সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছে, ৯০ দিনের মধ্যে একটি নিয়মাবলি প্রস্তুত করে দিতে। এই নিয়মাবলিতে বলা থাকবে, কোনও অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে কতটুকু তথ্য সংবাদমাধ্যমকে পুলিশ সরবরাহ করবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে আমরা যেটা বলি, তা সুনিশ্চিত হয়েছে সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারায় লিপিবদ্ধ বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে। এই স্বাধীনতার অর্থ হল মৌখিক, লিখিত, ছাপার অক্ষরে, ছবির মাধ্যমে যথা সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে দেশের নাগরিকদের নিজস্ব মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার সুযোগ। তবে সংবিধানই বলে দিয়েছে– এই স্বাধীনতা ‘অবাধ’ নয়।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ইডির তদন্ত প্রসঙ্গে ‘ফেলুদা’ ও ‘জটায়ু’র অসামান্য কথোপকথনের প্রসঙ্গটি সম্প্রতি সামনে এনেছেন। যেখানে ফেলুদা ‘জটায়ু’কে বলছেন, ‘আমি অপরাধ দেখে অপরাধী খুঁজে বার করার চেষ্টা করি। আর আপনি অপরাধী ঠিক করে তার উপরে অপরাধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।’ অভিষেক ইডির তদন্ত প্রসঙ্গে যখন এই কথা বলছেন, ঠিক একই দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মিডিয়া ট্রায়াল প্রসঙ্গে প্রায় একই সুরে সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন দেশের প্রধান বিচারপতি। বস্তুত, মিডিয়া ট্রায়ালের ক্ষেত্রে মিডিয়ার তথা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাটা অনেকটা ‘জটায়ু’র মতোই। অনেক বিতর্কের পর সুপ্রিম কোর্ট উদ্যোগী হয়েছে এই মিডিয়া ট্রায়ালকে কিছুটা বাগে আনতে।
আমাদের দেশের ‘অপরাধী বিচার ব্যবস্থা’ দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্দোষতার অনুমানের উপর। অর্থাৎ, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিচারব্যবস্থায় তাঁকে নির্দোষ বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু, তথাকথিত মিডিয়া ট্রায়ালে অভিযুক্ত গোড়াতেই অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায়ের ভাষ্যে ঠিক ‘জটায়ু’ যেভাবে তাঁর উপন্যাসে অপরাধী ঠিক করে, তার ওপর অপরাধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ‘ফেলুদা’ সেখানে দেশের ‘অপরাধী বিচার ব্যবস্থা’র নীতিতেই তাঁর তদন্ত এগনোর চেষ্টা করেন। অর্থাৎ, ‘ফেলুদা’ আগে অপরাধকে চিহ্নিত করেন, তারপর অপরাধ দেখে অপরাধীকে খুঁজে বের করেন। নির্দোষতার অনুমানে তদন্তকারী সংস্থাকে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আনা তদন্ত প্রমাণ করতে হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের কোনও দায় থাকে না অপরাধীকে খুঁজে বের করার বা অভিযুক্তর অপরাধ প্রমাণ করার। জেসিকা লাল হত্যার মতো কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে মিডিয়া ট্রায়ালের জোরেই যে দোষীদের সাজা হয়েছে, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিডিয়া ট্রায়ালের পরে দেখা গিয়েছে অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্তর যোগ নেই। মিডিয়া চালিত হয় তার সার্কুলেশন অথবা টিআরপির ওপর দাঁড়িয়ে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে নির্দেশ দিয়েছে, ৯০ দিনের মধ্যে একটি নিয়মাবলি প্রস্তুত করে দিতে, যার ভিত্তিতে পুলিশ কোনও অপরাধের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে তথ্য দেবে। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সব রাজ্যের পুলিশ প্রধানকে এবং কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনকেও এই নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। পুলিশকর্তারা ও মানবাধিকার কমিশনের প্রধান তাঁদের প্রস্তাব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে পাঠাবেন। সেইসব প্রস্তাবের উপর দাঁড়িয়েই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ‘মিডিয়া ব্রিফিং’-এর নিয়মাবলিটি প্রস্তুত করবে। এই নিয়মাবলিতে বলা থাকবে, কোনও অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে কতটুকু তথ্য সংবাদমাধ্যমকে পুলিশ সরবরাহ করবে।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে আমরা যেটা বলি, তা সুনিশ্চিত হয়েছে সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারায় লিপিবদ্ধ বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে। এই স্বাধীনতার অর্থ হল মৌখিক, লিখিত, ছাপার অক্ষরে, ছবির মাধ্যমে যথা সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে দেশের নাগরিকদের নিজস্ব মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার সুযোগ। তবে সংবিধানই বলে দিয়েছে– এই স্বাধীনতা ‘অবাধ’ নয়। সংবিধানের ১৯(২) ধারায় লেখা রয়েছে– দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, মানহানি, আদালত অবমাননা, অপরাধের প্ররোচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মতামত প্রকাশে বিধিনিষেধ থাকবে। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা রয়েছে। গোপনীয়তা রক্ষা করাও একজনের ব্যক্তিস্বাধীনতা। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যম প্রায়শই ১৯(১)(ক) ধারার নামে এই ২১ নম্বর ধারাকে লঙ্ঘন করে। সুপ্রিম কোর্টের লক্ষ্য সংবিধানের ১৯(১)(ক) ও ২১ নম্বর ধারার মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করা। মিডিয়া ট্রায়াল সংক্রান্ত মামলাটির বিচারে সুপ্রিম কোর্ট একজন আদালত বান্ধব নিয়োগ করেছিল। সেই আদালত বান্ধবের সুপারিশ হল, সংবাদমাধ্যমকে তার সংবাদ প্রচার থেকে বিরত করা যাবে না। কিন্তু, খবরের সূত্রে যদি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়, তাহলে অবাঞ্ছিত মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধ হতে পারে। যে কোনও তদন্তের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের সূত্র হল– পুলিশ, সিবিআই, ইডি ইত্যাদি তদন্তকারী সংস্থাগুলি। ফলে এদের মিডিয়া ব্রিফিংকে যদি একটি নিয়মে বাঁধা যায় তাহলে মিডিয়া ট্রায়াল রোখা সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক এই রায়টির বিরোধিতা করতে এখনও কাউকে দেখা যায়নি। সংবাদমাধ্যমও এ নিয়ে চুপ রয়েছে। কিছু সামাজিক সংগঠন রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। বস্তুত, দেশের প্রেস কাউন্সিল বহু আগেই বলেছে, যে কোনও ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত, অভিযুক্ত ও সাক্ষীদের অযাচিত প্রচার দেওয়া মিডিয়াকে বন্ধ করতে হবে। কিন্তু, প্রেস কাউন্সিলের এই নির্দেশিকা কি কোনও সংবাদমাধ্যম মেনে চলে? খবরের কাগজের ক্ষেত্রে বিক্রি বাড়ানো এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ক্ষেত্রে টিআরপি তোলা ছাড়া আর কোনও নীতিই অনুসৃত হয় না। ঘটনাকে সংবাদের মোড়কে অতিরঞ্জিত ও উত্তেজক করে পরিবেশন অবিলম্বে বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংবাদমাধ্যম নিজের থেকে এ রাস্তায় হাঁটবে না। এখন দেখার সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগ এক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হয়। সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সংযমের ভারসাম্যের রাস্তা সুপ্রিম কোর্ট বের করতে পারবে, এই বিশ্বাস অনেকেই পোষণ করেন।