বাঙালির এই ঐতিহাসিক উদযাপনে আমরা প্রত্যেকে শামিল। যাঁরা মহাস্থানগড়, চন্দ্রকেতুগড়, গিরনার শিলালেখ, বাঙালির সমুদ্র-বাণিজ্যযাত্রা ইতিহাসে বিশ্বাস রাখেন তাঁরা হয়তো কিছুটা বেশি আপ্লুত। কিন্তু একেবারে অবিশ্বাস করা সম্ভব নয় বলে সরকারি উদ্যোগের গরিমাকে দান করে দেখানোর কষ্ট-কল্পনা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমরা হাঁটব বাঙালির ইতিহাসকে আরও যতদূর সম্ভব পিছনে ফিরে দেখার কাজে বা সন্ধানে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের ইশারা আমাদের পথ দেখাবে হয়তো। কিংবা আধুনিক নৃতত্ত্ববিদ্যার জিনোমস্টাডি বা বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কলা-কৌশল আমাদের গবেষণাগারে যুক্ত হবে রিসার্চ-টুল হিসেবে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
মহাভারতে উল্লিখিত, বলিরাজের পুত্র বঙ্গের অধিকারে স্থিত দেশ ‘বঙ্গ’। আবার কারও কারও মতে, তিব্বতি শব্দ ‘bans’ যার অর্থ– জলময়, স্যাঁতসেতে। তা থেকেই ‘বঙ্গ’ শব্দের উৎপত্তি। রঘুবংশের বর্ণনায় বঙ্গরাজাদের যুদ্ধে নৌ-বলই ছিল প্রধান কৌশল। কারণ এই দেশ ছিল নদীবহুল ও সমুদ্রতীরবর্তী। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’-এ ‘বঙ্গরাজ্য’ সমুদ্রতীরস্থিত।
সেই বঙ্গের মানুষের ভাষা ‘বাংলা’– কতটা প্রাচীন তা খুঁজতে শুরু করাটা ছিল ইতিহাসকে খুঁড়তে খুঁড়তে চলা। স্যাঁতসেতে আবহাওয়ার জন্যই হয়তো বাংলাভাষার নির্দশন খুঁজে পেয়েছিলেন প্রণম্য গবেষকরা বর্তমান বাংলা-র সীমানা পেরিয়ে। কখনও তা নেপালে, কখনও তিব্বতে। এখনও যে আরও কত অনাবিষ্কৃত, তা সময় বলবে। পাতার পুঁথির ভঙ্গুর জীবন লিপিবদ্ধ প্রমাণকে বাঁচাতে পারেনি ততটা। পাথুরে প্রমাণ উদ্ধার করতে হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণায়, খননে, সময়ের চিহ্নকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিশ্চিত করে পাঠোদ্ধারের পরিশ্রমে। বাঙালির ইতিহাস না লেখার স্বাভিমানী মন্তব্য যেন পাঁজরে সেই দাঁড়ের শব্দ– যা ইন্সটিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ (আই.এল.এসআর)-এর গবেষকদের জোট বেঁধে বাংলা ভাষার ধ্রুপদী সত্তাকে সন্ধানে প্রণোদনা জুগিয়েছে। ভাষাতাত্ত্বিক, পুরাতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, সংস্কৃত ভাষার গবেষক, পালি ভাষার অধ্যাপক, ভাষাতত্ত্বের প্রকৌশলী, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচনামূলক গবেষক ও তাত্ত্বিক, মহাফেজখানার তত্ত্ব-তালাশে পারঙ্গম তরুণ গবেষকরা একজোট হয়ে সন্ধান করেছেন ইতিহাসের দিকচিহ্নগুলিকে। একটি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শিকড় সন্ধান করতে করতে আজ থেকে আপাতত ২৬০০ বছরে পৌঁছে বাঙালির জাতিসত্তাকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের নিরিখে দেখা সম্ভব হল।
সময়কাল দু’-বছর মতো। আরও অনেকটা পথ হাঁটা সম্ভব বলেই মনে করেন এই গবেষণা প্রকল্পের মুখ্য দায়িত্ব পালনকারী অধ্যাপক অমিতাভ দাস। কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুযায়ী, অন্তত ১৫০০ বছরের থেকে ২০০০ বছরের পুরনো রচনা ও ইতিহাসের নথি খুঁজতে খুঁজতে আপাতত বিরতি বলা চলে এই গবেষণা ধারাটির। কাজ চলবে। ‘ধ্রুপদী’ বিশেষণে অনেকটা গরিমার আলো যে জুড়ে গেল আমাদের মায়ের ভাষায়, আমাদের সংস্কৃতির প্রাচীনতায়, তা সমগ্র বাঙালি জাতিকে আর একবার উপনিবেশিক চিন্তা-চেতনার সীমা পেরিয়ে আরও কিছুটা শিকড়ে ফেরাতে উৎসাহ জোগাবে নিশ্চিত।
সময়টা এখন ২০২৪, কিন্তু গবেষণা প্রকল্পটি শুরুর সময় কিংবা দাবিপত্র জমা দেওয়ার ও ‘ধ্রুপদী’ সম্মানের খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কিংবা এখনও চলেছে আধুনিক মেকলে-মনস্কদের মতামতের লম্বা-চওড়া বহর। এসব মুখের আড়ালে যা লুকিয়ে আছে, তা হয়তো নতুন কোনও কিছুকে সহজেই স্বীকার করে নেওয়া বিষয়ে অসহনীয়তা না কি উদাসীনতা? প্রশ্ন করা বা তোলা অবশ্যই ব্যক্তি-অধিকার। কোনও ভাষার ধ্রুপদী কি না তার দাবিপত্র কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করার অধিকারী একমাত্র রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। এ নিয়ে তর্ক চলে না। কিন্তু বাঙালি তর্ক না করে বাঁচে না। এ সংস্কৃতির অঙ্গ। তাই সমস্ত বিরুদ্ধবাদকে গ্রহণ করার উদার মানসিকতা শিক্ষণেরও এক সুবর্ণ পরিসর। পণ্ডিত ও গবেষকদের তরজা আই.এল.এসআর-এর মতো সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ভাষা ও সংস্কৃতি গবেষণার কাজে উসকে দেবে নিশ্চিত।
…………………………………………..
বাঙালি আর বাংলা ভাষাকে যাঁরা নিভন্ত ভাবেন, তাঁরাই আসলে এই সন্ধানের শিকড়ে নতুনতর আগুনের ফুলকি সংযোগ করছেন নিজেদের অজান্তে। তাই বাঙালির এই ঐতিহাসিক উদযাপনে আমরা প্রত্যেকে শামিল। যাঁরা মহাস্থানগড়, চন্দ্রকেতুগড়, গিরনার শিলালেখ, বাঙালির সমুদ্র-বাণিজ্যযাত্রা ইতিহাসে বিশ্বাস রাখেন তাঁরা হয়তো কিছুটা বেশি আপ্লুত। কিন্তু একেবারে অবিশ্বাস করা সম্ভব নয় বলে সরকারি উদ্যোগের গরিমাকে দান করে দেখানোর কষ্ট-কল্পনা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
…………………………………………..
বাঙালি আর বাংলা ভাষাকে যাঁরা নিভন্ত ভাবেন, তাঁরাই আসলে এই সন্ধানের শিকড়ে নতুনতর আগুনের ফুলকি সংযোগ করছেন নিজেদের অজান্তে। তাই বাঙালির এই ঐতিহাসিক উদযাপনে আমরা প্রত্যেকে শামিল। যাঁরা মহাস্থানগড়, চন্দ্রকেতুগড়, গিরনার শিলালেখ, বাঙালির সমুদ্র-বাণিজ্যযাত্রা ইতিহাসে বিশ্বাস রাখেন তাঁরা হয়তো কিছুটা বেশি আপ্লুত। কিন্তু একেবারে অবিশ্বাস করা সম্ভব নয় বলে সরকারি উদ্যোগের গরিমাকে দান করে দেখানোর কষ্ট-কল্পনা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমরা হাঁটব বাঙালির ইতিহাসকে আরও যতদূর সম্ভব পিছনে ফিরে দেখার কাজে বা সন্ধানে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের ইশারা আমাদের পথ দেখাবে হয়তো। কিংবা আধুনিক নৃতত্ত্ববিদ্যার জিনোমস্টাডি বা বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কলা-কৌশল আমাদের গবেষণাগারে যুক্ত হবে রিসার্চ-টুল হিসেবে। জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।
…………………………………………………
আরও পড়ুন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: ‘ধ্রুপদী’ নয়, বাংলা ভাষা সর্বার্থে আধুনিক হয়ে উঠুক
…………………………………………………
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগের মাননীয় মন্ত্রী অধ্যাপক ব্রাত্য বসুর নেতৃত্বে বাংলা ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদা প্রাপ্তির জন্য দাবিপত্র তৈরির প্রয়োজনীয় গবেষণা প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়েছে কঠোর পরিশ্রমে ও নিষ্ঠার সঙ্গে। তাই সমস্তরকম সাধারণ বিমুখতা ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি এই প্রাপ্তিকে স্বীকার করেছে। আগামিদিনে বাংলা ভাষ্য নিয়ে ‘সেন্টার অফ এক্সলেন্স’ প্রতিষ্ঠা ও গবেষণার নানাবিধ আয়োজন অব্যাহত থাকবে নিয়মমাফিক। অনুবাদ, আর্কাইভ তৈরি, তথ্য সংগ্রহ ও তার বিশ্লেষণ, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বময় বাংলা ভাষার সম্প্রসারণের কাজে তৈরি হবে প্রচুর পরিমাণে কর্মনিযুক্তির সুযোগ। বলা যায়, বাংলা ভাষায় যে সমস্ত কাজ করা সম্ভব হবে, তা আসলে হবে মাল্টিডিসিপ্লিনারি, যা বিদ্যায়তনের কঠিন সীমারেখাকে মুছে দিতে সক্ষম। সমাজবিজ্ঞান-সংস্কৃতিবিদ্যা, বৈজ্ঞানিক প্রকৌশল একসঙ্গে কাজ করবে মানুষের সংস্কৃতির লালনে-পালনে, উজ্জীবনে।
বিশিষ্ট কবি ও সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের উচ্চারণ আজ আমাদের সমস্ত বাঙালির– ‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন/ বাংলায় বাঁধি সুর/ আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর…’
.……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………