Robbar

আমি কোন পথে যে চলি…

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 12, 2024 9:30 pm
  • Updated:December 12, 2024 9:30 pm  

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব জাগে, তখন হৃদয়কেই গ্রহণ করো। কারণ, বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালও করতে পারে, মন্দও করতে পারে। কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালই করবে।’ যুগান্তকারী এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, হার্টের স্নায়ুতন্ত্র অনেক বেশি স্বাধীন। এটি নিজস্ব ছন্দ তৈরি করতে পারে এবং মস্তিষ্কের নির্দেশের বাইরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে! এটি প্রায় হৃৎপিণ্ডের ‘নিজস্ব ছোট মস্তিষ্ক’ এর মতো। হার্টের কার্যকারিতার প্রতিটি অংশকে মাইক্রোম্যানেজ করে না মস্তিষ্ক।

প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়

‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব…’। মন গুনগুন করতেই পারে। কিন্তু ‘চঞ্চল মন আনমনা’ হলেও মস্তিষ্কের কোষ থেকে সংকেত আসতে থাকবে–বাপু হে, ওসব করে লাভ নেই। আজ অফিসে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। আজ না গেলে বস বসে আছে বলবে বলে, ‘ঘ্যাচাং ফু, খাব তোকে’। আবার ঘনঘোর বর্ষায় কারও হৃদয় ‘ময়ূরের মতো’ নেচে উঠতেই পারে। কিন্তু অন্য অনেকের মাথায় তখন চিন্তা, রাস্তায় জল জমে গিয়েছে। যদি বাড়িতে ঢুকে যায়। বা, জমা জলে মশার উৎপাত বাড়বে। বাচ্চাটাকে সামলে রাখতে হবে। ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার যা ভয়। সবাই জানি, রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্ব অমঙ্গল। কিন্তু তা মানি কই! তেমনই আমেরিকা-রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধের মতো হৃদয় ও মস্তিষ্কের লড়াই চলতেই থাকে।

This may contain: an image of a man with a baby elephant in his lap on a red and blue background

…………………………………

পড়ুন অনিল আচার্যর লেখা: দুই বাংলার সেতু পুস্তক সংস্কৃতি এখন বিপন্ন

…………………………………

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব জাগে, তখন হৃদয়কেই গ্রহণ করো। কারণ, বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে হৃদয়বান মানুষ অনেক শ্রেয়। বুদ্ধিমান বুদ্ধি দিয়ে ভালও করতে পারে, মন্দও করতে পারে। কিন্তু হৃদয়বান কেবল ভালই করবে।’ সত্যিই তো। মানুষের পাশে দাঁড়াতে গেলে মস্তিষ্কের চেয়ে হৃদয়েরই বেশি দরকার পড়ে। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে হয়তো কারও পাশে দাঁড়াতেই পারবেন না। সবসময় জমা-খরচের হিসেব করতে থাকবে। ফেরতের প্রত্যাশা না করে তখন কাউকে আর্থিক সাহায্য করা যাবে না। বৈষয়িক সাফল্যের জন্য একটু সচেতন, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক অবশ্যই প্রয়োজন। যারা ধনে-মানে অনেকের থেকে হয়তো বেশ কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু যারা হৃদয়ের কথা বেশি শোনে, তাদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় পরিণতি হয় উল্টো। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, সাফল্য পেতে গেলে মস্তিষ্কের সংকেতই গ্রহণ করতে হবে? দেশে বা দুনিয়ায় আজ হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে মগ্ন।

Story pin image

…………………………………

পড়ুন মৌসুমী ভট্টাচার্য্যের লেখা: ও মেয়ে তুই আড়াল হ’, ক্যামেরা তোকে দেখছে…

…………………………………

কিন্তু হৃদয়েরও যদি নিজের মস্তিষ্ক থাকে? তার নিজস্ব কিছু বক্তব্য থাকে? তখন উপায়? আগে মনে করা হত, হৃৎপিণ্ডের স্নায়ুতন্ত্র শুধুমাত্র একটি রিলে সিস্টেম, যা মস্তিষ্ক থেকে প্রেরিত সংকেত অনুযায়ী হৃদস্পন্দন নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। কিন্তু বাস্তব সে কথা বলছে না। সত্যিটা হল, হৃৎপিণ্ড কোনও ‘প্যাসিভ’ অঙ্গ নয়, আয়তনে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হলেও তারও একটা ‘মস্তিষ্ক’ আছে। নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, হৃদয়ের জটিল নিউরন নেটওয়ার্ক আগে যা মনে করা হত, তার চেয়ে বেশি কাজ করে। সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট এবং নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা হার্টের অভ্যন্তরীণ স্নায়ুতন্ত্রকে ইন্ট্রাকার্ডিয়াক স্নায়ুতন্ত্র বলে অভিহিত করেছেন। শুধু হার্টের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ, সংকোচন-প্রসারণ ও রক্ত সংবহনের বাইরেও এটির অনেক বেশি সক্রিয় অবদান রয়েছে। কী রকম? যুগান্তকারী এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, হার্টের স্নায়ুতন্ত্র অনেক বেশি স্বাধীন। এটি নিজস্ব ছন্দ তৈরি করতে পারে এবং মস্তিষ্কের নির্দেশের বাইরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে! এটি প্রায় হৃৎপিণ্ডের ‘নিজস্ব ছোট মস্তিষ্ক’ এর মতো। হার্টের কার্যকারিতার প্রতিটি অংশকে মাইক্রোম্যানেজ করে না মস্তিষ্ক।

Zebrafish Models: Relevance for Human Drug Discovery | ZeClinics CRO
জেব্রাফিশ

গবেষকরা জেব্রাফিশের উপর পরীক্ষা করেছেন। ঘটনাচক্রে যাদের হার্টের গঠন এবং কার্যকারিতার দিক থেকে মানুষের হার্টের সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে। হৃৎপিণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে এই পরীক্ষা নজর দিয়েছে, যার নাম সাইনোট্রিয়াল প্লেক্সাস (এসএপি)। বিজ্ঞানীরা তাতে বিভিন্ন ধরনের নিউরোন আবিষ্কার করেছেন। এই নিউরোনগুলি বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার ব্যবহার করে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যেমন এসিটাইলকোলিন, গ্লুটামেট এবং সেরোটোনিন, যা হৃদস্পন্দনের উপর স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের একটি স্তর তৈরি করে। যা ছন্দোময় বৈদ্যুতিন নিদর্শন তৈরি করে। কীভাবে হাঁটা এবং শ্বাস নেওয়ার মতো গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় করে মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ড, এটা তারই অনুরূপ। যা আগে পুরোপুরি বোঝা যায়নি।

………………………

বৈষয়িক সাফল্যের জন্য একটু সচেতন, ক্ষুরধার মস্তিষ্ক অবশ্যই প্রয়োজন। যারা ধনে-মানে অনেকের থেকে হয়তো বেশ কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু যারা হৃদয়ের কথা বেশি শোনে, তাদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় পরিণতি হয় উল্টো। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, সাফল্য পেতে গেলে মস্তিষ্কের সংকেতই গ্রহণ করতে হবে? দেশে বা দুনিয়ায় আজ হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। যে যার নিজের স্বার্থ নিয়ে মগ্ন।

………………………

ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? হৃদয়ের নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা থাকতেই পারে। সে যে ইঙ্গিত দেবে, তা-ও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তখন কার কথা শুনব? শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘মন মুখ এক কর।’ শ্রীচৈতন্যদেব বলতেন, ‘সে ই সেই’ অর্থাৎ নামই ভগবান– অভিন্ন। বিজ্ঞানও কি সে দিকেই চলার কথা বলছে? অর্থাৎ সমন্বয়। হৃদয় ও মস্তিষ্কের সমন্বয়ের অর্থ মন, শরীর ও আত্মার একীকরণ। তেমনটা হলেই আমাদের চিন্তাভাবনা, উদ্দেশ্য এবং কাজকর্ম নির্দিষ্ট অভিমুখে সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হতে শুরু করবে। এতে শুধু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হবে না, হার্ট রেট, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ঘুম ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে পারে। মানসিক দ্বন্দ্বে কাজের ক্ষতি হয়, সকলেই জানি। কিন্তু যদি হৃদয় ও মনের পারস্পরিক সংকেত উভয়ে নিঃশর্তে গ্রহণ করে, তাহলে কোনও ঝামেলাই থাকে না। জীবনের বাস্তবতাকে ঠান্ডা মাথায়, মনে কোনও আক্ষেপ না রেখে যদি গ্রহণ করি, তাহলে জীবনধারণ কত সহজ ও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। আমাদের দেহ-মন সুসংহত থাকলে অকারণ চিন্তা মাথায় ভিড় করে না, উদ্বেগে অস্থির হই না। বরং একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে– যাই ঘটুক না কেন, ঠিক লড়ে বের করে নেব। নির্দিষ্ট অভিমুখে মনস্থির করে এগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য তৈরি হয়।

This may contain: a drawing of a heart being attached to a parachute with the caption, your worst battle is you know and what you feel
সূত্র: ইন্টারনেট

…………………………………

পড়ুন শুভদীপ রায়ের লেখা: রবিঠাকুরের নোবেল লুকানো ছিল কলকাতার নিলামঘরে? খুঁজতে এসেছিল সিবিআই

…………………………………

আর বিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত দৃঢ় মানসিক স্বাস্থ্য। সে জন্য হৃদয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের গভীরভাবে বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরির প্রয়োজন। একবার যদি তা তৈরি হয়ে যায়, সে ভিত্তি নিজে ছাড়া অন্য কেউ নষ্ট করতে পারে না। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিই সেই আত্মবিশ্বাসকে সহজে টলাতে পারবে না। তখন নিজের গভীরে ডুব দিয়ে যে বিশ্লেষণ খুঁজে পাওয়া যাবে, সহজেই তা দিয়ে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি বা তাদের চেনা-জানার ভিত তৈরি হবে। কাকে গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হবে না। যত কম ভুল-উদ্বেগ-অশান্তি-কলহ-বিতর্ক, ততই জীবন হবে আরও হালকা, সমৃদ্ধ, আনন্দময় ও গভীর অর্থবহ। তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়বে জীবনীশক্তি। সুখে ভরে উঠবে আমাদের জীবন।

তাই বুদ্ধি ও আবেগের মধ্যে অযথা কূটকচালি না করাই ভাল। হৃদয় ও মস্তিষ্ক গভীরভাবে সংযুক্ত। তাদের সমন্বয় আরও দৃঢ় করে জীবনের পথে এগিয়ে চলা দরকার। আর সঙ্গে থাকুক রবীন্দ্রনাথের অমোঘ বাণী, ‘মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে’।