বঙ্গের হিন্দু বারোভুঁইয়াগণ পর্তুগিজ সামরিক শক্তির সাহায্য নিয়ে হিন্দু রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৬৩২-এর ২ জুলাই মোগলবাহিনী হুগলি আক্রমণ করে। প্রায় দেড় মাস যুদ্ধ চলার পর মোগলরা পর্তুগিজদের শুধু পরাজিত নয়, ধ্বংস করে দেয় হুগলি শহরটিকে। যুদ্ধে পরাজিত ৬৪টি বড় নৌকোর মধ্যে ৫৭টি ডুবে যায়, মৃত্যু হয় প্রায় হাজার দশেক পর্তুগিজ নরনারীর। সেনাপ্রধান, বণিক প্রধানদের সঙ্গে দিল্লিতে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চার্চ যাজকদেরও। পরে যাজকদের শুধু মুক্তি নয়, সম্রাট ফিরিয়ে দিয়েছিলেন চার্চ ও চার্চ সংলগ্ন ৭৭৭ বিঘা জমি। ভারতের অন্যতম প্রাচীন সেই ব্যান্ডেল চার্চ এখন পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম দ্রষ্টব্য।
এই তো কিছুদন আগে, ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম– শ্রীরামপুর বনাম কলকাতা। নিচে ইউরো কাপের লোগো। অনেকের কাছে বিস্ময় লাগলেও, যাঁরা জানেন, হুগলির ইতিহাসের সঙ্গে যাঁর সামান্য পরিচয় আছে, তিনি জানেন, আসলে ম্যাচটা হতে চলেছে ডেনমার্ক বনাম ইংল্যান্ডের। কিংবা যিনি নিমন্ত্রণ বাড়িতে ফুলকপির রোস্টের সঙ্গে ডাল দিয়ে ভাত মেখে গ্রাসটা মুখে তুলে তৃপ্তির সঙ্গে চিবোতে লাগলেন অথবা শেষ পাতে রসগোল্লায় কামড় দিলেন– তিনিও জানতে পারলেন না এতক্ষণ ধরে তিনি বাংলায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আগমনের প্রাচীন ইতিহাসের ধারা বহন করে চলেছেন। আসলে ওই ফুলকপি কিংবা রসগোল্লা তৈরির ছানাটি আমাদের বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন ইউরোপের একটি দেশ– পর্তুগাল।
ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ইউনিয়ন ( UEFA ) দ্বারা আয়োজিত উয়েফা, ইউরোপীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ এবং চলতি কথায় ‘ইউরো কাপ’ ফুটবল প্রতিযোগিতায় ইউরোপের ২৪টি দেশ অংশগ্রহণ করে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, এইসব দেশের মধ্যে কম-বেশি ১০টি দেশ একসময় বাংলায় গঙ্গা বা হুগলি নদীর ধারে বাণিজ্য করতে আসে। এর ইতিহাস খুঁজতে আমাদের পিছিয়ে যেতে প্রায় ৫০০ বছর।
ভাগীরথী-হুগলির শাখা নদী সরস্বতীর পূর্ব তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম ছিল সেকালের সবচেয়ে জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্র ও বন্দর। সপ্তগ্রাম, অর্থাৎ সাতটি গ্রাম মিলে এই বড় শহরটির জন্ম সুদেবপুর, বাঁশবেড়িয়া, খামারপাড়া, দেবানন্দপুর, শিবপুর, কৃষ্ণপুর আর ত্রিশবিঘা নিয়ে সপ্তগ্রাম। ত্রিশ বিঘার নাম বদলে এখন হয়েছে ‘আদি সপ্তগ্রাম’। এখানেই ইউরোপীয় বণিকেরা বাংলায় প্রথম বাণিজ্য করতে আসে ষোড়শ শতকের গোড়ায়। বঙ্গজননীর নির্মল ধারায়, পলিমাটির আশীর্বাদে, নাব্য স্রোতধারায় একদা এদেশকে দিয়েছে পর্যাপ্ত পানীয়, শস্য, পরিবহণের সুযোগ। সোনার বাংলায় ফসল এবং তার কুটিরশিল্পের লোভে এই এলাকার মধ্যে বিদেশি বণিকের দল বাণিজ্য করতে এসে গড়ে তুলেছিল কুঠি।