বিতর্কিত বিল পাস করানো উদ্দেশ্যেই কি রেকর্ড সংখ্যক সাংসদ বহিষ্কার?
Published by: Robbar Digital
Posted on: December 23, 2023 3:18 pm
Updated: December 23, 2023 3:18 pm
সংসদের ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ বা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অধিবেশনে ঢোকার অভিযোগে সাসপেন্ড হওয়া একেবারেই বেনজির। এটা লঘুপাপে গুরুদণ্ড। ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ বা অধিবেশনে কোনও ইস্যুতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢোকা ভারতীয় সংসদে বিরোধী দলের বরাবরের দস্তুর। সংসদ অচল করাই বিরোধীদের কাজ বলে সাত দশক ধরে ভারতীয় গণতন্ত্র জেনে এসেছে। সেই কাজের জন্যই এবার সাংসদদের ঝাঁকে ঝাঁকে সাসপেন্ড করে দেওয়া গোটা বিশ্বকেই বিস্মিত করেছে।
সুতীর্থ চক্রবর্তী
উত্তপ্ততম শীতকালীন অধিবেশন প্রত্যক্ষ করল ভারতীয় সংসদ। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে যা কখনও কেউ দেখেনি, তাই এবার দেখা গেল ভারতের সংসদে। ১৪৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করে চলল অধিবেশন। তার আগে বহিষ্কার করা হল সুবক্তা তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রকে। অথচ এই উত্তপ্ততম ও ঐতিহাসিক অধিবেশনে এমন কয়েকটি বিল পাস হল, যা স্বাধীনোত্তর ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোতে আমূল বদল ঘটাতে পারে।
ঘটনাচক্রে সংসদের এই অধিবেশনেই ধোঁয়াকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে গেল। সংসদের দীর্ঘ ইতিহাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গাফিলতি প্রথম নয়। কিন্তু, ১৩ ডিসেম্বরই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এত বড় ঘাটতি হাড়হিম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঠিক ২২ বছর আগে ১৩ ডিসেম্বরই সংসদে হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। আবার সেই ১৩ ডিসেম্বরই নয়া সংসদ ভবনে গ্যালারি থেকে ঝাঁপ দিল দুই তরুণ। কী উদ্দেশে এই দুই তরুণ এত বড় ঝুঁকি নিয়ে গ্যালারি থেকে সংসদে ঝাঁপ দিয়ে ধোঁয়া ছড়াল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এদের পিছনে কোন শক্তি কাজ করেছে, তার এখনও পর্যন্ত কোনও বিশ্বাসযোগ্য উত্তর মিলছে না। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার এতবড় ঘটনাটি সংসদে পথ তৈরি করে দিল সাসপেনশনের নজির সৃষ্টির।
সংসদে ঝাঁপিয়ে পড়া দুই যুবককে পাস দেওয়ায় অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহার বহিষ্কার ও ধোঁয়াকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে অমিত শাহ-র বিবৃতি চেয়ে লোকসভায় ৯৯ জন এবং রাজ্যসভায় ৪৭ জন সাংসদ সাসপেন্ড হয়েছেন। এই রেকর্ড সাসপেনশনের পরেও লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা জানিয়েছেন, সংসদের নিম্নকক্ষে এই অধিবেশনে ৭৪ শতাংশ কাজ হয়েছে। লোকসভায় পাস হয়েছে মোট ১৮টি বিল এবং রাজ্যসভায় পাস হয়েছে মোট ১৭টি বিল। এর মধ্যে রয়েছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দণ্ডসংহিতার তিনটি বিল, টেলিকম বিল, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগপদ্ধতি সংক্রান্ত বিল, পোস্টাল বিল ইত্যাদি। এই সবক’টি বিল দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা পি. চিদম্বরমের মতে, সংসদের শীতকালীন অধিবেশন দেখল এমন একটি ক্রিকেট ম্যাচ, যেখানে বিপক্ষকে ব্যাট করতেই দেওয়া হল না। বাস্তবিকই একেবারে ফাঁকা মাঠে নেমে গোল করে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিতে নিলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ-রা। দণ্ডসংহিতার যে তিনটি বিল বিরোধীহীন সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হল, তার প্রভাব দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সুদূরপ্রসারী। এই তিনটি বিলের মাধ্যমে শতাব্দীপ্রাচীন আইপিসি, সিআরপিসি এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের সম্পূর্ণ সংস্কার করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আইনের খোলনলচে বদলে দেওয়ার নামে দেশে পুলিশরাজ প্রবর্তনের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। রাজদ্রোহ আইনের বিলোপ ঘটিয়ে আরও কড়া দেশদ্রোহ আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের দমনের নামে যা প্রয়োগ হতে পারে সরকারের বিরোধিতা করলেই। একইভাবে বিরোধীশূন্য সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে বিতর্কিত টেলিকম বিল। সংসদের দুই কক্ষে পাস হওয়ার পর এটা এখন আইন হওয়ার পথে। নয়া টেলিকম আইনের বলে, সরকার যে কোনও টেলি পরিষেবা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ অস্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে পারবে। ই-মেল ও হোয়াটসঅ্যাপের গোপনীয়তা আংশিকভাবে সরকার ভাঙতে পারবে। নয়া টেলিকম আইনে নিলাম ছাড়াই সরকার কোনও বেসরকারি সংস্থাকে স্যাটেলাইটের স্পেকট্রাম বণ্টন করতে পারবে। এই সময় পাস হওয়া নয়া পোস্টাল বিলে ডাক বিভাগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ডাকে আসা যে কোনও চিঠি ও সামগ্রী খুলে দেখার। কার্যত বিনা বিতর্কে সংসদের দুই কক্ষে পাস হয়েছে মুখ্যনির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ সংক্রান্ত বিল। এই বিলের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের পূর্ণক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছে। অর্থাৎ, সদ্য পাস হওয়া সবক’টি বিলই আইনে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের এতকালের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে খর্ব করার ক্ষমতা রাখে।
প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্কিত এই বিলগুলি পাস করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই কি সংসদ থেকে রেকর্ড সংখ্যক সাংসদকে বহিষ্কার করা হল? সংসদের ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ বা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অধিবেশনে ঢোকার অভিযোগে সাসপেন্ড হওয়া একেবারেই বেনজির। এটা লঘুপাপে গুরুদণ্ড! ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ বা অধিবেশনে কোনও ইস্যুতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢোকা ভারতীয় সংসদে বিরোধী দলের বরাবরের দস্তুর। সংসদ অচল করাই বিরোধীদের কাজ বলে সাত দশক ধরে ভারতীয় গণতন্ত্র জেনে এসেছে। সেই কাজের জন্যই এবার সাংসদদের ঝাঁকে ঝাঁকে সাসপেন্ড করে দেওয়া গোটা বিশ্বকেই বিস্মিত করেছে। অনেকেই সে কারণে তুলনা টানছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলারের নাৎসি জার্মানির রাইখস্ট্যাগের ঘটনার।
তবে ১৪৬ জনকে সাসপেন্ড করে সংসদে একটার পর একটা বিতর্কিত আইন তৈরি করে নেওয়ার পর হিটলারের সঙ্গে তুলনায় আসায় কি আদৌ বিচলিত নরেন্দ্র মোদির সরকার? রাজনৈতিক মহলের একটি বড় অংশের মতে সরকার নির্বিকার। কারণ, সংসদে কী হল, না হল, তা নিয়ে উদাসীন সিংহভাগ ভারতবাসীই। লোকসভা নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ রয়েছে। নির্বাচনের আগে সরকার কী প্রতিশ্রুতি দেবে না দেবে, তা নিয়ে জনতার আগ্রহ আছে। কিন্তু সংসদে কী ঘটল না ঘটল, তা নিয়ে আগ্রহ কতজনের? ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রতিবাদ আন্দোলনে তো দিল্লির বাইরে সাড়াই দিল না বিরোধী দলগুলি।