সিরিয়াতে পুতিন গিয়ে আইএস জঙ্গিদের ঠান্ডা করে দিয়েছেন। রুশ সেনা সিরিয়ায় শুধু আইএস ঘাঁটি ধ্বংস করেনি, প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের বিরোধী সুন্নি বিদ্রোহীদেরও নিকেশ করেছে। ইরাক-সিরিয়াতে ধাক্কা খেয়ে আইএস মাথা তোলার চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে। তাই পুতিনের সঙ্গে তালিবান প্রশাসনের যোগাযোগ গড়ে ওঠায় উদ্বিগ্ন আইএসের আফগান শাখা আইএসকে। সেই উদ্বেগ থেকেই কি হামলা?
মস্কোর উত্তর পশ্চিমে শহরতলি ক্রাসনোগরস্কের ক্রকাস সিটি হলকে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার জন্য কেউ মনে রাখেনি। আসলে এক দশক পর এই হলকে যে বিশ্বের অন্যতম জঘন্য সন্ত্রাসের সাক্ষী হতে হবে, তখন আর কে ভেবেছিল! সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর রাশিয়া কম সন্ত্রাস দেখেনি! ভয়ংকর চেচেন জঙ্গিরা যে কতবার ভলগা-দানিয়ুবের জলকে রক্তে রাঙিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। ২০০২-তে মস্কোর দুব্রভকা থিয়েটারে ১৩০ জনের হত্যার ঘটনা কিংবা ২০০৪-এ বেলসানে শতাধিক স্কুলপড়ুয়া সহ ৩৩৪ জনকে নির্বিচারে খুন– এখনও অনেকের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। ক্রকাস সিটি হলে মৃত্যুর সংখ্যা ১৩৩ ছাড়িয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে এই জঙ্গি হামলার ঘটনাকে মাপলে চলবে না। আজকের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ভয়াবহ ঘটনার বিচার করতে হবে। সেইদিক থেকে দেখলে বোঝাই যাচ্ছে, মস্কোর উপকণ্ঠের এই সন্ত্রাস অতীতের ঘটনাগুলির চেয়ে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে। ক্রকাস সিটি হল আক্ষরিক অর্থেই এবার ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিল। আর কেউ ক্রকাস সিটি হলের নাম ভুলবে না।
হামলার ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে ইউক্রেনের দিকে আঙুল তুলবেন, তা জানাই ছিল। সে কারণে প্রতিক্রিয়া দিতে বিলম্ব করেনি আমেরিকা। হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন বিদেশ দপ্তর জানিয়ে দিয়েছে, ঘটনার সঙ্গে ইউক্রেনের যোগ নেই। আইএস জঙ্গিরা দায় স্বীকার করতে কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়েছে। আইএসের সংবাদ সংস্থা জানায় যে, এটা ‘আইএস খোরাসান’ তথা ‘আইএসকে’ গোষ্ঠীর কাজ। ‘আইএসকে’ হল আইএসের আফগানিস্তান শাখা। পূর্ব আফগানিস্তানের খোরাসান প্রদেশ থেকে তারা ‘খোরাসান’ নামটি নিয়েছে। আইএসের এই আফগান শাখাটি হল সবচেয়ে গোঁড়া ও নৃশংস। এদেরকে এখন তালিবানরাও ভয় পায়। আইএসকে দায় নেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে আমেরিকা তা নিশ্চিত করে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিম করবি জানিয়ে দেন, ৭ মার্চেই এই হামলা নিয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল মস্কোকে। অর্থাৎ, অনেক পরিকল্পনা ও চক্রান্তর ফসল এই হামলা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
খেয়াল রাখতে হবে, কয়েকদিন আগেই ফের ছ’বছরের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন পুতিন। প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে তাঁর পক্ষে। কেনই বা পড়বে না! প্রাক্তন এই কেজিবি কর্তা তো তাঁর বিরোধীদের কোনও অস্তিত্বই রাখেননি দেশে। আলেক্সেই নিভালনির পরিণতি সম্প্রতি দেখল গোটা বিশ্ব। আর্কটিকের জেলে রহস্যজনক মৃত্যু হল পুতিন-বিরোধী এই নেতার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ক্রকাস সিটি হলে এতগুলো নিরীহ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী রুশির প্রাণ কেড়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে আইএসকে বলেছে, পুতিনের হাতে মুসলিমদের রক্ত লেগে রয়েছে। তাই তারা একটা বদলা নিয়েছে। তারা উল্লেখ করছে, চেচনিয়া, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় রাশিয়ার ভূমিকার কথা।