পরে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সচেষ্ট হয়েছিল রাজ্য গড়তে। বণিকের মানদণ্ড ছেড়ে হাতে উঠে এসেছিল শাসনের রাজদণ্ড! বন্দর হিসেবে প্রথমে তাম্রলিপ্ত, পরে সপ্তগ্রাম এবং তারও পরে হুগলির নাম ছড়িয়ে পড়েছিল পাশ্চাত্যে। প্রাচীনকালের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর সপ্তগ্রামের এখন আর কোনও চিহ্ন নেই। কেবলমাত্র ইতিহাসবোধের অভাবে সামান্য কিছু নিদর্শন ছড়িয়ে আছে মাত্র। তাম্রলিপ্ত বন্দরের প্রাধান্য কমতে থাকার পর নবম-দশম শতাব্দী থেকে গুরুত্ব বাড়ে সপ্তগ্রামের। বন্দর-কেন্দ্রিক গড়ে ওঠে লোকালয়, নগর। ১৫৬০-এর দশকে দেখা যেত বছরে ৩০ থেকে ৩৫টি পর্তুগিজ জাহাজ সপ্তগ্রামে নোঙর ফেলত ব্যবসায়িক কারণে।
ষোড়শ শতাব্দীর পর সপ্তগ্রামের অবনতি, প্রাধান্য পায় হুগলি বন্দর। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে হুগলি নদীর নাব্যতা কমতে থাকায় প্রধান বাণিজ্যনগর গড়ে ওঠে কলকাতাকে ঘিরে। বর্তমানে ব্রাত্য বন্দর হুগলি। হুগলির দক্ষিণে কোন্নগর পর্যন্ত বিস্তৃত জেটি এবং বিদেশি কুঠি-দুর্গগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত। একটু সজাগ হলে বাংলার পুরোনো সেই ইতিহাস এখনও জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা যায়। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো নিদর্শন এখনও রয়ে গিয়েছে কয়েকটি অঞ্চলে। কিন্তু কী ছিল এইসব অঞ্চলে? ইংরেজ তো বটেই, আর কারা এসেছিল হুগলির তীরে বাণিজ্যের ভেক ধরে কুঠি গড়তে? জানার আগে হুগলি বন্দর গড়ার গোড়ার কথাটা একটু জেনে নেওয়া যাক।
হুগলি জেলার ত্রিবেণীর কাছে এসে গঙ্গা তিনটি ধারায় ভাগ হয়ে যায়। প্রধান ধারা সরস্বতী দক্ষিণ-পশ্চিমে সপ্তগ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়, দক্ষিণ-পূর্বে চলে যায় যমুনা আর দক্ষিণে ভাগীরথীর ধারা হুগলি ও আদিগঙ্গার পথ ধরে প্রবাহিত হয়ে পড়ত সমুদ্রে। সেকালে সরস্বতীর সঙ্গে দামোদর, রূপনারায়ণ ছাড়াও আরও অন্যান্য অসংখ্য ছোট নদীর জলধারা মিশত।
সরস্বতী তখন স্রোতস্বিনী। সমুদ্র থেকে সপ্তগ্রাম বন্দরে আসতে বিদেশি বাণিজ্যতরীর কোনও অসুবিধে হত না। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা, মালয়, সিংহল থেকে একাধিক বিদেশি বণিকের দল সপ্তগ্রামে এসেছে বাণিজ্য করতে। নদীমুখে চড়া পড়ার জন্যে অষ্টম শতাব্দী থেকে ধীরে ধীরে হতে থাকে তাম্রলিপ্তের অবনতি, সপ্তগ্রামের প্রাধান্য বাড়ে এর পরেই। সপ্তগ্রাম হয়ে ওঠে বন্দরনগর। ১৫৯১ সালে এই সপ্তগ্রামের নাম, বন্দর সপ্তগ্রামের নাম শোনা যায় শেষবারের মতো। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পাশের ভাগীরথীর গতিপথ একটু একটু করে বদলাতে থাকে। সরস্বতীর জলপ্রবাহ ক্রমে আশ্রয় করে ভাগীরথীকে। নাব্যতা হ্রাস পায় সরস্বতীর। ব্যাহত হয় নৌচলাচল। গুরুত্ব কমতে থাকে সপ্তগ্রামের। সপ্তগ্রামের সামান্য দক্ষিণে হুগলিতে ঘাঁটি গড়তে উদ্যোগ নেয় পর্তুগিজ বণিকেরা। ১৫১৫ সাল থেকেই পর্তুগিজ জাহাজকে নোঙর ফেলতে দেখা গিয়েছে সপ্তগ্রামের তীরে। প্রথম প্রথম জাহাজ তীরে রেখে চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই ব্যবসা সেরে পাড়ি দিত নিজেদের দেশে। ১৫৩০ থেকে তাদের দেখা গেল নদীর তীর ঘেঁষে চালের কুঠি গড়ে বেশ কিছুদিন একনাগাড়ে থাকতে। বছর পাঁচেকের মধ্যেই সেসব বাড়িঘর আকারে এবং সংখ্যায় বেড়ে উঠেছে তরতরিয়ে।
