সদ্য শেষ হওয়া সংসদের বাদল অধিবেশনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিলটি আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল, কিন্তু বিলের খসড়া সরকার করে উঠতে পারেনি বলেই খবর। বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশের মতে অভিন্ন মানেই সাম্য নয়। সাম্য প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে দেশের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে বিপন্ন করা উচিত নয়। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারা খারিজ করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ এবং অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির নির্মাণের পর দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা হল সংঘ পরিবারের একমাত্র অ্যাজেন্ডা, যেটি এখনও নরেন্দ্র মোদির সরকার পূরণ করতে পারেনি। সদ্য শেষ হওয়া সংসদের বাদল অধিবেশনেই এই সংক্রান্ত বিলটি আসবে বলে মনে করা হচ্ছিল, কিন্তু বিলের খসড়া সরকার করে উঠতে পারেনি বলেই খবর। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে সংঘ পরিবারের তৃতীয় অ্যাজেন্ডাটি পূরণ করার বিষয়ে মোদি সরকার এখনও অনড়– অভিমত ওয়াকিবহাল মহলের।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার ক্ষেত্রে সংঘ পরিবারের উদ্দেশ্যটা কী, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষের দীর্ঘকালের চিরাচরিত প্রথাগুলি বিসর্জন দিলেই কি জাতীয় সংহতি মজবুত হবে এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূর হবে? যদি নারীদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে কেন বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিগত আইনগুলি সংস্কার ও সময়োপযোগী করার কাজে মোদি সরকার মনোনিবেশ করছে না? অভিন্ন দেওয়ানি বিধির লক্ষ্য, দেশজুড়ে বিয়ে, বিবাহ-বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার, দত্তক, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে একটাই আইন চালু করা। উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রচনা করার উদ্দেশে ২০২২ সালের জুন মাস থেকে আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রাক্তন বিচারপতিদের একটি প্যানেলও তারা তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি হয়েছে। উত্তরাখণ্ড সরকারের কাছে আড়াই লক্ষ প্রস্তাবও জমা পড়েছে। উত্তরাখণ্ড সরকার অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আইনটি কীভাবে করে এবং জনগণের মধ্যে তার কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা বিচার করেই নাকি মোদি সরকার এগোতে চাইছে।
আরও পড়ুন: পকসো প্রয়োগে কড়া শাস্তি, তবু মুক্তি কি মিলবে র্যাগিং-এর রাহুগ্রাস থেকে?
বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশের মতে, অভিন্ন মানেই সাম্য নয়। সাম্য প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে দেশের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে বিপন্ন করা উচিত নয়। নারীর অধিকার নিয়ে যে সমস্ত ব্যক্তি ও সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের মতামত গ্রহণ এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু, সেইপথে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলি চলছে না।
দেশের একাধিক রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন বিয়ের আইন চালু রয়েছে। এমন কিছু আইন রয়েছে, যাতে এক রাজ্যে বিয়েতে যেটা বৈধ, অন্য রাজ্যে সেটাই অবৈধ। এই সমস্ত ক্ষেত্রে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এক বড়সড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। সংবিধানের চতুর্থ পর্বে নির্দেশাত্মক নীতির মধ্যে ৪৪ নম্বর ধারায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে যাওয়ার কথা বলা রয়েছে। কিন্তু, নির্দেশাত্মক নীতি দেশের আইন নয়। সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মধ্যে ২৫ নম্বর ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা রয়েছে ও ২৯ নম্বর ধারায় নাগরিকদের নিজের সাংস্কৃতিক পরম্পরাকে রক্ষার অধিকার দেওয়া আছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর চেষ্টা হলে সংবিধানে বর্ণিত এই দুই মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে পারে। বস্তুত, সংবিধান পরিষদের বৈঠকে মুসলিম সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিরাও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতা করেছিল। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সমর্থনে ছিলেন জওহরলাল নেহরু ও বি. আর. আম্বেদকর।
বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি জরুরি বলে যে আখ্যান দেওয়া হয়, তারও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি কিছু নেই। বহু বিবাহ নিষিদ্ধ হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে, এমন দাবির নেপথ্যে কোনও তথ্য মেলে না। ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতের মানুষ তাদের চিরাচরিত প্রথাগুলি মেনে চলে আসছে। স্বাধীনতার পরেও সেই ধারাবাহিকতাই রক্ষা করা হচ্ছে। ২১তম আইন কমিশন, যার কার্যকাল ২০১৮ সালে শেষ হয়েছে, তারা এ বিষয়ে অসংখ্য মতামত গ্রহণ করার পর সুপারিশ করেছিল যে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পথে না গিয়ে বিভিন্ন ধর্মের ‘পার্সোনাল ল’গুলির সংস্কার করাই হবে সঠিক কাজ। ২২তম আইন কমিশন এ বিষয়ে মানুষের মতামত গ্রহণ করছে। এখন এটাই দেখার অপেক্ষা যে, সরকার কীভাবে অভিন্ন দেওয়ান বিধির খসড়া তৈরি করে। যদি উত্তরাখণ্ড সরকার সবার আগে এটি করে, তা হলে দেখতে হবে তারা কাজটি কীভাবে করছে। গোটা দেশের জন্য একটা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরি সত্যিই খুব কঠিন কাজ। রাজনৈতিক স্তরেও এ নিয়ে কোনও ঐকমত্য নেই। কংগ্রেস-সহ সব বিজেপি বিরোধী দলই এ ব্যাপারে পরীক্ষানিরীক্ষা করার বিরুদ্ধে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved