আল-আহলি হাসপাতালে বিস্ফোরণের দায় ইজরায়েল হামাসের উপরেই চাপাতে সচেষ্ট। হামাসের সহযোগী জঙ্গি সংগঠন ‘প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ’ এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ইজরায়েলের দাবি। এই বিস্ফোরণ গোটা মুসলিম দুনিয়াকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। হামাস হামলার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মুখ খুলেছিল পড়শি মিশরও। ২০২০ সাল থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আরব আমিরশাহি, বাহরিন ও মরক্কোর। সৌদি আরবের সঙ্গে তলে তলে ইজরায়েলের একটি চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। সংঘর্ষ যত এগোচ্ছে, আরব দেশগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক ফের তলানিতে চলে যাচ্ছে। গোটা বিশ্ব ফের আড়াআড়ি বিভাজিত।
গাজার আল-আহলি হাসপাতালের বিস্ফোরণ কি ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষের সম্পূর্ণ আখ্যানটি এবার বদলে দেবে? ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের মাটিতে হামাস জঙ্গিদের আচমকা হানা সংঘর্ষের একটি আখ্যান রচনা করেছিল। প্যালেস্তাইনের সমর্থক মুসলিম দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলির অনেকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছিল। সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদিও ভারতের দীর্ঘকালের প্যালেস্তাইনপন্থী অবস্থানকে দূরে ঠেলে ইজরায়েলের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে ফেলেন। আল-আহলি হাসপাতালের বিস্ফোরণে ৫০০ রোগীর মৃত্যু বিশ্বের সামনে ঠিক একটা বিপরীত আখ্যান তৈরির পরিস্থিতি করে দিয়েছে। ইজরায়েলের সমর্থক পশ্চিমি দুনিয়াও এই হামলার নিন্দা না করে বসে থাকতে পারছে না। মোদিও এই হামলার নিন্দা করেছেন।
এই হামলার প্রেক্ষিতে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর টুইট করা ও মোছা নিয়ে একপ্রস্থ বিতর্ক হয়ে গিয়েছে। ব্রেকিং নিউজ আখ্যা দিয়ে নেতানিয়াহু নিজে টুইটে তথা এক্স হ্যান্ডলে বিশ্বকে আল-আহলি হাসপাতালে বিস্ফোরণের কথা জানিয়েছিলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সেই টুইট মুছে দিয়ে নেতানিয়াহু দাবি করেন, এটা তাঁদের কাজ নয়। আল-আহলি হাসপাতালে বিস্ফোরণের দায় ইজরায়েল হামাসের উপরেই চাপাতে সচেষ্ট। হামাসের সহযোগী জঙ্গি সংগঠন ‘প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ’ এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ইজরায়েলের দাবি। নেতানিয়াহু থেকে শুরু করে ইজরায়েলের যাবতীয় মন্ত্রীরা বলতে শুরু করেছেন, ‘প্যালেস্তিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ’ গোষ্ঠীর ছোড়া রকেটই আল-আহলি হাসপাতালে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। রকেটটা ছোড়া হয়েছিল তেল আভিভকে নিশানা করে। সেটি দিক্ভ্রষ্ট হয়ে গাজার অভ্যন্তরে আল-আহলি হাসপাতালের উপর পড়ে। ইজরায়েল প্রশাসনের বরাবরই দাবি, গাজা থেকে জঙ্গিরা সারাদিনে ইজরায়েলের উদ্দেশে যত রকেট ছোড়ে, তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গাজার ভিতরেই পড়ে।
ইজরায়েলের দাবি মানতে নারাজ হামাস। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই নিয়ে জোর তরজা চলছে। প্যালেস্তাইনের সমর্থকরা বলছেন, হামাসের হাতে এইরকম শক্তিশালী বিস্ফোরক আদৌ নেই, যা একটি আস্ত হাসপাতালকে ওইভাবে অগ্নিকুণ্ড করে দিতে পারে। উল্টোদিকে ইজরায়েলপন্থীদের সাফাই, যে রকেটটি হাসপাতাল চত্বরে আছড়ে পড়েছিল তার অভিঘাত মোটেও প্রচণ্ড ছিল না। হাসপাতাল চত্বরে যেখানে রকেটটি আছড়ে পড়ে, সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত মাত্র তিনটি গাড়ি। আগুন লেগেই হাসপাতালে ক্ষয়ক্ষতি। নিহতের সংখ্যা ৫০০ কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ইজরায়েল দাবি করছে, র্যাডারের ছবি থেকে তারা এটা প্রমাণ করে দেবে যে আল-আহলি হাসপাতালে হামলা ইজরায়েলের দিক থেকে হয়নি। গাজার মধ্যে থেকেই রকেট হানা ঘটেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজির ইজরায়েলি বয়ানের পক্ষে বিস্তর ছবিও।
