সপরিবার গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্সের হত্যার মূল অভিযুক্ত দারা সিংকেও উড়িষ্যা সরকার হয়তো জেল থেকে মুক্ত করবে। ভাবে মহেন্দ্র হেমব্রম মুক্তি পাওয়ার পরে, ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি উঠেছে, মালা পরানো হয়েছে, তখন উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নিজে এসে ওই শ্লোগান দিয়ে হয়তো বুঝিয়ে দেবেন যে, তাঁরা হিংসা-দ্বেষের পক্ষেই থাকবেন, যেমনটা তাঁরা ছিলেন গান্ধী হত্যার সময়ে।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
২৫ বছর কারাবাসের পর, অস্ট্রেলিয়ান ধর্মপ্রচারক গ্রাহাম স্টেইনস এবং তার দুই নাবালক সন্তানকে হত্যার অন্যতম আসামি মহেন্দ্র হেমব্রম, জেলের মধ্যে ‘ভালো আচরণ’ করার কারণে ওড়িশার কেওনঝড় জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৯৯ সালের ২২ জানুয়ারি, ধর্মপ্রচারক এবং তার দুই নাবালক ছেলে যে ভ্যানে ঘুমাচ্ছিলেন, তাতে হেমব্রম আগুন লাগানোর সঙ্গে জড়িত ছিল। ওড়িশা রাজ্য সাজা পর্যালোচনা বোর্ড তার মুক্তির সুপারিশ করেছিল এবং কেওনঝড় জেল কর্তৃপক্ষ বজায় রেখেছিল যে এটি আইন অনুযায়ী করা হয়েছে। এদিকে, মামলার প্রধান আসামি দারা সিং এখনও কারাগারে রয়েছেন। দারা সিংয়ের মুক্তির জন্য একটা সময়ে বিধায়ক হিসেবে প্রচার করেছিলেন যিনি, সেই বিধায়ক মোহন মাঝি এখন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী। ওই ঘটনায় ১৪ বছরের কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজা প্রদান করা হয়েছিল। দারা সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড অবশেষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়। ঘটনার সময় নাবালক চেঞ্চু হাঁসদাহ ২০০৮ সালে আবেদনের পর মুক্তি পায়।
যেই সময়ে গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্সকে পরিবার সমেত হত্যা করার খবর প্রকাশিত হয়, তারপরে সুমন চট্টোপাধ্যায়, অর্থাৎ কবীর সুমন দু’টি গান তৈরি করেন। সেই গান আজও আমাদের ওই ঘটনার বীভৎসতা বুঝতে সাহায্য করে। দেশে দেশে কালে কালে যে সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ানোই সংখ্যাগুরুর কাজ, তা সেদিন কবীর সুমন মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। প্যালেস্টাইনের মানুষের পাশে কেন আমাদের থাকা উচিত– তা এই দু’টি গান শুনলেই বোঝা যায়। বারে বারে যখনই দেশে বিদেশে সংখ্যালঘু মানুষ আক্রান্ত হয়, মব লিঞ্চিং বা গণপিটুনিতে মারা হয় তখন তাই কবীর সুমনের সঙ্গে আমরাও গেয়ে উঠি, ‘শোনো গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স, আমি সংখ্যালঘুর দলে।’ যখন মঞ্চে সেই সময়ে কবীর সুমন গেয়ে উঠতেন এবং নাগরিক কবিয়াল হিসেবে আমাদের সচেতন করতেন, এই ধর্ম আসলে বিদ্বেষের মূলে, এই বজরং দল, এই আরএসএস যে আমাদের দেশটাকে শেষ করে দিতে পারে, তখন আমরা তেমন আমল দিইনি, কিন্তু আজ প্রতি পদে পদে তাঁর বলা ওই কথাগুলো সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
ওই তো মানুষ ধর্মের কথা বলছে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ জ্বলছে,
কেওনঝড়ের আদিবাসীদের গ্রামে
বজরং দল মানুষ পোড়াতে নামে।
ওই তো কেমন ধর্মের ধ্বজা ওড়ে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ পোড়ে,
ভাটের সঙ্গে দুইনা বালক ছেলে
বজরং দল দিয়েছে আগুন জ্বেলে।
ওই তো কেমন ধর্মের ভগ্নাংশ
গন্ধ ছড়ায় মানুষের পোড়া মাংস,
পুড়ছে ছেলেরা পুড়ছে তাদের বাপ
ধর্ম নিচ্ছে বিধর্মীদের মাপ।
ওই তো কেমন ধর্মের খাঁটি দর্শন
সহজেই হয় ধর্ম যাজিকা ধর্ষণ,
কে ছিল হিন্দু কে হল খ্রিস্টান
কে হল বৌদ্ধ কে হল মুসলমান।
ওই তো কেমন ঘৃণার ঘৃণ্য আইন
শহিদ হলেন গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স,
থেকেছেন তিনি কুষ্ঠ রোগীর পাশে
তাঁর ধর্মটা মানুষকে ভালোবাসে।
আমার ধর্ম তোমায় জানিয়ে যাই
গানের দিব্যি আমি প্রতিশোধ চাই,
আমার বোধের হাতিয়ারে শান দিয়ে
পুড়ছি আমিও তোমায় সঙ্গে নিয়ে।
২০২৫ সাল আরএসএসের প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। দীর্ঘদিন আমাদের পাশের রাজ্য ওড়িশাতে, বিজেপি দ্বিতীয় হয়ে থাকতে থাকতে, অবশেষে এবারে ক্ষমতায় এসেছে। বিজেপি আরএসএস যে ধীরে ধীরে দেশের প্রায় সব রাজ্য কবজা করছে, তাও কিন্তু তাঁদের ওই ১০০ বছরের প্রকল্পেরই অন্তর্গত। বিজেপি ওই ওড়িশাতে যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে, তা কিন্তু দেখিয়ে দেয়, যতই অনেকে ভাবুক যে বিজেপি তৃতীয়বার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে তাঁদের হিন্দুত্বের কর্মসূচি থেকে সরে এসে, আক্ষরিক অর্থেই ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ এর রাস্তা নেবে, তাহলে এখন তাঁরা নিশ্চিত বুঝতে পারছেন, আরএসএস তাঁদের হিন্দুত্বের রাজনীতি থেকে এক চুলও সরে আসেনি। যে মুখ্যমন্ত্রীকে ওড়িশাতে বিজেপি বেছে নিয়েছে, সেই মোহনচরণ মাঝিও যে একজন সংখ্যালঘু বিদ্বেষকারী মানুষ, সেই খবর আসতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন আগে থেকে। সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন জায়গায়, ছবি এবং খবর দেখা যাচ্ছিল, যে তিনি ওড়িশার কেওনঝড়ে, ১৯৯৯ সালে বজরং দলের মাথা, দারা সিং, যার নামে খ্রিস্টান পাদরি গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্সের হত্যায় অভিযুক্ত, তার মুক্তির দাবিতে ধরনায় বসেছেন। শুধু এটুকু হলেও কিছু বলার ছিল না, কিন্তু যাঁদের সঙ্গে উনি এই ধরনায় বসেছেন বলে দেখা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুরেশ চভানকে। কে এই সুরেশ চভানকে? যাঁরা গত দশ বছরে, গোদি মিডিয়া দেখেছেন, তাঁরা জানেন, মূলত দক্ষিণ ভারত এবং মহারাষ্ট্রে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ানোর মূল যে চ্যানেল, সেই সুদর্শন টিভির একজন সঞ্চালক হচ্ছেন সুরেশ চভানকে। ‘লাভ জিহাদ’, ‘ইউপিএসসি জিহাদ’ এই সমস্ত শব্দ আনার মূল কারিগর এই সুরেশ চভানকে।
আসলে বহু দিন ধরেই, বিজেপি আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠন তাদের সংখ্যালঘুদের প্রতি যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটা করছে, তা আমরা অনেকেই হয়তো জানি, কিন্তু গত দশ বছরে, কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি থাকায় তা প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে। ওড়িশায় ১৯৯৯ সালে যখন গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স এবং তাঁর পরিবারকে পুড়িয়ে মেরেছিল, বজরং দলের সদস্যরা, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল দারা সিং, তখন সারা দেশ তখন চমকে উঠেছিল! সেই সময়ের সঙ্গে আজকের সময়ের একটাই পার্থক্য, আজকে যে বিভিন্ন জায়গায়, সংখ্যালঘুদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে, তার জন্য কোনও শাস্তি হয় না, সেই সময়ে হত। সেই কারণেই অস্ট্রেলীয় পাদরি এবং তাঁর পরিবারকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার দায়ে দারা সিং-কে যাবজ্জীবন কারাবন্দি করা হয়েছিল সেদিন। বিভিন্ন জায়গায় ইদানীং যে মসজিদের সামনে রামনবমী উপলক্ষে নাচ হয়, ডিজে চালিয়ে যে গান হয়, তা আজ প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেছে। এই উন্মাদনার বিরোধী কথা বলতে গেলে, তাঁকেই ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হয়। জোর করে গেরুয়া পতাকা লাগানোটাই এখন দস্তুর হয়ে গেছে।
……………….