শুধু বণিক নয়, সঙ্গে নিজেদের রক্ষার অজুহাতে যোগ দিয়েছে সেনার দল। ১৫৩৭-এ বাংলার পাঠানরাজ গিয়াসউদ্দিন, শেরশাহের আক্রমণ ঠেকাতে পর্তুগিজ সেনাদের সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিল। সেই যুদ্ধ না হলেও বাংলার রাজার সঙ্গে পর্তুগিজদের সম্পর্কটা হয়ে উঠেছিল বেশ মধুর। তারই রেশ ধরে রাজার কাছ থেকে স্থায়ী কুঠি গড়ার আদেশটি নিয়ে নেয়। ১৫৪০-এ ভাগীরথীর তীরে হুগলিতে কুঠি নির্মাণের অভিপ্রায় নিয়েই তারা নোঙর ফেলে। আক্ষরিক অর্থেই বন কেটে বসত শুরু করে। ইতিহাস বলছে, সামপ্রায়ো বা স্যামপায়ো নামে জনৈক পর্তুগিজ বণিক প্রথম নয়টি পোত নিয়ে ভাগীরথীতে প্রবেশ করেন। তিনিই হুগলিতে প্রথমে কুঠি, পরে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। দুর্গের অবস্থান ছিল বর্তমান জুবিলি ব্রিজের দক্ষিণে। ১৫৭৯-তে জায়গাটির নাম পাওয়া যায় ‘উগোলিম’, যা থেকে আজকের হুগলি।
১৫৮৩ থেকে ১৫৯১-এর মধ্যে সপ্তগ্রামের অবনতি, ঘুরপথে জাহাজ, ব্যবসায়ীদের নৌকো হুগলির তীরে এসে দাঁড়ায়। হুগলি ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকে পূর্ব-ভারতের প্রধান বন্দর। সপ্তগ্রামের মাত্র তিন মাইল দূরে হুগলি বন্দর থেকে জাহাজে মাল ওঠাতে-নামাতে খুব একটা অসুবিধের কারণ ঘটত না। তবে পর্তুগিজদের উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। বাণিজ্যের পাশাপাশি বেশ দ্রুততার সঙ্গে তারা শক্তির বিস্তার করে। অসংখ্য পর্তুগিজ নাগরিক এখানে এসে বাস করতে শুরু করে।
বন্দর থেকে ক্রমে হুগলি হয়ে ওঠে জনবহুল শহর। কেবলমাত্র নদীর পশ্চিম পাড়ে নয়, অন্য পাড়ে বীজপুর, গড়িফা অঞ্চলেও পর্তুগিজদের গুদামঘর, সৈন্যাবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ওদের কাছে পোর্ট গ্র্যান্ডি বা বড় বন্দর ছিল চট্টগ্রাম, হুগলি হচ্ছে ‘পোর্টো পিকিউনো’ অর্থাৎ ছোট বন্দর। হিসেবমতো দেখা যাচ্ছে, বছরের বিভিন্ন সময়ে এখান থেকে রপ্তানি হয়ে ভিনদেশে যাচ্ছে চাল, গম, চট, চিনি, মাখন, মসলিন বস্ত্র, নানাপ্রকার ছিট, ছাতা, দড়ি, পিপুল, তেল ইত্যাদি। পরে এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রীতদাস আর নীল। চিন, মালয়, সিংহল, সুমাত্রা থেকে হুগলিতে এসে নামছে কর্পূর, মশলা, মরিচ, মুক্তা, সোনা-রূপোর গয়না। তবে এর অনেকটাই চলে গিয়েছে গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোড ধরে দিল্লি-আগ্রার পথে।
পর্তুগিজদের ব্যবসা ছিল বিচিত্র এবং বহুমুখী। হুগলিতে জাঁকিয়ে বসার সুবিধে ছিল সুলতানী প্রশ্রয়। তারা আঞ্চলিক শাসকদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে চালু করে জমিদারি প্রথা। একইসঙ্গে জমির মালিকানা আর প্রচুর অর্থলাভ। নৌবাণিজ্য ছাড়াও তারা বাণিজ্যের নামে চালাত দস্যুবৃত্তি, লুটতরাজ, দাস ব্যবসা। ১৫৯৯ সালে নির্মিত হয়ে যায় চার্চ, বণিক প্রধানদের জন্যে সুদৃশ্য অট্টালিকা, গুদামঘর। অচিরেই তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে মোগলদেরই অস্বীকার করতে শুরু করে। সম্রাট শাহজাহান তা সহ্য করেননি। সম্রাটের সঙ্গে পর্তুগিজদের বিবাদের অনেকগুলি কারণের অন্যতম ছিল স্থানীয় শাসকদের রাজনৈতিক উচ্চাশায় ইন্ধন জোগানো। বঙ্গের হিন্দু বারোভুঁইয়াগণ পর্তুগিজ সামরিক শক্তির সাহায্য নিয়ে হিন্দু রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৬৩২-এর ২ জুলাই মোগলবাহিনী হুগলি আক্রমণ করে। প্রায় দেড় মাস যুদ্ধ চলার পর মোগলরা পর্তুগিজদের শুধু পরাজিত নয়, ধ্বংস করে দেয় হুগলি শহরটিকে। যুদ্ধে পরাজিত ৬৪টি বড় নৌকোর মধ্যে ৫৭টি ডুবে যায়, মৃত্যু হয় প্রায় হাজার দশেক পর্তুগিজ নরনারীর। সেনাপ্রধান, বণিক প্রধানদের সঙ্গে দিল্লিতে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চার্চ যাজকদেরও। পরে যাজকদের শুধু মুক্তি নয়, সম্রাট ফিরিয়ে দিয়েছিলেন চার্চ ও চার্চ সংলগ্ন ৭৭৭ বিঘা জমি। ভারতের অন্যতম প্রাচীন সেই ব্যান্ডেল চার্চ এখন পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম দ্রষ্টব্য।
তবে, সম্রাট ফিরিয়ে দেননি হুগলি শহর। হুগলিতে বসান মোগল ফৌজদার কার্যালয়। পর্তুগিজদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলটিতে ব্যবসা শুরু করে ইংরেজরা। দেখা যাচ্ছে, ১৫৪০ থেকে ১৬৩২, প্রায় একশো বছর বঙ্গদেশের বুকে চলে পর্তুগিজদের শোষণ, অত্যাচার, লাম্পট্য, নারী ধর্ষণ এবং একইসঙ্গে ধর্মান্তরিকরণ। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে ঢুকে পড়েছিল পর্তুগিজ, তার প্রমাণ এখনও রয়েছে বাংলা ভাষার ব্যবহৃত শব্দে। হার্মাদ, বোম্বেটের পাশাপাশি আয়া, আলমারি, বাসন, আলপিন, বোতাম, কেদারা, বালতি, গরাদ, গির্জা, জানালা, সাবান, তামাক, গুদাম, বরগা, কামরা শব্দগুলিও পর্তুগিজ। ইজারা নেওয়া জমিতে তারাই প্রথম বাংলায় ফলিয়েছিল পেঁপে, লেবু, সাগু, তামাক, পেয়ারা, কপি, আতা, নোনা, আনারস। বাংলায় তাদের আর একটি অবদান ছানা। পর্তুগিজরা দুধ কাটিয়ে ছানা থেকে এক ধরনের ‘চিজ’ করত। সেটাই ছিল ছানার প্রপিতামহ। এখনও খোঁজ করলে নিউ মার্কেটে ‘ব্যান্ডেল চিজ’-এর সন্ধান পাওয়া যাবে। ভারতে ইংরেজদের বাণিজ্য করতে আসার মূল কারণ বিলেতে মরিচের দর বৃদ্ধি। ১৫৯৯ সালে মরিচের দর হঠাৎ প্রায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি পায়। মরিচ তো শুধু মশলা নয়, ওদের কাছে অতি মূল্যবান। মরিচ আনতে ওদের দৃষ্টি পড়ে প্রাচ্যে। বিলেতের বণিকেরা এক সভা ডেকে গঠন করে ফেলে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। চাঁদা তুলে জোগাড় হল অর্থ। রানি এলিজাবেথের অনুমতি পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। জাহাজ চলল সোনার দেশ ভারত অভিমুখে। প্রথমে বালেশ্বর, পরে বঙ্গদেশ-বিহারে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অনুমতি পায়। সে এক গল্প!
………………………………………………………………………
১৫৪০ থেকে ১৬৩২, প্রায় একশো বছর বঙ্গদেশের বুকে চলে পর্তুগিজদের শোষণ, অত্যাচার, লাম্পট্য, নারী ধর্ষণ এবং একইসঙ্গে ধর্মান্তরিকরণ। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে ঢুকে পড়েছিল পর্তুগিজ, তার প্রমাণ এখনও রয়েছে বাংলা ভাষার ব্যবহৃত শব্দে। হার্মাদ, বোম্বেটের পাশাপাশি আয়া, আলমারি, বাসন, আলপিন, বোতাম, কেদারা, বালতি, গরাদ, গির্জা, জানালা, সাবান, তামাক, গুদাম, বরগা, কামরা শব্দগুলিও পর্তুগিজ। ইজারা নেওয়া জমিতে তারাই প্রথম বাংলায় ফলিয়েছিল পেঁপে, লেবু, সাগু, তামাক, পেয়ারা, কপি, আতা, নোনা, আনারস। বাংলায় তাদের আর একটি অবদান ছানা।
………………………………………………………………………
১৬৩৫ থেকে হুগলি শহরে এরা ব্যবসা বৃদ্ধির চেষ্টা করে। ১৬৪০ থেকে ১৬৯০– এই পঞ্চাশ বছরে কোম্পানির ১৩ জন এজেন্ট হুগলিতে কাজ করেন। তাদের কুঠি-নির্মাণ শেষ হয় ১৬৫৭-তে। হুগলিতে ইংরেজদের সুখের দিন শেষ হয় আওরঙ্গজেবের শাসনকালে। বঙ্গের সুবাদার তখন মীরজুমলা। সম্রাটের আদেশে তিনি ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যের ওপর শুল্ক ধার্য করেন বার্ষিক তিন হাজার মুদ্রা। ইংরেজরা শাহজাহানের সনদ দেখিয়ে শুল্ক দিতে অস্বীকার করেন। মীরজুমলা রেগে গিয়ে আটক করেন সোরা বোঝাই কয়েকটি নৌকা। মীরজুমলার একটি নৌকা অবরোধ করে ইংরেজরা। ইংরেজদের উত্তরোত্তর সাহস বৃদ্ধি দেখে মীরজুমলা ওদের উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। চতুর ইংরেজ ভুল বুঝতে পেরে নৌকা ফেরত দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ক্ষমা চেয়ে শুল্ক বহাল রাখলেও তিনি নতুন করে ইংরেজদের কোনও জাহাজ হুগলিতে ঢুকতে দেননি। মীরজুমলার পর সায়েস্তা খাঁ বঙ্গের সুবাদার হয়ে এলে ইংরেজরা আবার নতুন পোত চালানোর এবং ব্যবসা করার অনুমতি পায়। এই সময়েই ফরাসি ও ডেনমার্কবাসী বা দিনেমার বণিকেরা এখানে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৬৮৬-র ২৮ অক্টোবর হুগলি বাজারের সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের সঙ্গে মোগলদের যুদ্ধ বেঁধে যায়। নবাব পাটনা, মালদা, ঢাকা এবং কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখলের নির্দেশ দেন। ইংরেজরা ভয়ে হুগলি ছাড়তে শুরু করে। তখন ইংরেজদের কুঠি প্রধান জোব চার্নক, হুগলি বন্দরের ত্রয়োদশ এজেন্ট। তিনি নিশ্চিন্তে বাণিজ্য ও কুঠি নির্মাণের উদ্দেশ্যে ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট ঘটনাচক্রে নেমেছিলেন সুতানুটির ঘাটে। হুগলি থেকে চলে এলেও ১৭০৪ পর্যন্ত হুগলিতে ইংরেজদের কুঠি ছিল। তবে হুগলির রমরমা এতে এতটুকুও কমেনি। ১৭২৮-এ উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে শতকরা আড়াই মুদ্রা হারে হুগলি বন্দরের বার্ষিক শুল্ক আদায় হচ্ছে ২২,১৯৭৫ মুদ্রা। ভাবা যায়!
(চলবে)