প্রতিটি জায়গায় একটা বিশেষ বিশেষত্ব আছে। কথায় বলে, ভালো জলবায়ু ভালো স্বাস্থ্যের লক্ষণ। সেই জলবায়ুর খোঁজে আমরা ছুটে চলেছি দূর অজানায়, নিরুদ্দেশে। নিরুদ্দেশও হারিয়েছে অন্য কোনও নিরুদ্দেশে। নিজেকে জানার খোঁজ চলছে, খোঁজ চলছে নিজেকে খোঁজার। নতুন জায়গা খোঁজার তাগিদ এখন ট্রেন্ডিং তবুও বারবার বলতে ইচ্ছে হয়, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।’
প্রচ্ছদ অর্ঘ্য চৌধুরী
এই যুগের ভাস্কো দা গামা, মার্কো পোলো এবং কলম্বাসরা তাঁদের কর্পোরেট জীবনের ঝক্কি ছেড়ে একটু শান্তি খোঁজার দায়ে চুপ করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। ম্যানেজারের ফোনের ভয়ে অনেক সময় ফোন বন্ধ রেখে বা কারওর মৃত্যুর ভুয়া খবর রটিয়ে চুপচাপ পালিয়ে যাচ্ছে অজানা তেপান্তরে। যে-তেপান্তরের খবর কেউ রাখে না। যেখানে বিকেল নামে পাড়ভাঙা সূর্যের স্নিগ্ধ আলোতে। যেখানে আজও সন্ধে হলে ভিড় করে জোনাকির দল। যেখানে আজও শব্দ হলে প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসে। এই দিকশূন্যপুরের খোঁজে ছুটে চলেছে একটা গোটা প্রজন্ম। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খুঁজে চলেছে অজানা পিনকোড। সুইগি, জোমাটো, ব্লিঙ্ককিট পৌঁছয় না যেখানে। ফাইভ জি আজও যেখানে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, সেই ঠিকানার খোঁজ করছে সারা পৃথিবীর মানুষ। অফবিট-অজানা-বেনামী!
বহুবার বহু দেশি-বিদেশি বহুজাতিক সংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে ফিনল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ। বারবার প্রশ্ন জেগেছে মনে, ওই দেশে এমন কী আছে, যা এখানে নেই? ওই দেশে কি কর্পোরেট চাকরির এত চাপ নেই? ওই দেশে কি সবাই প্রেম করে? ওই দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হতে গেলে কী করতে হয়? অজস্র ঘুম না আসা রাত, পেরিয়ে গিয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। একলাফে পৌঁছে যাওয়া যায় ফিনল্যান্ডে। খানিক সময়ের জন্য সুখী হয়েছে বিষণ্ণ মন। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের তরফে জানা গিয়েছে, ভারতীয়রা অজানা জায়গার খোঁজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং তারা মনে করছে জীবনটা একবার, তাই সব আনন্দটুকু চেটেপুটে খেতে হবে। ‘স্কাইস্ক্যানার’ বলে একটি সংস্থা সমীক্ষায় দাবি করেছে, প্রায় ৯৮ শতাংশ ভারতীয় পর্যটক অজানা জায়গায় খোঁজ করেছে ২০২৪ সালে। ‘এসওটিসি’ নামক ভ্রমণ সংস্থার সভাপতির দাবি আরও চমকে দেওয়ার মতো। তিনি জানিয়েছেন যে, গত ৭৫ বছর ধরে ভারতীয়রা যেসব পর্যটন স্থানের খোঁজ করত, সেই রীতি হঠাৎ বদলে গিয়েছে। তারা এখন অজানা, নিরিবিলি জায়গায় খোঁজ করছে। ভিড়ের মাঝে ভিড় হওয়ার প্রবণতা থেকে বাঁচার জন্য লোকে পাড়ি দিচ্ছে দিকশূন্যপুরের পাড়ে। একটু শান্তির খোঁজে। একটু মুক্তির খোঁজে। জনপ্রিয় পর্যটন স্থানের মাহাত্ম্য ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। উপরন্তু দুর্গম, জনশূন্য পর্যটনের স্থানের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। যদিও এই অফবিট জায়গায় খোঁজার কাজে যথেষ্ট মদত জুগিয়েছে সমাজমাধ্যমের বেশ কিছু প্ল্যাটফর্ম। বাঙালি এখন দিঘাকে ‘ঘিঞ্জি’ বলে উল্লেখ করে। মন্দারমণি বাঙালির কাছে বড়লোকদের জায়গা। উপরন্তু মৌসুমী আইল্যান্ড বাঙালির প্রিয়। এখন দার্জিলিং নয়, তার চেয়ে দার্জিলিঙের পার্শ্ববর্তী গ্রাম এখন বড় আদরের, বড্ড কাছের।
গত বছরের শেষের দিকে আরও একটি চমকে দেওয়ার মতো তথ্য উঠে এসেছে। পর্যটকরা এখন একা ঘুরতে বেশি স্বছন্দ বোধ করে। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, আগামী সাত বছর পর্যন্ত সোলো ট্র্যাভেলের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ৯% হারে বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ সোলো ট্র্যাভেলের সোলোআনা স্বাদ চেটেপুটে নিতে তৈরি পর্যটকরা। সমীক্ষা থেকে আরও জানা গিয়েছে বিগত দুই বছরে সোলো ট্র্যাভেল সংক্রান্ত খুঁটিনাটি খোঁজার খোঁজ প্রায় ৭৪% হারে বেড়েছে। একা একা ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা মূলত যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি দেখা। ৬৮% পর্যটক যারা একা একা ঘুরতে পছন্দ করে তাদের গড় বয়স ৩১ বছরের মধ্যে। সোলো ট্র্যাভেল করতে পছন্দ করে মূলত ২৫- ২৮ বছর বয়সি যুব সম্প্রদায়, যাদের শতকরা শতাংশ প্রায় ৩৭%। তবে নারী-পুরুষের তুলনা করতে গিয়ে উঠে এসেছে আরও একটা চমকে দেওয়ার মতো বিষয়! জানা গিয়েছে একা একা ঘুরতে যেতে নারীরা বেশি পছন্দ করে। শতকরা ৬০ শতাংশ নারী একা ঘুরতে যেতে স্বছন্দ বোধ করে। কোভিড পরবর্তী সময়ে একা একা ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীর মধ্যে একা একা ঘুরতে যাওয়ার স্থানের মধ্যে রয়েছে এ দেশের মানালি, জম্মু-কাশ্মীর, সিমলা। এককালে বিদেশে ঘুরতে যাওয়া মানেই ছিল আমেরিকা নয় লন্ডন। কিন্তু সেই সব জংলা দেশের ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে পর্যটকরা খুঁজে নিয়েছে অন্য পথ, অন্য কোনও দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেন এখন পর্যটকদের হট কেক। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই দেশ ইতিহাসে সমৃদ্ধ এবং এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেকের কাছে আকর্ষণের কারণ। নরওয়েও এখন অনেকের কাছে প্রিয় ট্র্যাভেল ডেসটিনেশন হয়ে উঠেছে। অরোরা বোরিয়ালিসের মায়াবী আলো যেন রোজ রাতে দরজায় কড়া নেড়ে যায়। আবার ইউরোপের দেশ ডেনমার্ক ভরে উঠছে পর্যটকের ভিড়ে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভুটানও এখন অফবিটের তালিকার রয়েছে। রোনাল্ডোর দেশ পর্তুগালও পর্যটকদের শান্তির খোঁজের জায়গা।
এখানেই শেষ নয়, তালিকা আরও দীর্ঘ। ওয়েলনেস ট্র্যাভেল-ট্যুরের ব্যবসা লাফিয়ে বাড়ছে। পর্যটকরা একটু নির্জনে নিজেদের ডিটক্সিফায়েড করে তুলছেন। এই ওয়েলনেস ট্র্যাভেলের শীর্ষে আছে ইন্দোনেশিয়ার বালি! যোগা, মিউজিক থেরাপি, মেডিটেশনের জন্য বালি অনেক পর্যটকের খুব পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে। মেক্সিকো দেশের তুলুম এখন ওয়েলনেসের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়াও কোস্টারিকা, থাইল্যান্ড, জাপান, ইতিমধ্যেই পর্যটকের প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে। এ দেশে শান্তি খুঁজতে অনেকের পছন্দ কেরলের মনোরম পরিবেশ। এছাড়াও হোমস্টে চাহিদা বেড়েছে। শুধু তাই নয় কলকাতার কাছাকাছি একটু ‘অন্যরকম’ জায়গায় খোঁজ করছে অনেকে। সপ্তাহের বিষণ্ণতা দূরে ঠেলার জন্য জাস্ট একটা দিনকে ভালো করতে চেয়ে লোকে ছুটে যাচ্ছে কলকাতার কাছাকাছি কোনও সাজানো গ্রামে। প্রাণপণে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে এক টুকরো সুখ।
এখন সমাজমাধ্যমে একটা কথা নিয়ে অনেকেই মশকরা করে! অনেকে বলেন, একটা গোটা জেনারেশন শুধু পাহাড় আর মোমো খেয়েই কাটিয়ে দিল। অনেকে খিল্লি করেন তবে মনোবিদদের একাংশের মতে, সুখ খোঁজার নির্দিষ্ট কোনও উপায় নেই। যার যেটা ভালো লাগে। পাহাড় হোক বা সমুদ্র– দিনের শেষে ভালো থাকাটা জরুরি। নিজে কী চাইছি সেটা জানা জরুরি। কেন চাইছি, কেন কাঁদছি, কেন প্রেম ভাঙার যন্ত্রণা সহ্য করছি, সবকিছুর শেষে কী-ই বা পড়ে থাকে কোনও ফ্যাকাশে রাতে? শান্তিনিকেতনের ফুরফুরে দিন যদি আমার সবটুকু ভালো করতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী? উত্তরায়ণ, উদীচী যদি হঠাৎ করে পাশে এসে বলে, ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি!’ তাহলে কেমন হবে? যদি শান্তিনিকেতনের পাশে একটুকরো নতুন জায়গা খুঁজে পায়, তাহলে কি একবারেও জন্যও নিজেকে ভাস্কো দা গামা বলে মনে করতে পারি?
পাশের বাড়ি মেয়েটাকে সেদিন দেখলাম খোলা ছাদে! চুলগুলো এলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদাসী হয়ে। রোদের আলো তখন ভিজিয়ে দিয়েছে চারপাশ। কলকাতার জলবায়ু তাকে বদলে দিচ্ছে, প্রতি রবিবার তার জন্য বাড়ির পূর্বদিকের জানলা খুলে বসে থাকি। তাকে একটিবার দেখার জন্য। হয়তো সে নিজের বাড়ির ছাদে সেই শান্তি খুঁজে পাই, যার জন্য আমরা ভিড় থেকে পালাতে চাই নির্জন কোনও গন্তব্যে। একা হয়ে যেতে চাই মাঝে মাঝে। মেয়েটাকে দেখলেই আমার জীবনানন্দ দাশের ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতা মনে পড়ে যায়। ‘তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলেও…’ সত্যি তোমাকে যে কলিকাতার জলবায়ু বদলে দিয়েছে সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি। আসলে প্রতিটি জায়গায় একটা বিশেষ বিশেষত্ব আছে। কথায় বলে, ভালো জলবায়ু ভালো স্বাস্থ্যের লক্ষণ। সেই জলবায়ুর খোঁজে আমরা ছুটে চলেছি দূর অজানায়, নিরুদ্দেশে। নিরুদ্দেশও হারিয়েছে অন্য কোনও নিরুদ্দেশে। নিজেকে জানার খোঁজ চলছে, খোঁজ চলছে নিজেকে খোঁজার। নতুন জায়গা খোঁজার তাগিদ এখন ট্রেন্ডিং তবুও বারবার বলতে ইচ্ছে হয়, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।’