আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি। অবশ্য বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সেদেশে দিনটি পালিত হয়ে থাকে ভাষা-শহিদ দিবস হিসেবে। গর্বের কথা, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনও দেশে ভাষার জন্য প্রাণদানের নজির নেই। এহেন দিনটির স্মরণে ঢাকার অটোলিপির শ্রদ্ধার্ঘ্য: ‘বাংলা ভাষার জন্য যারা দিয়েছেন প্রাণ ওনাদের আমরা জানাই শহীদের সম্মান’। অটোর স্লোগান নিয়ে বিশেষ সিরিজ ‘অটোবায়োগ্রাফি’। আজ তৃতীয় পর্ব।
৩.
‘বাংলা আমার প্রাণ’– অটোলিপি-র (মেমারি, বর্ধমান, ২০০৮) বক্তব্যের ভরকেন্দ্র ‘বাংলা’ হলে স্বভাবত প্রথমেই যে বেয়াড়া প্রশ্নটা চাগাড় দিয়ে ওঠে; ফের অটোলিপির ভাষাতেই বলি, ‘এতো যে বাংলা বাংলা করো সেটা বাংলা ভাষা নিয়ে তো?’ (মধ্যমগ্রাম, ২০১৩)।
তা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে কৌমের ভাবনাটা কীরকম, সেটা বুঝতে এই লেখার ধরতাই হিসেবে শুরুতেই বলা বাহনলিপিদ্বয় থেকে একটা আন্দাজ করা যায়।
‘বাংলা আমার ভাষা’ (বেলেঘাটা, ১৯৯০) কিংবা, ‘বাংলাতেই বলি’ (যাদবপুর, ১৯৯৭)– এর মধ্যে বাংলা ভাষাটার প্রতি নিখাদ প্রাণের টান রয়েছে। এটাই আরও স্পষ্ট হয় যখন কৃষ্ণনাগরিক অটোপৃষ্টে দেখি, ‘বাংলাতে কথা বলুন’ (২০০৬)। এই অনুষঙ্গে মনে পড়ল আরও কয়েকটির কথা: ‘দাদা, দয়া করে বাংলাতে বলুন’ (১৯৯৪); ‘বাংলা বলবেন প্লিস’ (১৯৯৮); ‘বাংলা, বাংলা, বাংলা– এটাই আমার ভাষা’ (১৯৯৯); ‘বলুন বাংলা বলছি হ্যাংলা’ (২০০১)।
বাংলাকে নিয়ে অটোলিপিকারদের এই যে গর্ব, উচ্ছ্বাস, আবেগ– খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের মধ্যে কারও কারও বয়ানে ফল্গুধারায় বহমান একটা আর্তি, আবেদন, মরিয়া ভাব। আর সেসবই আমার বাংলাভাষাকে ঘিরে। কোথাও যেন এই সামাজিক পরিমণ্ডলেই একটা চাপা উদ্বেগ, আতঙ্ক, হারানোর আশঙ্কার আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল ততদিনে।
লিপিকার যেহেতু এই সমাজেরই বাসিন্দা, এই রাজ্যের জল-আলো-বাতাস দ্বারা পুষ্ট, এখান থেকেই সে নিয়মিত আহরণ করে থাকে তার চিন্তাভাবনার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যকীয় রসদটুকু; তাই তার প্রতিফলন ঘটে অটোবোর্ডে। বৃহত্তর সমাজের ক্লাসরুমে ওটাই যে তার ব্ল্যাকবোর্ড। অটোপৃষ্ঠই সেই মুক্তমঞ্চ যেখানে সে তার বক্তব্যকে তুলে ধরতে পারে সর্বসমক্ষে। অটোলিপি তাই চলমান প্ল্যাকার্ডের মতো, যার দেখা মেলে চলমান হাইড পার্কে। ইচ্ছে থাকলেও তার পক্ষে সম্ভব হয় না রুটিরুজি থেকে, পারিবারিক পিছুটানকে উপেক্ষা করে ভাষার জন্য তথাকথিত সুশীল সমাজের আয়োজিত ধর্নামঞ্চে যোগ দেওয়া। তাই সে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে থাকে তার দলিত বাহনপৃষ্ঠকে। বলতে দ্বিধা নেই, সভা-সমিতি কিংবা ভাষাদিবসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইন্সট্যান্ট আবেগ মিশিয়ে ‘বাংলাটা আমার ঠিক আসে না…’ ইত্যাদি আবৃত্তি করার তুলনায় এ জাতীয় অটোলিপি ভাষার প্রতি সত্যিকারের দায়িত্বটুকু বরং পালন করে থাকে।
