Robbar

না হাসি তো ফাঁসি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 13, 2024 9:19 pm
  • Updated:July 13, 2024 9:19 pm  

‘হাসি’-কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে জাপান। বিশেষত, তাদের উত্তরাঞ্চলে। উত্তর জাপানের ইয়ামাগাতায় আইন করে হাসি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দিনে অন্তত একবার হাসলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমবে, দাবি স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। পাঁচ বছর আগে ‘জার্নাল অফ এপিডিমিয়োলেজি’-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় একই দাবি করা হয়েছিল। তারই উপর ভিত্তি করে ইয়ামাগাতা ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষকরা হাসির একগুচ্ছ উপকারিতা প্রমাণ করেছেন।

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়

আমাদের চারপাশে ‘রামগরুড়ের ছানা’ বা ‘গোমরাথেরিয়াম’দের সংখ্যা কি ক্রমশ বেড়েই চলেছে? যেদিকেই তাকাই, সকলেই খুব গম্ভীর, মুখে হাসি নেই। মাথায় যেন জগদ্দল পাথরের বোঝা। প্রাত্যহিক বিভিন্ন চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে হাসি। একটু ইন্ধন পেলেই ঝগড়া, চিৎকার-চেঁচামেচি, সুযোগ থাকলে হাত-পা চালাতেও অনেকে দ্বিধা করেন না। তাতেই যেন চাপমুক্তি। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই এক অবস্থা! কর্মব্যস্ত জীবনের নিত্যকারের ঝামেলা, সংসারের নানা চাপ, সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ যেন হাঁপিয়ে উঠছে। কবে সব চিন্তা ভুলে মন খুলে হেসেছিলাম, সেটাও ভুলে গিয়েছি আমরা। ইদানীং, তাই ক্রমশ ভিড় বাড়ছে গ্রহশান্তির ‘দোকানগুলি’তে।

রামগরুড়ের ছানা - উইকিপিডিয়া
‘রামগরুড়ের ছানা’ (ছবিসূত্র: ইন্টারনেট)

সেই ক’বে সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ‘…হাসছি কেন কেউ জানে না, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই…উঠ্‌ছে হাসি ভস্‌ভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে।’ সত্যিই একটা সময় ছিল, যখন হাসির জন্য সবসময় কারণ দরকার হত না। জোক্‌স, চুটকি শুনে হাসি তো পেতই, পাশাপাশি যে কোনও সঙ্গীর হালকা কথায় হাসা যেত। ভাবগম্ভীর পরিবেশ হালকা করে দেওয়া যেত হাসি-ঠাট্টায়। খুকখুকে হাসি, দাঁত বের করা হাসি, কান এঁটো করা হাসি, মুচকি হাসি, ফিচেল হাসি, মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি, অট্টহাসি– সে হাসির কত যে রকমফের! আর তার জন্য কেউ বিরক্ত হয়ে তাকালেও পরোয়া না করা– দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।

এখন হাসতে হয় মেপে, সৌজন্য রেখে। কার সামনে হাসছি, তিনি কী ভাববেন, চোদ্দবার ভাবতে হয়। না হলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। অথচ হাসির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের ভালো-মন্দ। নিজেকে ভালো রাখার প্রথম ও প্রধান ওষুধ হল, প্রাণ খুলে হাসা। যাঁরা প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, তাঁদের অর্ধেক অসুখ সেরে যায়। বলা ভালো, অনেক রোগ তাঁদের কাবু করতে পারে না। হাসি নামক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যেতে পারে সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি। যাঁরা প্রাণ খুলে হাসেন, জীবন সম্পর্কে তাঁদের ভাবনা থাকে ইতিবাচক। তাঁদের উপস্থিতি পারিপার্শ্বিকের মধ্যেও ইতিবাচক চিন্তার ঢেউ তুলতে পারে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী–সকলেই তাঁদের পছন্দ করেন। বাড়ে গ্রহণযোগ্যতা। তারপরেও কেন আমরা হাসি না? কেন হাসতে ভুলে যাচ্ছি?

……………………………………………………………………………………….

মস্তিষ্কের ‘হিউমার মাসল’-এর নেটওয়ার্ক বিভিন্ন ধরনের সিগন্যাল পাঠায়। হাসি মস্তিষ্কের ‘ফিল গুড’ কেমিক্যাল মেসেঞ্জার ‘ডোপামাইন’-কে উজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। হাসি স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। হাসার সময় মুখের ছোট ছোট ১৫টি পেশি কাজ করে। রক্ত সঞ্চালন বেশি হয়, মুখের ত্বক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রক্তচাপ পরিবর্তিত হয়, শ্বাসের গতি বেড়ে যায়। শরীরের সর্বত্র অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয়। দশ থেকে পনেরো মিনিট হাসলে খরচ হয় ৫০ ক্যালরি!

……………………………………………………………………………………….

আহ্লাদী
সুকুমার রায়ের ‘আহ্লাদী’ (ছবিসূত্র: ইন্টারনেট)

অবস্থা এমনই যে, এখন আইন করে হাসি বাধ্যতামূলক করতে হচ্ছে! ‘হাসি’-কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে জাপান। বিশেষত, তাদের উত্তরাঞ্চলে। উত্তর জাপানের ইয়ামাগাতায় আইন করে হাসি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দিনে অন্তত একবার হাসলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমবে, দাবি স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। পাঁচ বছর আগে ‘জার্নাল অফ এপিডিমিয়োলেজি’-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় একই দাবি করা হয়েছিল। তারই উপর ভিত্তি করে ইয়ামাগাতা ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষকরা হাসির একগুচ্ছ উপকারিতা প্রমাণ করেছেন। শারীরিক তো বটেই, মানসিক সুস্থতার জন্যও হাসি ‘উপকারী’। দাবি, প্রাণ খুলে হাসলে হৃদযন্ত্র আর ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়। মানসিক অবসাদ, বিষণ্ণতা দূর হয়। ব্যস, আর যায় কোথায়। একেবারে অর্ডিন্যান্স জারি। বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রকে হাসিতে ভরিয়ে তুলতে হবে। প্রতি মাসের ‘অষ্টম’ দিন পালিত হবে ‘হাসির দিন’ হিসেবে। না হাসলেও অবশ্য শাস্তি বা জরিমানা নেই। আর মুখ বুজে নিঃশব্দ হাসিকে ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেনি কর্তৃপক্ষ।

Emoji Feliz Png - Emoticon Smile Clipart (#886440) - PinClipart

বৈজ্ঞানিক তথ্য বলছে, হাসি আমাদের মস্তিষ্কের এক ধরনের ‘অনুভূতি’। মস্তিষ্কের ‘হিউমার মাসল’-এর নেটওয়ার্ক বিভিন্ন ধরনের সিগন্যাল পাঠায়। হাসি মস্তিষ্কের ‘ফিল গুড’ কেমিক্যাল মেসেঞ্জার ‘ডোপামাইন’-কে উজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। হাসি স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। হাসার সময় মুখের ছোট ছোট ১৫টি পেশি কাজ করে। রক্ত সঞ্চালন বেশি হয়, মুখের ত্বক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রক্তচাপ পরিবর্তিত হয়, শ্বাসের গতি বেড়ে যায়। শরীরের সর্বত্র অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ হয়। দশ থেকে পনেরো মিনিট হাসলে খরচ হয় ৫০ ক্যালরি!

জীবনে প্রতিটি বিষয়ে, সবসময় সিরিয়াস হওয়া কি খুব দরকার? মোটেও না। বরং সবসময় সিরিয়াস থাকলে জীবন থেকে হাসি, মজা, আনন্দ সবকিছু একদিন হারিয়ে যাবে। কিছু পরিস্থিতি সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, সবসময় পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সব সমস্যার সমাধানও আমরা নিজেরা করতে পারি না। অকারণ চিন্তায় চাপ বাড়ে, দেখা দেয় নানা রোগের উপসর্গ। তাই এখন বিভিন্ন রোগে চিকিৎসকরা ‌‘লাফটার থেরাপি’ প্রয়োগ করছেন। দেশের নানা প্রান্তে চালু হয়েছে ‘লাফিং ক্লাব’।

Mumbai's Senior Citizens Medicate Through Laughter
লাফিং ক্লাবে পরিচিত দৃশ্য

………………………………………………………………………………….

আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: ১১ হাজার কেজি! রোহিতদের সংবর্ধনার ফলশ্রুতি ‘এত্তা জঞ্জাল’

………………………………………………………………………………………

হাসি মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাসি ভুলিয়ে দেয় নানা যন্ত্রণা-কষ্ট-ক্লেদ। কিন্তু তা বলে আইন করে হাসাতে হবে? এটাও তো ঠিক, আইন করে কাউকে কোনও কাজ করতে বাধ্য করা গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারকেও খর্ব করা। আমি কেন হাসব? না হাসলে আমার যা-ই হোক, অন্যের তো ক্ষতি করছি না। তাহলে আমাকে আমার মতো থাকতে দেওয়া হবে না কেন? এমন প্রশ্ন যে কেউ করতেই পারেন। কেউ বলতেই পারেন যে, ‘হাসির কথা শুনলে বলে হাস্‌ব না-না না-না’। হাসা বা না হাসার অধিকার সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে, এটা মৌলিক মানবাধিকার। দাবি জাপানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির। যারা অসুস্থতা বা কষ্টের কারণে হাসতে পারে না, নয়া আইন তাদের প্রতি বঞ্চনা, মনে করছেন জাপানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা তোরু সেকি, কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সাতোরু ইশিগুরোর মতো ব্যক্তিত্ব।

………………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………………….

তাহলে উপায়? আসুন, আমরা হাসি, আরও বেশি করে হাসি, কারণে-অকারণে হাসি। যন্ত্রণা ভুলতে, জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে, সুস্থ থাকতে হাসি। চাপে পড়ে বা বাধ্য হয়ে নয়, ভালবেসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসি। নিজেদের ও অন্যদের মুখে হাসি ফুটিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে হাসি।