দুর্ঘটনার খবর ইতিউতি আমরা পেয়েই থাকি। কখনও তা রেল দুঘর্টনা, কখনও অগ্নিকাণ্ড বা আরও কিছু। যখনই মানুষের এই বিপদ ঘনিয়ে আসে, এখনও আমরা দেখতে পাই বাছবিচারহীনভাবে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ভেদাভেদের রাজনীতি সেই জীবন পরীক্ষায় খাতায় ‘শূন্য’ পায়। ভারতের সংবিধান টিকে থাকে। টিকে থাকে মানুষের বিশ্বাস যে, শত বিপদেও, একেবারে অচেনা হলেও আরেকটা মানুষ পাশে এসে দাঁড়াবেই। দুঃসহ সময়ে এইটুকু বিশ্বাসই বেঁচে থাকার জলসত্র। জায়গা প্রচুর, পাশে দাঁড়ান।
ওদের কেউ কেউ আর কোনও দিনই ঘরে ফিরবে না। যারা ফিরে এল, আতঙ্ক তাদের পিছু ছাড়বে কি?
আচমকা বিকট এক শব্দ ৷ সঙ্গে প্রবল ঝাঁকুনি। বগির ওপর বগি উঠে সে এক বীভৎস ছবি! কী অপরাধ করেছিল ওই ছ’-বছরের শিশু? জানা গিয়েছে, গুরুতর অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে বিপর্যয় মোকাবিলা দলের কর্মীরা। দ্রুত তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। তার দু’-পায়ের হাড় সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পাশাপাশি জোর ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার লিভারও। লিভার থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে অপারেশন করা হয়। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয় না। মৃত্যু হয় শিশুটির। এই মৃত্যুর মূল্য চোকাবে কে? কিংবা যে বাবার মেয়ের সঙ্গে পালন করা হল না ফাদার্স ডে! ডিউটি বদল করেছিলেন, আর সেটাই কাল হল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গার্ড আশিস দে-র। ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন রেলকর্মী। অভিশপ্ত যাত্রা শেষ হল আজীবনের জন্য।
…………………………………………………………………………….
দলে দলে ভাগ হয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন ফজলুর আর গ্রামবাসীরা। সব আনন্দ-আয়োজন ফেলে বিপদাপন্নদের উদ্ধারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা গ্রাম। কিছু গ্রামবাসী এনে দিল জল, কেউ খাবার এবং অন্যরা যেভাবে পারে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করল। স্থানীয় মসজিদ থেকে ঘোষণা করা হয় পরব স্থগিত রেখে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মহম্মদ আজিবুল, পেশায় একজন পরিযায়ী শ্রমিক, পরিবারের সঙ্গে ইদ উদ্যাপন করতে বাড়ি ফিরেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, রেলওয়ে এবং জেলা কর্তৃপক্ষ আসার আগে গ্রামবাসীরা বগি থেকে অর্ধেক শবদেহ বের করে নিয়েছিল।
…………………………………………………………………………….
সকালের নমাজ সদ্য শেষ হয়েছে তখন। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে কোথা থেকে কী ঘটে গেল, দিশা পাচ্ছিলেন না ওঁরা। প্রাথমিক ধাক্কার পরে বোঝা গেল, এই শব্দের অর্থ একমাত্র রেল দুর্ঘটনাই হতে পারে। ছুটলেন ফজলুর। ফজলুর রহমান। সঙ্গে বাকিরা। বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীও দুর্ঘটনাস্থলের দিকে ছুটতে থাকে। ফজলুরই প্রথম ঘটনাস্থলে পৌঁছান। দেখলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের চারটি কামরা লাইনচ্যুত। তার মধ্যে অন্তত দু’টি কামরা মালবাহী। কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, কারওর প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, মহিলা ও শিশুরা কাঁদছিল। এমন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েননি ফজলুর! আহতদের সাহায্য করার জন্য তিনি আর তাঁর বন্ধুরা এগিয়ে আসেন। ততক্ষণে গ্রামের বেশ কিছু লোক ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছে। দলে দলে ভাগ হয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন ফজলুর আর গ্রামবাসীরা। সব আনন্দ-আয়োজন ফেলে বিপদাপন্নদের উদ্ধারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা গ্রাম। কিছু গ্রামবাসী এনে দিল জল, কেউ খাবার এবং অন্যরা যেভাবে পারে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করল। স্থানীয় মসজিদ থেকে ঘোষণা করা হয় পরব স্থগিত রেখে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মহম্মদ আজিবুল, পেশায় একজন পরিযায়ী শ্রমিক, পরিবারের সঙ্গে ইদ উদ্যাপন করতে বাড়ি ফিরেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, রেলওয়ে এবং জেলা কর্তৃপক্ষ আসার আগে গ্রামবাসীরা বগি থেকে অর্ধেক শবদেহ বের করে নিয়েছিল।
‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে’– শুধুমাত্র মানবতার জন্য ওরা খুশি মুলতুবি রেখে এগিয়ে এসেছে। কোনও বাহবা কুড়নোর জন্য নয়! কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছে, কেউ আহতদের কাঁধে তুলে পৌঁছে দিয়েছে স্থানীয় হাসপাতালে। কেউ কেউ তোবড়ানো বগির ভেতর থেকে বের করেছে শব।
শুধু তাই-ই নয়, মানবিকতার অনন্য নজির খাড়া করেছে স্থানীয় মানুষ। দুর্ঘটনায় বেওয়ারিশ পড়ে থাকা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ, কাগজপত্র– সব একজায়গায় জড়ো করে পুলিশের কাছে সঁপে দিয়েছে। যাতে প্রত্যেক যাত্রীর মূল্যবান প্রতিটা জিনিস তার অথবা তার পরিবারের কাছে পৌঁছে যায়। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের তরফ থেকে জানানো হয় তাদের কাছে যে পরিমাণ রক্ত আছে, তা পর্যাপ্ত নয়। জুনিয়র ডাক্তাররা তখন নিজেরাই রক্তদান করেন। যখন স্থানীয় মানুষের কাছে এই খবর পৌঁছায়, তখন তারাও রক্তদান করতে এগিয়ে আসে। দুর্ঘটনায় জখমদের পাশে দাঁড়ান শিলিগুড়ির স্বেচ্ছাসেবীরাও। কেউ সাহায্য করলেন রক্ত দিয়ে, আবার কেউ সাহায্য করলেন খাবার দিয়ে। সোমবার রাঙাপানির কাছে ট্রেন দুর্ঘটনার পর রেল, স্বাস্থ্য ও জেলা প্রশাসনের কর্মীদের সঙ্গে উদ্ধারকাজে হাত লাগান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। খবরেই প্রকাশ মর্গের সামনে চায়ের দোকানে তৈরি হয়েছে পুলিশের হেল্প ডেস্ক। ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতদের আনা হচ্ছে এক এক করে, আর চায়ের দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়। হুমড়ি খাওয়া লোকজনকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। আর সেই কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন চা-ওয়ালি যমুনা সাউ। পুলিশ ডেস্কের-ই একজন হয়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রিংকা চক্রবর্তী-র লেখা: পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া হিমালয়ের সামনে ওঁরা আটজন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এর আগে গাইসাল ট্রেন দুর্ঘটনার সময়ও উত্তরবঙ্গবাসীর এই মানবিক মুখ দেখেছিলাম আমরা। করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার সময়ও আমরা মানবতা প্রত্যক্ষ করেছি।
কোভিডের সময়ও আমরা দেখেছি কীভাবে করোনা আক্রান্তর বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে গিয়েছে কমিউনিটি কিচেনের মাধ্যমে। সমস্তরকম পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে রেড ভলেন্টিয়ার্স।
কোভিড যাদের অস্পৃশ্য বানিয়ে দিয়েছিল এক লহমায়, সেই সময় সতর্কীকরণ মেনে তাদের মুখে খাবার, দরকারি ওষুধপত্র পৌঁছে দিয়েছে কিছু মহানুভব প্রতিবেশী। কিন্তু মানুষ কি সবসময় তার বিচারবুদ্ধি, বিবেককে কাজে লাগায়? প্রতিদিন কী পরিমাণ নৈতিক স্খলন, বিবেকের স্খলন হচ্ছে, তা কি কখনও ভেবে দেখে? মানবীয় গুণাবলির বিসর্জনই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, হারিয়ে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতাবোধ, লোপ পাচ্ছে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা। তবুও মন্দের পাশে ভালোর অস্তিত্ব আছে বলেই পৃথিবীতে এখনও ভালো মানুষ আছে কিছু। যুগে যুগে বারেবারে মানুষ মানুষেরই পাশে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ধর্ম তাদের আলাদা করতে পারেনি। সেখানে লাগেনি রাজনীতির রং। তাদের ধর্ম একমাত্র মানবধর্ম। রক্তের রং সবার এক। সম্ভবত ২০১৮ সালে রমজান মাসে রোজা রেখেই রক্তদান করে শিরোনামে এসেছিলেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজ এলাকার এক সাহসী যুবক ইমাম আলি মোল্লা। অমুসলিম মেয়ে সৃজিতার জন্য রক্তদান করে ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবতার নজির গড়েছিলেন। কিছু মানুষ ধর্ম, বর্ণ এবং গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠে এভাবেই মানবতার প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে অক্ষত রাখে। কোভিডের সময় যখন তথাকথিত পরমাত্মীয়রাও পাশে দাঁড়ায়নি, তখন কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং সহৃদয় মানুষ বিভিন্ন ধর্মের মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পাদনের জন্য এগিয়ে এসেছিল। এখন সেই সাধারণ মানুষেরই জীবনের দাম তুচ্ছ। গরিব মানুষের আবাস উচ্ছেদ করে মন্দির তৈরি হয়। কে বোঝাবে ‘সে মন্দিরে দেব নাই’!
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………