বাংলা ভাষা সম্পর্কিত বাহনলিপির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, এগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে অটোতে। বড় চেহারার যাত্রীবাহী বাহনে বাংলা ভাষার অনুপস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাহন মালিকের আর্থ-সামাজিক এক যোগসূত্র যে রয়েছে, তাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় কি? অটোমালিকের তুলনায় একজন বাসমালিকের আর্থিক বল ও নিরাপত্তা অনেকটাই মজবুত। গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকেই সমাজে আর্থিক অবস্থাপন্ন পরিবারের পড়ুয়ারা ইংরেজি মাধ্যমের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। অন্যদিকে অটোমালিক ও চালকদের সিংহভাগই আজও আসেন মূলত সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। সংসারের সবদিক সামলে, ইচ্ছে থাকলেও সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে পারেন না মূলত আর্থিক টানাপোড়েনে। ফলত নিজে এবং সন্তানরা/সন্তান বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়া হওয়ায় বাংলা ভাষার সঙ্গে এঁদের আত্মিক যোগটা না চাইতেও কিছুটা বেশি। খুব সামান্য হলেও অটোলিপি নির্বাচনে তার একটা পরোক্ষ প্রভাব থেকেই যায়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি। অবশ্য বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সেদেশে দিনটি পালিত হয়ে থাকে ভাষা-শহিদ দিবস হিসেবে। গর্বের কথা, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনও দেশে ভাষার জন্য প্রাণদানের নজির নেই। এহেন দিনটির স্মরণে ঢাকার অটোলিপির শ্রদ্ধার্ঘ্য: ‘বাংলা ভাষার জন্য যারা দিয়েছেন প্রাণ ওনাদের আমরা জানাই শহীদের সম্মান’। আরেকটিতে ছিল: ‘বাংলা ভাষা মোদের গর্ব’।
‘১৯ মে অমর রহে’– প্রথম দর্শনে অটোলিপিটিকে কারও কারও ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে মনে হতেই পারে। তাঁদের জ্ঞাতার্থে সংক্ষেপে জানাই, ১৯৬১ সালের ১৯ মে অসমের শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য ১১ জন বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন। তাঁদের স্মরণে আজও বরাক উপত্যকা-সহ বাংলার নানা জায়গায় দিনটি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন বাঙালিরা। অসমের পয়লাপুল নেহরু কলেজের অধ্যক্ষ শ্রীআবিদ রাজা মজুমদার মহাশয়ের সৌজন্যে এটির কথা জানতে পারি (২০০৫)। তিনি তাঁর দেখা আরও দু’টি বাহনলিপির কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। যথাক্রমে ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’ এবং ‘বাংলা ভাষা আমাদের সম্পদ’।