বিজেপি আরএসএস যে ধীরে ধীরে দেশের প্রায় সব রাজ্য কবজা করছে, তাও কিন্তু তাঁদের ওই ১০০ বছরের প্রকল্পেরই অন্তর্গত। বিজেপি ওই ওড়িশাতে যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে, তা কিন্তু দেখিয়ে দেয়, যতই অনেকে ভাবুক যে বিজেপি তৃতীয় বার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে তাঁদের হিন্দুত্বের কর্মসূচি থেকে সরে এসে, আক্ষরিক অর্থেই ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ এর রাস্তা নেবে, তাহলে এখন তাঁরা নিশ্চিত বুঝতে পারছেন, আরএসএস তাঁদের হিন্দুত্বের রাজনীতি থেকে এক চুলও সরে আসেনি।
……………….
সুরেশ চভানকে এবং মোহনচরণ মাঝিরাও কিন্তু সেই ১৯৯৯ সালে সাজা পাওয়া দারা সিংকে ছাড়ার দাবিতে বহু দিন কিছু করেননি, কিন্তু তাঁরা যখন নিশ্চিত হন, যে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এখন তাঁদের অনুকূলে কথা বলবে, তখন তাঁরা দারা সিংকে ছাড়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে ১৯৯৯ সালে দারা সিংকে ফাঁসি দেওয়া হবে, সেই রায় দেয়, ওড়িশা হাইকোর্ট, পরে বহু মানুষের আবেদনের ভিত্তিতে সেই রায় বদল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ শোনানো হয়। দারা সিং কিন্তু শুধুমাত্র, গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স এবং তাঁর পরিবারকে পুড়িয়ে মারার সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন এমনটা নয়, তার বিরুদ্ধে আরও একজন মুসলমান মানুষকে হত্যার অভিযোগও ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, সুরেশ চভানকে জেলে দারা সিং-এর সঙ্গে দেখা করতে যান, কিন্তু তাঁকে জেল কর্তৃপক্ষ সেই অনুমতি না দিয়ে বলে, একমাত্র তাঁর পরিবারের লোক ছাড়া কেউ দারা সিংয়ের সাক্ষাৎ পাবেন না। সেই সময়ে জেল কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখার জন্য, মোহনচরণ মাঝি, সুরেশ চভানকে এবং অন্যান্যরা ধরনায় বসেন, জেলের সামনেই। এখন দেখার, কবে মূল অভিযুক্ত দারা সিংকেও ওড়িশা সরকার জেল থেকে মুক্ত করবে। যেভাবে এই মহেন্দ্র হেমব্রম মুক্তি পাওয়ার পরে, ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি উঠেছে, মালা পরানো হয়েছে, তখন মুখ্যমন্ত্রী নিজে এসে ওই স্লোগান দিয়ে বুঝিয়ে দেন কি না, যে তাঁরা হিংসা দ্বেষের পক্ষেই থাকবেন, যেমনটা তাঁরা ছিলেন গান্ধী হত্যার সময়ে। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের যেভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্সের হত্যাকারীকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও দেওয়া হতে পারে!
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved