বৈদ্যবাটীর মধ্যবিত্ত পরিবারের বঙ্গ-শুটার মেহুলি ঘোষ। অসাফল্যের চোরাবালি গ্রাস করেছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি ফিরলেন। সদ্য সমাপ্ত ‘বিশ্ব শুটিং চ্যাম্পিয়ানশিপ’-এর আসরে ব্রোঞ্জ পেলেন, প্যারিস অলিম্পিকের ‘কোটা’-ও এনে দিলেন ভারতকে। বাঙালির কামব্যাকের ইতিহাস এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হল।
‘কামব্যাক’! বাঙালির স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতে ওই একটুকরো শব্দবন্ধকে ঘিরে বোধহয় আলাদা একটা অনুরাগ আছে। সেই গ্রেগ চ্যাপেলের গুমর ভেঙে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাইজ গজে প্রত্যাবর্তন মনে করুন। মাছে-ভাতে আকণ্ঠ বাঙালির ওটাই স্থবিরত্বের চীবর ছেড়ে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠা। সৌরভ পেরেছিলেন। আর পেরেছেন মেহুলি ঘোষ।
সাফল্য-ব্যর্থতার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উত্তরণের আলাদা একটা অধ্যায় নিজের অগোচরেই নির্মাণ করে ফেলেছেন বছর বাইশের বৈদ্যবাটীর মেয়ে। যা দেখে খেলাপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে চেনা সংলাপ বারবার ঢেউ খেলে ওঠে, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’।
এই যেমন ধরুন, বাকুতে আয়োজিত বিশ্ব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপের আসর। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের মতো সেই পরীক্ষার মঞ্চে ব্রোঞ্জ প্রাপ্তি ঘটেছে মেহুলির। শুধু তাই নয়, দেশকে মূল্যবান প্যারিস অলিম্পিকের ‘কোটা’-ও এনে দিলেন। ঘরের মেয়ের এমন কীর্তিতে তো গর্ব হওয়ারই কথা বঙ্গবাসীর, হচ্ছেও। পরের বছর ‘ভালবাসার শহর’-এ ১০ মিটার এয়ার রাইফেল হাতে সোনার পদক জয়ের যুদ্ধে নামবেন একজন ভারতীয় শুটার। আর সেই যোদ্ধা যে মেহুলি হবেন নিশ্চিতভাবেই, আবেগ-ভেলায় ভেসে সেই স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে ‘ঘরপোড়া’ বাঙালি।
আসলে মেহুলি তো নিছকই শুটার নন, তিনি সেই বঙ্গকুলের প্রতিনিধি, যাঁরা হেরে গিয়েও ফিরে আসার প্রতিস্পর্ধা দেখাতে জানেন। ব্যর্থতার চোরাগলিতে পথ হারিয়েও তাঁদের সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার মন্ত্রগুপ্তি জানা আছে। মেহুলি সেই পথের দিশারি। নয় তো যে-বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ লাভ করে দেশকে অলিম্পিকের ‘কোটা’ এনে দিলেন, কে জানত সেটাই ছিল শুটার-কন্যার ‘কামব্যাক ইভেন্ট’। তার আগের ইতিকথায় যে কেবলমাত্র ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস। বিগত সময়ে চেনা ফর্মের ধারেকাছে ছিলেন না। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। কিন্তু ওই যে। হেরে গিয়ে ভেঙে পড়া মেহুলির ধাতে নেই। মে-তে জাতীয় স্তরে পদক জয়ের হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ‘খেলো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি গেমস’-এর জোড়া সোনা, একটি ব্রোঞ্জ পান। তখনই পূর্বাভাস ছিল, মেহুলির প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ-প্রস্তুতির। সেই উত্তুঙ্গ ফর্মে অর্জন করে নিয়েছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আর এশিয়ান গেমসের ভারতীয় দলে নিজের জায়গা। বাকিটা আজ ইতিহাস।
কিন্তু এটাই কি প্রথমবার, ব্যর্থতার অলিগলি ছেড়ে বৈদ্যবাটীর মেহুলির সাফল্যের রাজপথে এসে দাঁড়ানো? মোটেই নয়। বছর পাঁচেক আগে ‘বুয়েনস আয়ার্সে যুব অলিম্পিক’-এ যখন রুপো পেলেন বঙ্গ-শুটার, ততদিনে তিনি দেশের উদীয়মান প্রতিভা হিসাবে চিহ্নিত। তারপর ‘কমনওয়েলথ গেমস’ থেকে ‘সাউথ-এশিয়ান গেমস’, ‘এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ’ থেকে ‘শুটিং বিশ্বকাপ’– যেই রেঞ্জে এয়ার রাইফেল হাতে নিশানা তাক করেছেন, বিফল মনোরথ হননি। কিন্তু তারপরেই আচমকা ব্যর্থতার গিরিখাতে অবগাহন। অসাফল্যের চোরাবালিতে একটা সময় বিস্মৃতির অতলেই তলিয়ে যাচ্ছিলেন মেহুলি। কোভিড-পর্বে প্রস্তুতির অভাবটাও তাঁর প্রত্যাবর্তনে তৈরি করেছিল প্রবল অন্তরায়। সব প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম করে সাফল্যের সরণিতে ফেরার সংকল্প নিয়েছেন। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-বান্ধব সঙ্গ ত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছেন গগন নারাংয়ের ‘গান ফর গ্লোরি’ শুটিং অ্যাকাডেমিতে। আত্মনিয়োজিত করেছেন নিজেকে ক্ষুরধার করে তুলতে, আগামীর লক্ষ্যে।
সেই পরিশ্রমের নিটফল? মেহুলি ফিরেছেন স্বমহিমায়। চেনা সাফল্যের পাকদণ্ডিতে পা রেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি অন্য ধাতুতে গড়া। হার শব্দটা তাঁর অভিধানে নেই। আসলে মধ্যবিত্তের শান্ত, গতানুগতিক যাপিত জীবনে শোরগোল ফেলে যে মেয়ে বাল্যকালে হাতে রাইফেল তুলে নেয়, সে যে ব্যতিক্রমী হবে, এ তে আর আশ্চর্যের কী! মরা গাঙে বান ডাকলে, ‘জয় মা’ বলে তরী ভাসানো তাই মেহুলির মতো ‘স্বয়ংসিদ্ধা’র স্বভাবসিদ্ধ অভ্যাস। ‘কামব্যাক’-এর ক্যানভ্যাস এঁকে মেহুলি অবলীলায় টেবিল ঠুকে বলতেই পারেন– ‘আই উইল গো টু দ্য টপ! দ্য টপ! দ্য টপ!’
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?