চেচনিয়ার বিদ্রোহের ইতিহাস অবশ্য দুশো বছরের। রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য চেচনিয়ার মুসলিম অধিবাসীরা নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৯-এর শেষে পুতিন মস্কোর মসনদে বসার পর চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতেও তাঁর তাঁবেদার সরকার বসাতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান চেচনিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ নিজেকে পুতিনের ‘ফুট সোলজার’ বলে থাকেন। বস্তুত রমজানের ভরসায় পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধ লড়ছেন। রাশিয়ার হয়ে হাজার হাজার চেচেন যোদ্ধা ইউক্রেনে প্রাণ দিচ্ছে।
সিরিয়াতেও পুতিন গিয়ে আইএস জঙ্গিদের ঠান্ডা করে দিয়েছেন। রুশ সেনা সিরিয়ায় শুধু আইএস ঘাঁটি ধ্বংস করেনি, প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের বিরোধী সুন্নি বিদ্রোহীদেরও নিকেশ করেছে। ইরাক-সিরিয়াতে ধাক্কা খেয়ে আইএস মাথা তোলার চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে। তাই পুতিনের সঙ্গে তালিবান প্রশাসনের যোগাযোগ গড়ে ওঠায় উদ্বিগ্ন আইএসের আফগান শাখা আইএসকে। সেই উদ্বেগ থেকেই কি হামলা?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: জেলেই শিশুর জন্ম দিচ্ছেন অসংখ্য সাজাপ্রাপ্ত মহিলা, প্রতিবাদ মিছিলের জন্য মোমবাতি ফুরিয়ে গিয়েছে?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
খেয়াল রাখতে হবে, কয়েকদিন আগেই ফের ছ’বছরের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন পুতিন। প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট পড়েছে তাঁর পক্ষে। কেনই বা পড়বে না! প্রাক্তন এই কেজিবি কর্তা তো তাঁর বিরোধীদের কোনও অস্তিত্বই রাখেননি দেশে। আলেক্সেই নিভালনির পরিণতি সম্প্রতি দেখল গোটা বিশ্ব। আর্কটিকের জেলে রহস্যজনক মৃত্যু হল পুতিন-বিরোধী এই নেতার। নিভালনির ৯০ বছরের জেলের ব্যবস্থা করেছিলেন পুতিন। ভোটের পর পুতিনকে একটা জোরালো বার্তা দিতেই যে আইএসকে জঙ্গিরা এই সময়টিকে বেছে নিয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। তবে সবার আগে ঘুম উড়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কির। কারণ, প্রথম সুযোগে পুতিন ইউক্রেনে হানা তীব্র করবেন। রাশিয়া জুড়ে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগের ঝড় তুলবেন। পুতিনের রাজনীতির পুঁজি উগ্র জাতীয়তাবাদ। দু’বছরের যুদ্ধে এখন কিছুটা এগিয়ে রাশিয়া। ফলে এবার একটা এসপার-ওসপার করার সুযোগ পুতিনের সামনে।
কিন্তু আইএস মোকাবিলায় পুতিনের পদক্ষেপ কী হবে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন বিশ্বের সামনে। ৯/১১-এর পর আমেরিকা যখন আলকায়দাকে মারতে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে ঢুকল, তখন জন্ম আইএসের। সিরিয়াতে রুশ বাহিনী ঢোকার পর আইএস জমি হারায়। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী সরার পর যে ‘আইএস’ ফের ‘আইএসকে’ পরিচিতি নিয়ে শক্তিবৃদ্ধি করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্রকাস সিটি হলে হামলার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় উজ্জীবিত এই ইসলামি জঙ্গি সংগঠন। এবার হামলা কি শুধু রাশিয়ার গণ্ডিতে আটকে থাকবে? পুতিনের পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে যে চারজনকে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করেছে, তারা সকলে তাজাকিস্তানের নাগরিক। আইএস খোরাসানের যে বিস্তার ঘটছে আফগান সীমান্তের বাইরে, তাও বোঝা গেল এই ঘটনায়। ৯/১১ মধ্য এশিয়ার ভূগোল ও রাজনীতির পরিবর্তন করেছিল। ক্রকাস সিটি হলে হামলার অভিঘাত এখন আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে।