হায়দ্রাবাদে এক ডেলিভারি পার্সন ক’দিন আগেই এক ধর্ম সংকটে পড়েছিলেন। আর তাঁকে সেই সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে একটি ঘোড়া। হয়েছে কী, হায়দ্রাবাদে পেট্রলের আকাল। টানা তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও পেট্রল মেলেনি বাইকের জন্য। কিন্তু কাস্টমার তো আর অনন্তকাল অপেক্ষা করবে না। তাই তিনি ঠিক করলেন পথ হোক বন্ধুর, ডেলিভারি করবই চিকেন তন্দুর। এই বলে তিনি যে কাণ্ডটি বাঁধালেন তাতে শোরগোল পড়ে গেছে! তিনি একটা ঘোড়া জোগাড় করে টগবগিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে খাবার পৌঁছালেন। ঘোড়া কোথা থেকে পেল, এ প্রশ্ন করবেন না। শাস্ত্রে একে বলে ‘ দিউস এক্স মাকিনা’। মানে অসম্ভবকে সম্ভব করতে দৈব ইনটারভিনশন।
“ব্রহ্মা থাকেন সুদূর স্বর্গে; তিনি ঘোড়াটার চাল দেখতে পান, তার হাঁটুর বাঁধন দেখতে পান না। তিনি নিজের কীর্তির এই ভাঁড়ের মতো চালচলন দেখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। বল্লেন, ‘ভুল করেছি তো।’
মানুষ হাত জোড় করে বললে, ‘এখন এটাকে নিয়ে করি কী। আপনার ব্রহ্মলোকে যদি মাঠ থাকে তো বরঞ্চ সেইখানে রওনা করে দিই।’
ব্রহ্মা ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘যাও যাও, ফিরে নিয়ে যাও তোমার আস্তাবলে।’
মানুষ বললে, ‘আদিদেব, মানুষের পক্ষে এ যে এক বিষম বোঝা!’
ব্রহ্মা বললেন, ‘সেই তো মানুষের মনুষ্যত্ব।’’’
ঘোড়া।(লিপিকা)। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘অ্যানিমাল’-এর মধ্যে সুপারহিট হল ঘোড়া। সভ্যতায় চাকা, আগুনের আবিষ্কারের মতোই ঘোড়ায় লাগাম পরানো গুরুত্বপূর্ণ। সেই অশ্বমেধের সময় থেকে ঘোড়া, সভ্যতার জয় পতাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছে। সেকালে রাজারা ঘোড়া ছাড়ত, নিজের এলাকা দখলের লক্ষ্যে। হয় বশ্যতা ও সন্ধি, নয়তো ঘচাং ফু! বিস্তর ঘুরেটুরে রাজ্যে ফিরলে তার কপালে জুটত বলিদানের শাহদাত। দেশের দশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা আর কী! বলিপ্রদত্ত অশ্বের মাংস কিছু কিছু সময় খাওয়ার চল ছিল। আর ছিল মৃত ঘোড়ার সঙ্গে রাজ-রানিদের প্রতীকী সহবাস। অবশ্যই রাজ্য ও জনগণের কল্যাণের জন্য। ভালো কথা, ঘোড়াকে ‘অশ্ব’ বলা হয় এই জন্য যে, মধ্য এশিয়া থেকে আগত এই জন্তুটা স্থানীয় মানুষ চিনত না। তাই এটা ‘শ্ব’, অর্থাৎ সারমেয় গোত্রের প্রাণী নয়, এই বোঝাতে ‘অশ্ব’।
সভ্যতার ইতিহাস মোটের ওপর আগ্রাসনের ইতিহাস। ‘রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে’ দুর্গম গিরি মরু কান্তার পার হয়ে বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসে, ঘোড়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাল্লা রাজার মন্ত্রী, গুপ্তচরের কাছে কী কী খোঁজ নিচ্ছিল, মনে করে দেখুন। অস্ত্র বারুদের পাশাপাশি হাতি-ঘোড়া-উটের খবর। তাই ‘বিস্ট অফ বার্ডেন’ হোক বা যুদ্ধের সম্পদ হোক, ঘোড়া কিন্তু সভ্যতার রথকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তাই লোকবিশ্বাসে সাদা ঘোড়া দেখা সৌভাগ্যের বিষয়, ঘোড়ার নাল সৌভাগ্য নিয়ে আসে।
শিল্প-সাহিত্যে-ছবিতে ঘোড়ার ছড়াছড়ি। কবিতায় রবার্ট ব্রাউনিং তো ঘোড়সওয়ার আর অশ্বক্ষুরের ছন্দকে অমর করে রেখেছেন। বিশ্ব সাহিত্য খুঁজলে তা অজস্র পাওয়া যাবে। বাংলায় ‘বীরপুরুষ’-এর ‘টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে’, জীবনানন্দের মহীনের ঘোড়া থেকে মল্লিকা সেনগুপ্তের স্বীয় ঘোটকীর গন্ধ। চিত্রকলায় স্টাব, তুলো লত্রেক, পিকাসো থেকে হুসেন, সুনীল দাস।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতেন, চাঁদের আলোয় গান গাইতেন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ইতিহাস বিখ্যাত কিছু ঘোড়া হল বুসেফেলাস, কোপেনহাগেন, চেতক, পালমো। এছাড়া বিশ্ব বিখ্যাত রেস হর্স আছে। সে নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে গরিবের ঘোড়া রোগের সম্ভাবনা। তবে এ-প্রসঙ্গে ‘গডফাদার’ ছবির, খারতুম ঘোড়ার কথা মনে করা যেতে পারে। জন ফন্তেন, গায়ক নায়ক এবং গডফাদারের স্নেহধন্য। তার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। গডফাদারের পালিতপুত্র টম হাগেন গেল, তার হয়ে সুপারিশ করতে হলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক জ্যাক ওলতজ-কে। সে তাদের পাত্তা না দিয়ে, নিজের প্রিয় ঘোড়া খারতুমকে দেখায়। অমূল্য সম্পদ খারতুম। পরের দিন ভোরবেলা খারতুমের কাঁটা মুণ্ড বিছানায় নিয়ে ঘুম ভাঙে জ্যাক ওলতজ-এর। জন ফন্তেন-কে আর ভাবতে হল না ক্যারিয়ার নিয়ে।
বিজ্ঞান কিন্তু সভ্যতায় ঘোড়ার অবদানকে ভোলেনি। যান্ত্রিক শক্তির নাম রেখেছে ‘হর্স পাওয়ার’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
শিল্প-সাহিত্যে-ছবিতে ঘোড়ার ছড়াছড়ি। কবিতায় রবার্ট ব্রাউনিং তো ঘোড়সওয়ার আর অশ্বক্ষুরের ছন্দকে অমর করে রেখেছেন। বিশ্ব সাহিত্য খুঁজলে তা অজস্র পাওয়া যাবে। বাংলায় ‘বীরপুরুষ’-এর ‘টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে’, জীবনানন্দের মহীনের ঘোড়া থেকে মল্লিকা সেনগুপ্তের স্বীয় ঘোটকীর গন্ধ। চিত্রকলায় স্টাব, তুলো লত্রেক, পিকাসো থেকে হুসেন, সুনীল দাস। ইতিহাস বিখ্যাত কিছু ঘোড়া হল বুসেফেলাস, কোপেনহাগেন, চেতক, পালমো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এহেন পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ঘোড়া খবরের শিরোনাম হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য কারণে। সে প্রসঙ্গে আসছি।
আবহমানকাল বলা হল, সবুরে মেওয়া ফলে। ধৈর্যের, ধী শক্তির গুণ গাওয়া হল। হঠাৎ গ্লোবালাইজেশনের পাল্লায় পড়ে গ্লোব সিনেমা উঠে গেল, আর আমাদের অ্যাটেনশন স্প্যান কমে গেল। সব এক্ষুণি চাই! ঝট সে মাঙ্গনি, কিপ দ্য ভাঙনি, মানে খুচরো টিপস। যে কাজ ছিল আয়াসসাধ্য, ইটিং আউট যেমন; সাজগোজ রে, পমেটম রে, ট্যাক্সি ডাকোরে, এখন বারমুডা পরে টাচ ফোনে কেল্লা ফতে! কোর্মা কালিয়া পোলাও– জলদি লাও জলদি লাও। কিন্তু মুশকিল হল, ওই অ্যাটেনশন স্প্যান। আর সর্বদা একটা কিছু করে ফেলার বা বদলে ফেলার তাগিদ। চুলের ছাঁট, জামার কাট। ফুড ডেলিভারির অ্যাপ্স বা পিৎজা কম্পানি সেটা বিলক্ষণ বোঝে। তাই লাগাতার জানান দেয়, যদি আধ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি না পান তাহলে ট্রিটটা আমাদের পক্ষ থেকে। যদি অমুক সময়ের মধ্যে খাবার না পৌঁছে যায়, একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক ফ্রি পাবেন। এখন মুশকিল হল, কবি বলেছেন, নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি। তাহলে এই নিরন্তর দৈব পিকনিকে যুদ্ধের ঘোড়া কে? বেচারা ডেলিভারি পারসন। এমনিতেই তিনি হিন্দু না মুসলিম জিজ্ঞাসে লোকজন, এবং হুজ্জত পাকায়। তার ওপর দেরি হলে কোপটা পড়বে তাঁর নিরীহ ঘাড়ে। কারণ, তিনি লো ইন দা ফুড চেইন। তাই ওই রকম দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বাইকের হর্নে কানে তালা লাগিয়ে তাঁদের জীবন-যুদ্ধ। বলা যায় না, বারোটা পাঁচে যে মোরগ পোলাও অর্ডার দিল, সে বারোটা সাতাশে, ‘যা আজ থেকে ভিগান হয়ে গেলাম’, বলবে না, কী গ্যারান্টি?
হায়দ্রাবাদে এক ডেলিভারি পার্সন ক’দিন আগেই এক ধর্ম সংকটে পড়েছিলেন। আর তাঁকে সেই সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে একটি ঘোড়া। হয়েছে কী, হায়দ্রাবাদে পেট্রলের আকাল। টানা তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও পেট্রল মেলেনি বাইকের জন্য। কিন্তু কাস্টমার তো আর অনন্তকাল অপেক্ষা করবে না। তাই তিনি ঠিক করলেন পথ হোক বন্ধুর, ডেলিভারি করবই চিকেন তন্দুর। এই বলে তিনি যে কাণ্ডটি বাঁধালেন, তাতে শোরগোল পড়ে গেছে! তিনি একটা ঘোড়া জোগাড় করে, টগবগিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে খাবার পৌঁছলেন। ঘোড়া কোথা থেকে পেল, এ প্রশ্ন করবেন না। শাস্ত্রে একে বলে ‘ দিউস এক্স মাকিনা’। মানে অসম্ভবকে সম্ভব করতে দৈব ইনটারভিনশন।
আগামী দিনে, ড্রোন (Drone) দিয়ে ডেলিভারি হবে আরও নিখুঁত ও কম সময়ে পরিষেবা দিতে। আমাদের লড়াকু, নিত্যনতুন হ্যাক বের করা উদ্ভাবনী শক্তির এই দেশে পক্ষীরাজ নেমে এলে অবাক হব না।
কী বলছেন? ঘোড়ায় শুনলে হাসবে? হাসুক।