এদেশে রাষ্ট্রীয় মদতে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তারই মাঝে দক্ষিণ ভারতের প্রধান ভাষাগুলি (মূলত কন্নড়, তামিল, তেলুগু, মালয়ালম প্রমুখ) তাদের নিজস্বতা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে অনেকটাই। এটা সম্ভব হয়েছে সংশ্লিষ্ট ভাষাভাষী মানুষদের তার নিজ মাতৃভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ও অস্মিতাসূচক মনোভাবের জন্য। যে ভাষা-অস্মিতা দেখা যায় একজন ফরাসি বা জাপানি নাগরিকের মধ্যে।
কর্মসূত্রে ভিন রাজ্যে বা বিদেশে যাওয়াটা নতুন কিছু নয়। সেক্ষেত্রে যেখানে জীবনযাপন করব, সেখানকার রীতিনীতির সঙ্গে নিজেকে মানানসই করে নেওয়াটাই সভ্যতা। স্থানীয় ভাষা শিখে নেওয়াটাও এর মধ্যেই পড়ে। আর এসবই করা সম্ভব নিজস্বতা বজায় রেখেই। এতে করে একটা নতুন ভাষা ও সংস্কৃতিকে যেমন আপন করে নেওয়া এবং ব্যক্তিগত জ্ঞান সমৃদ্ধ করা সম্ভব, তেমনই সেই অপর ভাষাভাষী এবং সংস্কৃতির মানুষের কাছেও নিজের গ্রহণযোগ্যতা রমণীয় করে তোলা যায় সহজেই। বিষয়টা সংখ্যাগুরুর কাছে সংখ্যালঘুর মাথা নত করা নয়, বরং এভাবেই সুরক্ষিত থাকবে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি। সর্বোপরি, একের জন্য সমষ্টি বদলের তুলনায় নিজেকে গোষ্ঠীর মানানসই করে তোলাটাও বাস্তব রীতিসম্মত।
কিন্তু দীর্ঘদিন এর অন্যথা চলতে থাকলে একটা সময় স্থানীয় মানুষজনের ধৈর্যের বাঁধ অক্ষত থাকা মুশকিল। বিশেষত, যখন দেখা যায় একজন বহিরাগত দীর্ঘদিন বসবাসের পরেও স্থানীয় ভাষায় কাজ চালানোর মতো দক্ষতাটুকুও অর্জন করতে পারেনি। স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা বলছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শেখার মানসিকতাই নেই। তারপর, বারবার একঘেয়ে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে তিতিবিরক্ত হয়ে মেজাজ হারিয়ে কিছুটা কড়া ভাষায় অটোপৃষ্ঠে লিখিয়ে নেন–
‘U are in Karnataka Learn কন্নড় (এটা কন্নড় ভাষায় লেখা ছিল– লেখক) Don’t show your attitude U fu **er U come to beg here…’
কর্নাটকের সোমনাথপুরের অটোভাষাটি আরও তিরিক্ষি মেজাজের: ‘U the Guest Learn কন্নড় (আগেরটার মতো এটাও লেখা ছিল কন্নড় ভাষায়– লেখক) or Go to Hell’ (২০০৪)। এমন রুদ্র রূপের পাশে রয়েছে বিনম্র অটোলিপিও। লৌহ-ইস্পাত-সিমেন্ট শিল্পের শহর ভদ্রাবতীর অটোয় লেখা ছিল: ‘Who wants to learn কন্নড় (পূর্বের মতো– লেখক), We Always Welcome.’ (২০০৮)।
চলুন যাই এবার দ্রাবিড়ীয় ঐতিহ্যের দেশ তামিলনাড়ুতে। চেন্নাইয়ান অটো বলছে: ‘You are in Tamilnad, Try to Speak Tamil’ (২০০০)। হিন্দি আগ্রাসনের মুখে সপাটে চড় কষাতে দেখেছিলাম মামাল্লাপুরম-এ (মহাবলীপুরম নামেও পরিচিত) (২০০৭): ‘No Hindi, Only Tamil or Telegu!’
নিজামের শহর হায়দরাবাদে অটোপৃষ্ঠে তেলুগু ভাষায় যা লেখা ছিল, তার বাংলা মানে এরকম (১৯৯৭): চারমিনার দেখো, বিরিয়ানি খাও, NTR-এর ভাষাটাও শেখো। বেশ একটা রিদম আছে অটোলিপিতে, যা রীতিমতো বিজ্ঞাপনসুলভ প্যাকেজের বার্তাবহ। লিপিতে উক্ত NTR হলেন বিশিষ্ট অভিনেতা এবং তেলুগু দেশমের প্রতিষ্ঠাতা অন্ধ্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন.টি. রামা রাও। বাসস্টপে অপেক্ষারত এন. রেড্ডি নাম্নী এক তরুণের সৌজন্যে এই লিপির অর্থোদ্ধার সম্ভব হয়েছিল সেদিন।
বিশাখাপত্তনম রেল স্টেশনের কাছে পেয়েছিলাম এই চমৎকার অটো-বার্তা (২০১০): ‘You want to know throughly AP/Then First Try to Learn Telegu/It’s True.’। তুলনীয় একটি বাংলা অটোলিপিকে স্মরণ করা যেতেই পারে এই প্রসঙ্গে, যাকে দেখেছিলাম (WB95A3152) ভিআইপি রোডে জোড়ামন্দির ও বাগুইআটির মাঝে: ‘বাংলাকে ভালো করে Zানতি হলে/ বাংলা ভাষাটাও শিখতে হবে ভালো করে।’ সত্যিই, লা-জবাব! সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য সৈয়দ মুজতবা আলী স্পিসিস রিভাইভালিজম (‘z ানতি’) দেখা দিয়েছিল যেন!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অপর ভাষাকে অবদমিত রাখার মানসিকতা থেকেই লিপিকার, ‘Learn Hindi Be Indian’ (দিল্লি, ২০২১) লেখার কথা ভাবতে পারেন! যাতে প্রতিফলিত শাসকদল বিশেষের, ‘এক দেশ এক ভাষা এক ভাবনা’-র মতন ছাঁচে গড়া অনুগৃহীত দেশবাসী তৈরি করা। মানুষের স্বাধীন ভাবনার বৈচিত্র ও বিকাশে এই অবরোধ দেশবাসী মেনে নেবেন না বলেই মনে হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
“God’s Own Country– Land of Malayam”– পর্যটনের সঙ্গে সেই রাজ্যের মুখ্য ভাষা-অস্মিতার চমৎকার মেলবন্ধনের নজির এই অটোবাক্যর দর্শন পেয়েছিলাম তিরুবনন্তপুরমে (২০০৫)। প্রসঙ্গত, কেরলের পরিচিতিই পর্যটন মানচিত্রে ‘গডস নেস্ট ইন গডস ওন কান্ট্রি’ রূপে। আর রাজ্যের প্রধান ভাষা মালয়ালম– সংস্কৃত ও দ্রাবিড় দুয়ের মিশেলে সৃষ্ট। এছাড়া কোল্লাম (পূর্বতন কুইলন)-এ থঙ্গসেরি সৈকতে যাওয়ার পথে দেখেছিলাম (২০১৭) ‘Love Malayalam Love Kerala’। যেন স্নিগ্ধ নয়নসুখময় পথচলতি ঘাসফুল। নিজের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শনের এই যে বিনম্র ও মার্জিত রূপ, এটা সম্ভবত গোটা রাজ্যে শিক্ষার প্রসারের ফল। প্রসঙ্গত, স্বাক্ষরতার হারে ভারতে কেরলের স্থান একেবারে প্রথম সারিতে।
‘ওড়িয়া শিখিকী ছানাপোড়া খাও টেস্ট ভী বঢ়িয়া পাও’ (২০০৯)। অর্থাৎ, ওড়িয়া ভাষা শিখে ছানাপোড়া খেলে তার স্বাদও বাড়ে। এই রসময় অনুপম আপ্তবাক্যে রয়েছে খাওয়ার সঙ্গে খাদ্যবস্তুর রসায়নের সমীকরণ। বলতে চেয়েছে, ভাষাটা রপ্ত হলে একই খাবারের স্বাদও সমানুপাতে বাড়বে। ‘ফিলোজফি অফ টেস্ট’ গ্রন্থের প্রণেতা ফরাসি খাদ্যবেত্তা ব্রিলাঁ সাঁভারা এমন লোকজ জ্ঞানের সন্ধান পেলে নিঃসন্দেহে খুশি হতেন! ওড়িয়া ভাষায় লেখা এই লিপিটি দেখেছিলাম ভুবনেশ্বরী অটোয়।
‘ঘুমেঙ্গে ফিরেঙ্গে নাচেঙ্গে গায়েঙ্গে/ সব কুচ মারাঠি মে করেঙ্গে, আউর ক্যায়া’ – ‘গুলাম’ সিনেমায় আমির খান ও অলকা ইয়াগনিক-এর দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া গানের প্যারডিটা (আংশিক) ছিল পুনের অটোতে। লক্ষণীয়, মরাঠিতে সব কিছু করার কথা বলা হলেও, লেখার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল হিন্দি হরফ (২০০৮)। সেসময় মহারাষ্ট্রের প্রায় ৯০% মানুষ ছিল মরাঠিভাষী। মরাঠিদের ভাষা এবং রাজ্যপ্রেম– দুটোই সুবিদিত। তারপরেও ভাবনার রূপায়ণে এ-হেন সংকরায়ণ! নিছকই হিন্দির বলয়গ্রাস নাকি আরও কিছু? সমাজতাত্ত্বিকরা বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন।
সবশেষে আসি হিন্দির কথায়। ‘সব তক সূরয চাঁদ রহেগা, হিন্দি ভাষা ভারতমে রাজ করেগা’ (কানপুর, ২০০৪); ‘হিন্দি হামারা রাষ্ট্রভাষা’– একেবারেই ভুল কথা (দ্বারভাঙা, ২০০৬); ‘হিন্দি বোলো, হিন্দিমে কাম কোরো আউর হিন্দি শিখাও’ (দিল্লি, ২০১০); ‘হিন্দি পঢ়াও, হিন্দি লিখাও’ (বারেলি, ২০১৫); ‘হিন্দি দেবভাষা হ্যায়’! (কালকা, ২০২২); ‘ক্যায়া বোলতি তু? হিন্দিমে বাতা’ (মোগলসরাই, ২০১৬)– উল্লিখিত প্রতিটি অটোলিপিতে হিন্দির সপক্ষে প্রচারের সুরটি অত্যন্ত চড়া। এক ধরনের দুর্বিনীত মনোভাব এবং উগ্র ভাষাবিদ্বেষ সক্রিয় রয়েছে এই লিপিরচনার নেপথ্যে। এই সমস্ত হিন্দিপন্থীরা এতটাই একগুয়ে এবং ন্যূনতম বিবেচনাবোধহীন যে, প্রয়োজনে সত্যের অপলাপ এবং ‘হিন্দি দেবভাষা হ্যায়’ লেখার মতো নয়া মিথ্যের আশ্রয় নিতেও পিছপা হয় না।
এভাবে মানুষের ওপর হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে পরভাষা সহিষ্ণুতা এবং অন্য ভাষাকে তার প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার যে প্রয়াস, তাতে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে বৈচিত্রের নিকেশ করার মানসিকতাকেই প্রকট করে। অপর ভাষাকে অবদমিত রাখার মানসিকতা থেকেই লিপিকার, ‘Learn Hindi Be Indian’ (দিল্লি, ২০২১) লেখার কথা ভাবতে পারেন! যাতে প্রতিফলিত শাসকদল বিশেষের, ‘এক দেশ এক ভাষা এক ভাবনা’-র মতন ছাঁচে গড়া অনুগৃহীত দেশবাসী তৈরি করা। মানুষের স্বাধীন ভাবনার বৈচিত্র ও বিকাশে এই অবরোধ দেশবাসী মেনে নেবেন না বলেই মনে হয়। কারণ ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ কথাটা ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর সেটাই স্বাস্থ্যকর ও প্রগতির লক্ষণ।
শেষ করব সেই চিরায়ত অটোবাক্য দিয়ে, যাকে প্রায় সিকি শতক আগে (২০০০) দিল্লিতেই জুম্মা মসজিদের সামনে এক মুহূর্তের জন্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল–
‘Your Language My Language
Let All Languages Blossom Fully?’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
…পডুন অটোবায়োগ্রাফির অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২: দিনের শেষে ভূতের দেশে/ সব রঙেরাই যাচ্ছে মিশে
পর্ব ১: * ক্ষয় হলেই সব্বোনাশ!