আসলে যুদ্ধের আখ্যানটি নিজেদের পক্ষে আনতে দায় এড়াতে মরিয়া ইজরায়েল।
আল-আহলি হাসপাতালের বিস্ফোরণ-বিতর্কের মধ্যেই ইজরায়েলে হাজির হয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইজরায়েলের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে বাইডেন বলেছিলেন, ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, তা যাচাই করতে তিনি তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে নির্দেশ দিয়েছেন। ইজরায়েলে এসে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেন তাঁর বয়ান বদলেছেন। নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে কোনওভাবে ইজরায়েল জড়িত নয়। আমেরিকার প্রাথমিক বয়ান এবং পরবর্তীকালে বয়ান বদল, আরও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বে ইজরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমেরিকা। কূটনৈতিক মহলে ইজরায়েলকে ‘আমেরিকার সন্তান’ বলা হয়ে থাকে। আল-আহলি হাসপাতালে বিস্ফোরণের ঘটনায় আমেরিকা গোড়ায় কোনও পক্ষ না নেওয়াতে বিশ্ব ধরেই নেয় যে এটি ইজরায়েলের কাজ। পরে বাইডেন সুর বদলালেও স্পষ্টভাবে হামাসের দিকে আঙুল তোলেননি। ফলে ইজরায়েলের পক্ষে তাদের দাবিটি বিশ্বের দরবারে বিশ্বাসযোগ্যভাবে দাঁড় করানো খুব কঠিন হয়ে উঠছে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, হাসাপাতালে বোমা ফেলা ঘোরতর যুদ্ধ অপরাধ। তাই বিতর্কটা সহজে ধামা চাপা পড়ারও নয়।
আল-আহলি হাসপাতালের বিস্ফোরণ গোটা মুসলিম দুনিয়াকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। হামাস হামলার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে মুখ খুলেছিল পড়শি মিশরও। ২০২০ সাল থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আরব আমিরশাহি, বাহরিন ও মরক্কোর। সৌদি আরবের সঙ্গে তলে তলে ইজরায়েলের একটি চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। সংঘর্ষ যত এগোচ্ছে, আরব দেশগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক ফের তলানিতে চলে যাচ্ছে। গোটা বিশ্ব ফের আড়াআড়ি বিভাজিত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে বছর দেড়েক আগে বিশ্বের একটা মেরুকরণ ঘটেছে। ইউক্রেনের পাশে আমেরিকা-সহ নেটো-ভুক্ত দেশগুলি। অন্যদিকে, রাশিয়ার পাশে চিন। নিরপেক্ষ ভারত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি। ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষে চিন-রাশিয়া বরাবরের মতো ঝুঁকে প্যালেস্তাইনের দিকে। হামাসের সমর্থক ইরান ও সিরিয়া রাশিয়ার পুরনো বন্ধু। ইজরায়েল সংঘর্ষকে সামনে রেখে রাশিয়া ও চিনের চেষ্টা এখন আমেরিকাকে কোণঠাসা করার। সংঘর্ষ যতদিন গড়াবে, ততদিন এর আখ্যান বদলাতে থাকবে। গাজাকে ঘিরে ধরে হত্যালীলা পশ্চিমী দেশগুলির জোটেও ফাটল ধরাবে। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের শক্তির ভারসাম্যও বদলাতে থাকবে।
হামাস হামলার পর নেতানিয়াহু হুমকি দিয়েছিলেন, পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র বদলে দেবেন। এখনও নেতানিয়াহু বলে চলেছেন হামাসকে নির্মূল করে দেবেন। কিন্তু, কাজটা যে মোটেও সহজ নয় তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।