঘ এবং বিখ্যাত সব নামে ভরা, বিশ্বাস হয় না যে, এঁদের মূল সূত্র এই প্রতিষ্ঠান। পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এই সুবিশাল পুরনো বাড়িগুলোর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেননি, এমন মানুষ বোধহয় কমই আছেন। আমাদের গর্ব এই কলেজ, কলেজের ঐতিহ্য। কিন্তু তার উত্তরকালের কী হল? সম্প্রতি জানতে পারলাম যে, আর্ট কলেজের বিল্ডিংয়ের প্রবেশদ্বারে ঢুকে যে বিস্তৃত দেওয়াল-জোড়া জয়পুর ফ্রেস্কো ছিল, তা মুছে ফেলা হয়েছে সাদা রং করে! আমি একথা শুনে স্তম্ভিত! এটাও তবে বাকি ছিল? ১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, এই চত্বরে আনা হয়েছিল আর্ট কলেজকে। শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে, এই জয়পুরের ফ্রেস্কো ছিল সকলকে স্বাগত জানাতে। শুধু আর্ট কলেজের না, এ সারা ভারতেরও সম্পদ। যাঁরা শিল্প ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে তা ছিল দর্শনীয়, মুগ্ধকর। আর্ট কলেজের পড়ুয়া, কর্মী, অধ্যাপকদের কাছে তার কদরও ছিল। অথচ কী এক আশ্চর্য উদাসীনতায়, ঔদ্ধত্যে সেই অসামান্য ম্যুরালগুলোয় সাদা রং করে দেওয়া হল! নেপথ্য কারণ কী? কে বলবে?
শিল্পের সঙ্গে সংরক্ষণের একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। ম্যুরালগুলিতে যদি কোনও সমস্যা থাকত তাহলে কেন বিশেষজ্ঞ ডেকে এনে তা সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা নেওয়া হল না? ওয়েস্টার্ন পেন্টিংয়ে ‘রেস্টোরেশন কনজার্ভেশন’ বলে একটা বিষয় তো পাঠ্যক্রমেই রয়েছে। ম্যুরালের ক্লাসও তো হয়, সেই দক্ষ শিক্ষক কি পড়ুয়াদের নিয়ে একসঙ্গে কোনও সুরাহা করতে পারতেন না? অথচ তা হল না।
কলেজ কর্তৃপক্ষ কারও থেকে অনুমতি নেওয়ার দরকার রয়েছে বলে মনে করেনি। আর্ট কলেজের একটি রেজিস্টার্ড অ্যালুমনি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে, তাদের কাছে কি কোনও বার্তা গিয়েছে এ ব্যাপারে? মনে হয় না। আমি একজন সাধারণ ওই আর্ট কলেজের পড়ুয়া হিসেবেই এই প্রশ্ন তুলতে পারি, এমন করা হল কেন? আমার শিল্পের আতুঁড়ঘর এই কলেজ। হঠাৎ কেন এই অদ্ভুত অকৃতজ্ঞ বদল? ‘অকৃতজ্ঞ’ বলছি এ কারণে যে, যে শিল্প এতকাল আমাদের বড় করেছে, ভাবনা জুগিয়েছে, মোহিত করেছে, সেই শিল্পকে মুছে ফেলতে তিলমাত্র কষ্ট করতে হল না এই কলকাতায়।
অতিমারীর পরের সময় থেকেই যদিও আর্ট কলেজের নানা খবর পাই। কলেজ যখন ফাঁকা ছিল, তখন প্রচুর শিল্পসামগ্রী লোপাট হয়েছে। কলেজে প্রচুর অ্যান্টিক কপি ছিল, তা আজকের সময় দাঁড়িয়ে ভ্যানিশ! তরুণ শিল্পীরা এখন অ্যান্টিক কপি করতে গিয়ে, আর কপি পান না। কার প্ররোচনায় এমনটা ঘটছে? কার অনুমতিতে? কে সদুত্তর দেবে?
কলেজের কত বই, পুরনো ছবি– ধীরে ধীরে সেসবও চলে যাবে। নির্ঘাত অনেক লোপাট হয়েছেও। আজ জয়পুর ফ্রেস্কো চলে গেছে বলে এই দুরবস্থা নিয়ে খানিক কথা হচ্ছে বটে, কিন্তু এ বড় অরাজকতার ছোট একটা অংশমাত্র।
শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাটা ক্রমে ছোট, গণ্ডিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই বাংলা একসময় শিল্প-সংস্কৃতিতে যে উচ্চতা নিয়ে বেঁচে ছিল, তা আজ আর নেই। শুধুই একের পর এক শিল্প ধ্বংসের খবর পাই। মন্দিরের গা থেকে খসে পড়ে টেরাকোটা, ভেঙে পড়ে হেরিটেজ বাড়ি, বদলে ফেলা হয় মূর্তির আদল। এরকম চলতে থাকলে ক্রমে আর্ট কলেজের ভেতর বিপুলাকায় বার্থডে পার্টি হবে, ‘হেরিটেজ’ বলে ভাড়া দেওয়া হবে কোনও শিল্পপতিকে আর্ট কলেজে বিয়ের অনুষ্ঠান করার জন্য।
গোটা ভারতে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জগতে তো বটেই, এক চনমনে অরাজকতা তৈরি হয়েছে। যার শিল্পবোধই নেই, সে-ই দেখি প্রদর্শনী কিউরেট করছে! যার শিল্পজ্ঞান নেই, শিল্প দেখা নেই, শিল্প ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা নেই– সে কী দ্রুত খ্যাতি পাচ্ছে শিল্প সমালোচক হিসেবে! এই স্বঘোষিত প্রতিভাবানদের দেশে, সবজান্তা শিল্পবিশেষজ্ঞর দেশে, স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ শিল্পীর দেশে, আমিই ‘শেষকথা’ প্রমাণ করার ঔদ্ধত্যময় দেশে– শিল্পের ইতিহাস ভেঙেচুরে যাবেই।
এ নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। পারলে চিৎকার করুন। পারলে এই প্রবল অন্ধকার সময়ের গায়ে একটু সাদা রঙের পোঁচ দিন।