অসংখ্য শারীরিক অত্যাচার ধামাচাপা পড়ে যায় জেলের চার দেওয়ালের মধ্যে। জেল কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া ক্রমাগত এসব ঘটনা ঘটে চলা কোনওভাবে সম্ভবপর নয়। আবার এও মানি, প্রত্যেকে খারাপ নন। কিন্তু, এই ঘটনা দেখেও কেন তাঁরা নিশ্চুপ? কেন বিভিন্ন মহিলা কমিশন, হিউম্যান রাইটস কমিশন এই বেলায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকল, যাঁদের ওপর এই নির্যাতন হয়ে চলছে তাঁরা সাজাপ্রাপ্ত আসামী বলে, নাকি কর্তৃপক্ষের বড় বড় মাথা এর সঙ্গে জড়িত বলে, এই প্রশ্নও থাকল এই লেখাটির মাধ্যমে।
জেল অর্থাৎ ‘সংশোধনাগার’। ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকে এখনও অবধি কিংবা ভবিষ্যতেও অসংখ্য মানুষ বুঝে কিংবা না-বুঝে জড়িয়ে গেছেন কিংবা যাবেন বিভিন্ন প্রকার অপরাধের সঙ্গে। কখনও কখনও তা ভেবেচিন্তে, কখনও আবার তা হিংসা কিংবা প্রতিশোধের তাড়নায়, স্নায়ু শান্ত রাখতে না পেরেও। তবে, সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি এমন একটি মাধ্যমের, যেখানে অপরাধীরা বিচার-পরবর্তী সাজাপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট সময়টুকু অতিবাহিত করবেন, আরও একবার সুযোগ পাবেন নিজেকে শুধরে নেওয়ার– সে জন্যই সংশোধনাগার। তবে এই পরিকাঠামোয় আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকবে তাঁদের ভালো পথে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা। যাতে, সাজাপ্রাপ্তির মেয়াদ শেষে এ-জীবনে তিনি আর কোনওভাবে কোনও প্রকার অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে যুক্ত না হন। যাতে একটি সুষ্ঠু, অপরাধমুক্ত সমাজের দিকে এক পা এক পা করে আমরা এগিয়ে যেতে পারি, এগিয়ে যেতে পারি নিজেদের সভ্য বলার আরও একটি সম্মুখ পদক্ষেপের দিকে। কিন্তু, এক্ষেত্রে যদি ‘রক্ষক’-ই হয়ে ওঠে ‘ভক্ষক’– তবে তা প্রশ্নের শানানো আঙুল তোলে শিক্ষিত সার্বিক সমাজের দিকে, উন্নত সভ্যতার দিকে।
গত বৃহস্পতিবার কলকাতা হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতি টি. এস. সিভাগনানমের ডিভিশন বেঞ্চে Amicus Curiae-এর একটি রিপোর্ট পেশ হওয়ার পর সে-তথ্য দেখে কোর্টচত্বরে বেশ শোরগোল বেঁধে যায়। রিপোর্ট অনুসারে, গত এক বছরে এ-রাজ্যের বিভিন্ন জেলে থাকা সাজাপ্রাপ্ত মহিলারা মোট ১৯৬টি শিশুর জন্ম দিয়েছেন। এই তথ্যটুক রীতিমতো চোখ ছানাবড়া করার পক্ষে যথেষ্ট। কথাটা শোনার পরে একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনাদের মনেও ক্রমাগত উঁকি দিচ্ছে, এই ঘটনাগুলো ঘটা কীভাবে সম্ভব, যেখানে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য জেলকক্ষ নির্দিষ্ট ও ভিন্ন! হ্যাঁ, আমিও এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তিত। সেজন্য এই লেখা।
রিপোর্টে আরও উল্লেখ্য, এর মধ্যে তাঁরা একটি নামকরা সংশোধনাগারে গিয়েও একজন সাজাপ্রাপ্ত মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন। এমনকী, গত এক বছরে সেই হোমে সর্বমোট ১৫টি শিশুর জন্ম হয়েছে। কিন্তু, এগুলো হচ্ছেটা কীভাবে! এ তো গল্পগাছায় পড়া মিষ্ঠান্নবৃত্তান্ত কিংবা সাধুবাবার দেওয়া অমৃত ফলের গুণ নয়! এ রীতিমতো অনাচার, আইনবিরুদ্ধ, পাশবিকতা ও শোষণের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। যা দেখে বুঝেও চুপ থাকি আমরা, তথাকথিত সভ্য মানুষেরা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
একজন মানুষের সার্বিক প্রকৃতি নির্ভর করে তার পরিবার, আশপাশের পরিবেশ ও ছোট থেকে দেখা দৃশ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু, এসব দিক থেকে এই শিশুগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, বলতে পারেন! সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে তারা কতটা এগিয়ে দিতে পারবে নিজেদের! নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগটাই যে ঠিকমতো পাবে না তারা। তারা না পেল বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর না পেল সঠিক পিতৃপরিচয়। এই ব্যাপারগুলো শিশুগুলোর মনে যে কত বৃহৎ মাপের মানসিক চাপের সৃষ্টি করবে, তারা যে সামাজিক ভাবে কতটা অবহেলার শিকার হবে, তা আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র। এতে যদি এদের মধ্যে কেউ কেউ ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে, সে-দায় কার? শিশুটির?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিই, The Prison Statistics of India report for 2022, যা প্রকাশ করে ‘The National Crime Records Bureau’, এই রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২২ সালে ভারতের সমস্ত জেল ও সংশোধনাগার মিলে মোট ১৫৩৭ জন সাজাপ্রাপ্ত মহিলা জন্ম দিয়েছেন মোট ১৭৬৪টি শিশুর। যেখানে, সর্বপ্রথমে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের জেলগুলি (৩২৫ জন সাজাপ্রাপ্ত মহিলা জন্ম দিয়েছেন ৩৬৫টি শিশুর), এরপর বিহার (৩০০ জন সাজাপ্রাপ্ত মহিলা জন্ম দিয়েছেন ৩৩১টি শিশুর), এবং তার ঠিক পরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (১৬০ জন সাজাপ্রাপ্ত মহিলা জন্ম দিয়েছে ২১৩টি শিশুর)।
এই রিপোর্ট দেখে এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জিত, আমি চিন্তিত, চিন্তিত ওই শিশুগুলোর ভবিষ্যতের জন্য, যারা নিষ্পাপ, সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমরা জানি, একজন মানুষের সার্বিক প্রকৃতি নির্ভর করে তার পরিবার, আশপাশের পরিবেশ ও ছোট থেকে দেখা দৃশ্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু, এসব দিক থেকে এই শিশুগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, বলতে পারেন! সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে তারা কতটা এগিয়ে দিতে পারবে নিজেদের! নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগটাই যে ঠিকমতো পাবে না তারা। তারা না পেল বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর না পেল সঠিক পিতৃপরিচয়। এই ব্যাপারগুলো শিশুগুলোর মনে যে কত বৃহৎ মাপের মানসিক চাপের সৃষ্টি করবে, তারা যে সামাজিকভাবে কতটা অবহেলার শিকার হবে, তা আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র। এতে যদি এদের মধ্যে কেউ কেউ ভবিষ্যতে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে, সে-দায় কার? শিশুটির?
একটা কথা একটু কড়া ভাষায় না বলে পারছি না, ‘এক দেশ এক আইন’ গড়ার লক্ষে যে আমরা তরতর করে এগোচ্ছি, যা নিয়ে লোকসভার পরিবেশ সরগরম হচ্ছে মাঝেমধ্যেই, এই কি তার নমুনা! কেন একজন সাজাপ্রাপ্ত মহিলা জেলের ভেতরে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত হয়ে চলা এই নৃশংস, ঘৃণ্য, বর্বর অপরাধের সুবিচার পাবেন না, এগুলো কি একপ্রকার ধর্ষণ নয়! এর উত্তর কে দেবে!
তবু, এই সামান্য তথ্যটুকু আমরা জানতে পেরেছি। আর অন্যান্য যে অসংখ্য শারীরিক অত্যাচারগুলো ধামাচাপা পড়ে যায় জেলের চার দেওয়ালের মধ্যে, সেগুলো? জেল কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া ক্রমাগত এসব ঘটনা ঘটে চলা কোনওভাবে সম্ভবপর নয়। আবার এও মানি, প্রত্যেকে খারাপ নন। কিন্তু, এই ঘটনা দেখেও কেন তাঁরা নিশ্চুপ? কেন বিভিন্ন মহিলা কমিশন, হিউম্যান রাইটস কমিশন এই বেলায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকল, যাঁদের ওপর এই নির্যাতন হয়ে চলছে তাঁরা সাজাপ্রাপ্ত আসামী বলে, নাকি কর্তৃপক্ষের বড় বড় মাথা এর সঙ্গে জড়িত বলে, এই প্রশ্নও থাকল এই লেখাটির মাধ্যমে।
এখন থেকে মহিলা জেল ও সংশোধনাগারে শুধুমাত্র মহিলা পুলিশ ও কর্মী নিয়োগ করা এবং এইসব বে-আইনি কার্যে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া চালানোর জোরালো দাবি রাখছি। আর, একরাশ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছি তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের দিকে– কোথায় গেল আমাদের মোমবাতি মিছিল?