বাংলা ভাষা ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা পাওয়ায় সবথেকে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথকে। বিশেষ করে মনে পড়ছে তাঁর গান। এবং মনে পড়ছে তাঁরই গানের একটি লাইন: তোমার গীতি জাগাল স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া। কান্নায় সত্যিই ঝাপসা হয়ে উঠছে মন, কেননা, বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ করার জন্য নয়, তাকে আরও আগ্নেয় আধুনিক করার জন্য, তাকে আরও একনিষ্ঠ একালের করার জন্য, একক প্রতিভার তাড়নায় তিনি কী তুমুল তোলপাড় না করেছিলেন! তবু ‘কল্লোল’ যুগ গর্জে উঠেছিল তাঁর ভাষা ও ভাবের ধ্রুপদী শ্লথতা ও শৈত্যকে বিদ্রুপ করে। আধুনিক শ্লেষ আছড়ে পড়েছিল তাঁর সোনালি ফ্রেমের চশমা আঁটা, দূরে সরে থাকা, আভিজাত্যের ওপর।
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস
‘ধ্রুপদী’ বাংলায় লেখা মাইকেল মধুসূদনের ‘ধ্রুপদী’ মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ’ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর শ্লেষময় করুণ উক্তিটি মনে পড়ছে: মধুসূদনের বাংলা ছাপার অক্ষরে ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মধুসূদনের নিয়ে আসা অধিকাংশ শব্দই বাংলা ভাষা গ্রহণ করেনি। বাংলা ভাষা শেষ পর্যন্ত ‘ধ্রুপদী’ হয়ে ওঠার সম্মান ও গৌরবে উত্তীর্ণ হতে পারল, এই সুসমাচারের প্রেক্ষিতে কারও-কারও রামমোহন রায়ের ‘ধ্রুপদী’ বাংলায় লেখা ‘ধ্রুপদ’ সৃজনের কথাও মনে আসতে পারে। রামমোহনের বাংলা গান ক’জন বাঙালি চর্চা করেন? তাঁর গানের অনুষ্ঠান আদৌ হয় বলেও জানা নেই।
‘ধ্রুপদী’ শব্দটি সম্বন্ধে আমার মনে যতটা ভয়, ততটাই সংশয়। শব্দটির মধ্যে আমি মৃত্যুর গন্ধ পাই। পৃথিবীর যতগুলি ভাষা ‘ধ্রুপদী’-মর্যাদায় উত্তীর্ণ, ‘ধ্রুপদী’-প্রাচীনত্বে প্রতিষ্ঠিত, তারা প্রত্যেকে মৃত। ভাষার পণ্ডিত বা স্কলাররা সেইসব ভাষা, যেমন লাতিন, গ্রিক, সংস্কৃত, তাদের শবদেহের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ‘ধ্রুপদী’ উত্তরণ এই ভাষাগুলিকে মর্গের শৈত্য থেকে হিঁচড়ে টেনে বের করে নব প্রাণনে অঙ্কুরিত করতে পারেনি।
বাংলা ভাষা ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা পাওয়ায় সবথেকে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথকে। বিশেষ করে মনে পড়ছে তাঁর গান। এবং মনে পড়ছে তাঁরই গানের একটি লাইন: তোমার গীতি জাগাল স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া। কান্নায় সত্যিই ঝাপসা হয়ে উঠছে মন, কেননা, বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ করার জন্য নয়, তাকে আরও আগ্নেয় আধুনিক করার জন্য, তাকে আরও একনিষ্ঠ একালের করার জন্য, একক প্রতিভার তাড়নায় তিনি কী তুমুল তোলপাড় না করেছিলেন! তবু ‘কল্লোল’ যুগ গর্জে উঠেছিল তাঁর ভাষা ও ভাবের ধ্রুপদী শ্লথতা ও শৈত্যকে বিদ্রুপ করে। আধুনিক শ্লেষ আছড়ে পড়েছিল তাঁর সোনালি ফ্রেমের চশমা আঁটা, দূরে সরে থাকা, আভিজাত্যের ওপর। সম্ভবত তাঁর ‘ধ্রুপদী’ অভিমানের চাপা আঁচ থেকেই তিনি লিখলেন বৈপ্লবিক আধুনিকতায়, ৭০ বছর বয়সে, তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসটি। এবং নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষা তার সমস্ত সেকেলে ধ্রুবপদের খোলস ছেড়ে, তার শরীর থেকে প্রাচীনত্বের সব বলিরেখা ঝরিয়ে, বেরিয়ে এল নবজন্মের সোনালি সম্ভাবনায়। তবুও রবীন্দ্রনাথ, তাঁর আধুনিকতার প্রবল প্রতাপ সত্ত্বেও, কাফকা, কামু, জয়েস, রিলকে এবং বোদলেয়র এবং র্যাঁবো-প্রাণিত বাঙালির কাছে হয়ে থাকলেন রোম্যান্টিক দোলনমায়ায় বেমানান। এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না লিখে পারলেন না– তিনজোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র রচনাবলি লুটোয় পাপোশে!
………………………………………………
‘ধ্রুপদী’ শব্দটি সম্বন্ধে আমার মনে যতটা ভয়, ততটাই সংশয়। শব্দটির মধ্যে আমি মৃত্যুর গন্ধ পাই। পৃথিবীর যতগুলি ভাষা ‘ধ্রুপদী’-মর্যাদায় উত্তীর্ণ, ‘ধ্রুপদী’-প্রাচীনত্বে প্রতিষ্ঠিত, তারা প্রত্যেকে মৃত। ভাষার পণ্ডিত বা স্কলাররা সেইসব ভাষা, যেমন লাতিন, গ্রিক, সংস্কৃত, তাদের শবদেহের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ‘ধ্রুপদী’ উত্তরণ এই ভাষাগুলিকে মর্গের শৈত্য থেকে হিঁচড়ে টেনে বের করে নব প্রাণনে অঙ্কুরিত করতে পারেনি।
………………………………………………
বাংলা সাহিত্যিক এবং বাংলা ভাষায় পণ্ডিতদের সমস্ত চর্চা ও চেষ্টা ব্যর্থ করে বাংলা ভাষা কিন্তু ক্রমাগত মরছে। এবং তার মূল কারণ, বাংলা ভাষার নিরন্তর লুণ্ঠিত বাজারদর। অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার দাম নেই। আর বাংলা লিখে পেটচালানো দায়। যে কোনও মানের কবুতর ইংরেজি, যা শেখানো হয় অধিকাংশ ‘ইংরেজি’ স্কুল-কলেজে, তার মান্যতা এবং অর্থকরী উদ্যান অনেক নিশ্চিত ও বিস্তৃত আমাদের বাংলায়। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, কোনও ছাত্রছাত্রী আমাদের রাজ্যে বাংলা অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সোনালি স্বপ্ন কি সত্যি দেখি আমরা? ভাবতে পারি কি, শুধুমাত্র তার ‘ধ্রুপদী’ কিংবা ‘আধুনিক’ বাংলার জোরে সেই মানুষটি একদিন পদ্মার ইলিশ-বাজারে বুক ফুলিয়ে দাম হাঁকতে এবং ছুড়তে পারবে?
এই মুহূর্তে, কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে একবার বাংলা সাহিত্যের বাজারটার গন্ধ শুঁকে আসুন। ধূপধুনোর গন্ধ অবশ্যই পাবেন। সেই সঙ্গে মড়ার গন্ধও। কিছুতেই চেপে রাখা যাচ্ছে না। এবং চোখ সরানো যাচ্ছে না সম্প্রতি গজিয়ে ওঠা এক আপাতখঞ্জ প্রচেষ্টা থেকেও। সেই প্রচেষ্টাটি হল, বাংলা বইয়ের প্রকাশকরা ইংরেজি বইয়ের সাইড-ডিশ সাজাচ্ছেন তাঁদের প্রকাশনায়। এবং স্বপ্ন দেখছেন সেই ভবিষ্যতের যখন এই সাইড-ডিশ বা পার্শ্ব-পরিবেশন ঝলমলিয়ে উত্তীর্ণ হবে বাণিজ্যিক ধ্রুবতারায়।
………………………………………………………
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: ধ্রুপদী ভাষা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটানো একটা রকের আধুনিক আড্ডা
………………………………………………………
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ ইংরেজি গদ্যানুবাদে নোবেল প্রাইজ পেয়ে বাংলা ভাষাকে পরিয়েছিল তার আধুনিকতার যাথার্থ ও স্বীকৃতির সংশয়াতীত মুকুট। তবুও বিদেশে রবীন্দ্রনাথ আজও এক ‘ধ্রুপদী’ ইন্ডিয়ান পোয়েট! তাঁর মহত্বের সঙ্গে আধুনিকতার এবং বাংলা ভাষার সংযোগ বিশ্বজুড়ে নেই বললেই চলে। তাঁর বিশ্বপরিচয় আজ সীমাবদ্ধ, তাঁর অধিকাংশ বইয়ের খোঁড়া ইংরেজি অনুবাদে।
সন্দেহ নেই, আমরা, বাঙালিরা, যারপরনাই খুশি এবং গর্বিত বাংলা ভাষা ‘ধ্রুপদী’ মহত্বের শিখরে পৌঁছল বলে। কিন্তু একথাও গহনে ছ্যাঁৎ করে উঠছে, সমস্ত শিখরই জীবন থেকে ছিন্ন। সমস্ত মহত্বই শীতার্ত। পৃথিবীর যে কোনও ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের প্রাত্যহিক দুঃখ, যন্ত্রণা এবং লড়াইয়ের ধুলায়-ধুলায় ধূসর হয়ে। বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী দূরত্বে কিছুতেই থাকতে দেওয়া যাবে না। তাকে করে তুলতেই হবে আমাদের কাজের ভাষা, আমাদের পড়ার ভাষা, আমাদের বিজ্ঞান ও আইন-আদালতের ভাষা, আমাদের বিজ্ঞাপনের ভাষা, আমাদের প্রেম, ঘৃণা, আলিঙ্গন, বিদায়ের ভাষা, আমাদের অপরাধের ভাষা, ছলচাতুরির ভাষা, গুন্ডামির ভাষা, আমাদের ক্ষমার ভাষা, দয়ার ভাষা, বন্ধুত্বের ভাষা। আমাদের প্রশ্ন, প্রতিবাদ, দাবির ভাষা। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ থেকে ‘উই ডিমান্ড জাস্টিস নয়’। ‘আমরা চাই সুবিচার’ থেকে ‘আমাদের দাম্ভিক দাবি সুবিচার’।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি স্বপ্ন যেন আমরা সার্থক করতে পারি, এই রাজ্যের সকল দোকানের নাম, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং যেন লেখা হয় বাংলায়। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠুক ভাষা চর্চার কেন্দ্র। কিন্তু কেন্দ্রে থাকুক বাংলা ভাষার বৈজয়ন্তী এবং কেন্দ্রে বাজুক বাংলা ভাষার বিজয়শঙ্খ। ‘ধ্রুপদী’ নয়, বাংলা ভাষা সর্বার্থে আধুনিক হয়ে যেন পৌঁছতে পারে এই পরম পারমিতায়।